ডিশওয়াশার থেকে ২ ট্রিলিয়ন ডলারের প্রতিষ্ঠানের মালিক; এনভিডিয়ার প্রতিষ্ঠাতার সফলতার গল্প
বিশ্বে মাত্র চারটি কোম্পানির সম্পদের পরিমাণ দুই ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি: মাইক্রোসফ্ট, অ্যাপল, অ্যালফাবেট (গুগলের মূল সংস্থা) এবং কম্পিউটার চিপ নির্মাতা এনভিডিয়া। ক্যালিফোর্নিয়া-ভিত্তিক সংস্থাটি গত বছরে মাত্র আট মাসে তার স্টক মার্কেট মূল্য এক ট্রিলিয়ন ডলার থেকে দুই ট্রিলিয়ন ডলারে নিয়ে গেছে।
সিলিকন ভ্যালির প্রাণকেন্দ্রে ক্যালিফোর্নিয়ার সান হোসেতে ডেনি'স রেস্তোরাঁয় বিশ্বের অন্যতম জিপিউ ও চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এনভিডিয়ার জন্ম। ১৯৯৩ সালে তিন তরুণ উদ্যোক্তা, রেস্তোরাঁর এক কোনায় বাটার মিল্ক প্যানকেক ও কফি খেতে খেতে প্রযুক্তি কোম্পানিটির স্বপ্ন বুনেন। তখন হয়ত ধারণা করতে পারেননি তাদের এই উদ্যোগ একসময় ২ ট্রিলিয়ন ডলারের প্রতিষ্ঠানে রূপ নেবে।
এনভিডিয়ার চিপ এবং প্রযুক্তি এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সম্ভব করে তুলেছে আর এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও জেনসেন হুয়াংকে বানিয়ে দিয়েছে গ্লোবাল টেক সুপারস্টারে।
সিইও জেনসেন হুয়াং সবসময় চমৎকারভাবে প্রতিষ্ঠানটির উত্থান পতনের গল্প সবার সামনে বলেন। তিনি যেন শ্রোতাদের একটি সময়ের যাত্রায় নিয়ে যান, তার সাফল্যের গল্প সবার মনে সৃষ্টি করে অনুপ্রেরণা ও উদ্দীপনার।
সাফল্য খুব একটা সহজে ধরা দেয়নি হুয়াংয়ের কাছে। তিনি তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন একজন বাসবয় হিসেবে। তারপর যোগ দেন ডেনি'স রেস্তোরাঁতেই। প্রথমে ডিশওয়াশার এবং পরে পদন্নোতি পেয়ে ওয়েটার হিসেবে কাজ করেন সেখানে।
১৫ বছর বয়স থেকেই থালা-বাসন ধোয়া এবং টেবিল পরিষ্কার করার মতো কাজগুলো করেছিলেন তিনি। এটি তাকে নম্রতা, কঠোর পরিশ্রম এবং আতিথেয়তার মতো গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলি অর্জন করতে সাহায্য করে, যা পরে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে তার যাত্রাকে পরিপূর্ণতা দিয়েছে।
হুয়াং বিশ্বাস করেন যে ডেনি'সে কাজ করার কারণেই তার মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী রপ্ত হয়েছে।
যখন হুয়াং এবং তার বন্ধুরা তাদের কোম্পানি শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তারা এই রেস্তোরাঁতে বসেই পরিকল্পনা সাজান। কারণ এখানে তাদের প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছুই ছিল; প্রশস্ত টেবিল, খাবার এবং অফুরন্ত কফি।
তবে এনভিডিয়ার চলার পথ এত মসৃণ ছিল না, প্রায় একাধিকবার তারা ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়ে। শুরুর দিকে চিপ বানাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন তারা। সঠিক কার্যকর চিপ বানাতে ব্যর্থ হতে হতে কয়েক বছর পর সফলতার মুখ দেখেন।
