৬ ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু: 'নাইজেরিয়ার সেক্সটরশন প্রতারকরা যেভাবে আমার ছেলেকে টার্গেট করেছিল'
প্রতারণার নতুন নাম 'সেক্সটরশন' বা যৌন প্রস্তাব দিয়ে তার ভিত্তিতে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়। বিশ্বব্যাপী কিশোর কিশোরীরা নতুন এ প্রতারণার ফাঁদে না বুঝেই পা দিচ্ছেন। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ২৭ জনেরও বেশি সেক্সটরশনের শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। আর এসব প্রতারকদের বেশিরভাগই নাইজেরিয়ান নাগরিক। খবর বিবিসি'র।
দুই বছর আগে, প্রতারকরা ব্যক্তিগত ছবি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করলে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে জেন বুটারের ছেলে জর্ডান। জেন এখনও ছেলের শোবার ঘরের কিছু পরিবর্তন করেননি। তার বাস্কেটবল জার্সি, জামাকাপড়, পোস্টার এবং বিছানার চাদর যেমন ছিল তেমনই রেখে দিয়েছেন তিনি।
প্রতারকরা ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে জর্ডানের সাথে যোগাযোগ করে। মেয়ে সেজে তার সাথে প্রেমের অভিনয় চালিয়ে যেতে থাকে। তারা মেয়েটির যৌন আবেদনময়ী ছবি পাঠায় তাকে প্ররোচিত করার জন্য। জর্ডানও এক পর্যায়ে নিজের ব্যক্তিগত ছবি প্রতারকদের কাছে পাঠিয়ে দেন।
তারপরেই শুরু হয় ব্ল্যাকমেইল। তারা কয়েকশ পাউন্ডের দাবি করতে থাকে নাহলে ছবিগুলো তার বন্ধুদের কাছে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। জর্ডান যতটা সম্ভব টাকা পাঠিয়েছিল এবং প্রতারকদের বলেছিল তারা যদি ছবিগুলো ছড়িয়ে দেয় তবে সে আত্মহত্যা করবে। অপরাধীরা জবাব দিল, 'ভালো... তাড়াতাড়ি করো, নইলে আমরা তোমাকে দিয়ে এটা করাব।' প্রতারকদের ব্ল্যাকমেইল শুরু করার ছয় ঘণ্টার মাথাতেই শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেন জর্ডান।
অপরাধীদের অবশ্য তারপরে নাইজেরিয়া থেকে গ্রেপ্তার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে সমর্পণ করা হয়েছে। লাগোসের দুই ভাই স্যামুয়েল ওগোশি (২২) ও স্যামসন ওগোশি (২০) শিশু নির্যাতনের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর এখন সাজার অপেক্ষায় রয়েছেন।
জর্ডানের মৃত্যু এবং অন্যান্য মামলার সাথে যুক্ত আরেক নাইজেরীয় ব্যক্তির বিরুদ্ধেও মামলা চলমান।
এদিকে, ছেলের মৃত্যুর পর জেন এখন টিকটকে তরুণদের জন্য সেক্সটরশন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করেন। তার ভিডিওগুলোতে এক মিলিয়নেরও বেশি রিয়েকশন আছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অপরাধের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত বছর সেক্সটরশনের ঘটনা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে ২৬ হাজার ৭০০ জনে দাঁড়িয়েছে এবং গত দুই বছরে অন্তত ২৭ জন ছেলে আত্মহত্যা করেছে।
গবেষক এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো জানিয়েছে পশ্চিম আফ্রিকা এবং বিশেষত নাইজেরিয়াকে এসব প্রতারকদের আখড়া।
গত এপ্রিলে অস্ট্রেলিয়ার এক স্কুলছাত্র আত্মহত্যার পর দুই নাইজেরীয় নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে ১৫ বছর বয়সী এক কিশোর এবং কানাডায় ১৪ বছর বয়সী এক কিশোরের আত্মহত্যার পর লাগোসে আরও দুজনের বিচার চলছে।
জানুয়ারিতে মার্কিন সাইবার কোম্পানি নেটওয়ার্ক কনটেজিয়ন রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এনসিআরআই) জানায়, নাইজেরিয়ার টিকটক, ইউটিউব এবং স্ক্রিবড অ্যাকাউন্টের একটি নেটওয়ার্ক সেক্সটরশনের টিপস এবং স্ক্রিপ্ট নিয়মিত শেয়ার করছে।
নাইজেরিয়ান তরুণরা অনেক আগে থেকেই নানা ধরনের সাইবার ক্রাইমের সাথে যুক্ত। ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে ইয়াহুর মেইলের মাধ্যমে নাইজেরিয়ানরা প্রতারণা করত। অনলাইন প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা নাইজেরিয়ানদেরকে 'ইয়াহু বয়েজ' বলে সম্বোধন করা হত তখন।
ডিজিটাল ফুটপ্রিন্টস নাইজেরিয়ার ড. টমবারি সিবে বলেন, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের কারণে তরুণদের মধ্যে সেক্সটরশন এবং অন্যান্য সাইবার জালিয়াতি স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। অনেক তরুণ এটিকে অর্থ উপার্জনের উপায় হিসেবে দেখেন।
আফ্রিকান মানবাধিকার দাতব্য সংস্থা ডেভটপ বলেছে, নাইজেরিয়ায় সেক্সটরশন মোকাবিলার পদ্ধতিগুলো ব্যর্থ হয়েছে।
বিবিসিকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে নাইজেরিয়ার ন্যাশনাল সাইবার ক্রাইম সেন্টারের (এনসিসিসি) পরিচালক পুলিশ বাহিনীর কর্মকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেছেন, অপরাধীদের ধরতে এবং ভবিষ্যতে হামলা ঠেকাতে তারা কঠোর পরিশ্রম করছেন।
নাইজেরিয়ার ন্যাশনাল সাইবার ক্রাইম সেন্টারের (এনসিসিসি) পরিচালক উচে ইফিয়ানি হেনরি বলেছেন যে তার কর্মকর্তারা অপরাধীদের ধরতে দিনরাত কাজ করছেন। নাইজেরিয়া সেক্সটরশনকে গুরুত্ব সহকারে নেয় না এমন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি। তিনি আরও বলেন, অপরাধীদের বিচার ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তৎপরতা বৃদ্ধির কারণে অনেকে প্রতিবেশী দেশগুলোতে পালিয়ে যাচ্ছে।
হেনরি একটি অত্যাধুনিক সাইবার-ক্রাইম সেন্টারে সরকারের বিনিয়োগের অনুরোধ করেন যা সাইবার-অপরাধ, বিশেষত সেক্সটরশন মোকাবিলায় সাহায্য করবে।
তিনি বলেন, নাইজেরিয়ান কিশোর কিশোরীরাও সেক্সটরশনের শিকার হচ্ছেন। অপরাধীরা কেবল নাইজেরিয়ার সমস্যা নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের অপরাধীরাও জড়িত আছে। এগুলো মোকাবিলায় বৈশ্বিক সমর্থন প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
হেনরি এবং তার দল সেক্সটরশন এবং সাইবার-অপরাধ তদন্ত নিয়ে আলোচনা করতে যুক্তরাজ্যের জাতীয় অপরাধ সংস্থা পরিদর্শন করছেন। সম্প্রতি জাপানের পুলিশের সঙ্গেও একই ধরনের বৈঠক হয়েছে।
এদিকে, জেন বুটা জর্ডানের বাবা জন ডিমেয়ের সাথে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। ভুক্তভোগী তরুণদের নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন তারা।