হুয়াং জানান, ১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠানটির বয়স যখন মাত্র তিন বছর, তখন প্রধান অংশীদার ভিডিও গেম সংস্থা সেগা'র সাথে চুক্তি ভেঙে যায়।
সেগার সাথে এনভিডিয়ার গেমিং কনসোলগুলোতে থ্রিডি গ্রাফিক্স রেন্ডার করার জন্য চিপ তৈরি করার চুক্তি ছিল। অর্থের হিসেবে নতুন একটি কোম্পানির জন্য অনেক বড় চুক্তি ছিল এটি। কিন্তু ভুল আর্কিটেকচার এবং উইন্ডোজের সাথে কাজ না করায় এনভিডিয়া বেকায়দায় পড়ে যায়।
সেই সময়কালে, মাইক্রোসফ্ট তার ডাইরেক্টএক্স সফ্টওয়্যার ইন্টারফেসটি চালু করেছিল, যা গেমিং প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে এবং এটি এনভিডিয়ার চিপগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না।
হুয়াং সেই স্মৃতি স্মরণ করে বলেন, 'আমরা ধোঁয়াশায় ছিলাম, জানতাম না সামনে কী অপেক্ষা করছে। আমরা যদি সেগার গেইম কনসোলটি সম্পন্ন করতাম, তাহলে আমরা হয়ত নিম্নমানের প্রযুক্তির চিপ তৈরি করতাম, উইন্ডোজের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হতো এবং প্রযুক্তিগত ভাবে অনেক পিছিয়ে থাকতাম। কিন্তু এদিকে চুক্তি শেষ করতে না পারলে আমাদের টাকা ফুরিয়ে যাবে। ঘুরে ফিরে, আমরা ব্যবসা থেকে বেরিয়ে যাব।'
হুয়াং সেই সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে সর্বোত্তম উপায় হলো সেগার সাথে এ নিয়ে খোলামেলা সব পরিষ্কার করে বলা।
হুয়াংয়ের ভাষ্যে, 'আমি টাকার কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছিলাম। সেগার সিইও, আমাকে অবাক করে, সম্মত হন। চুক্তি ভঙ্গের আগে যতটুকু কাজ করা হয়েছে ততটুকুর অর্থ পরিশোধ করেন তিনি। যার কারণে আমাদের হাতে আরও ছয় মাস টিকে থাকার মতো টাকার নিশ্চয়তা হয়।'
হুয়াং সেগা চুক্তি থেকে প্রাপ্ত এ অর্থ একটি নতুন চিপ আরআইভিএ ১২৮ তৈরি করতে ব্যবহার করেন— যা ডাইরেক্টএক্সের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।
নতুন চিপটি বাজারের অন্যান্য চিপের তুলনায় উচ্চতর গ্রাফিক রেজোলিউশনকে সমর্থন করত এবং এনভিডিয়া ১৯৯৭ সালে চার মাসে এক মিলিয়নেরও বেশি ইউনিট বিক্রি করতে সক্ষম হয়েছিল। এটিই তাদের ভাগ্য ঘুরিয়ে দেয়।
এনভিডিয়ার প্রতিষ্ঠাতারা নিরলস উদ্ভাবন এবং সাহসী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিকে আবার দাঁড় করাতে সক্ষম হন। গেমিংয়ের জন্য থ্রিডি গ্রাফিক্স চিপ বানানোর পাশাপাশি এআই প্রযুক্তিতে মনোনিবেশ করে তারা, যেটি কিনা এখন চ্যাটজিপিটির মতো প্রযুক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনায় এ পরিবর্তন তাদের জন্য ফলপ্রসু হয়ে আসে।
হুয়াং বলেন, 'কখনও কখনও বোঝাপড়া এবং উদারতা সমস্ত পার্থক্য তৈরি করতে পারে, এমনকি প্রতিযোগিতামূলক প্রযুক্তি শিল্পেও।'
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন