ইউরোপীয় নির্বাচন কী, কেন এই ভোট?
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ৭২০ আসনের নির্বাচনে মধ্যপন্থী, উদার ও সমাজতান্ত্রিক দলগুলো মিলে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখলেও বড় উত্থান হয়েছে ডানপন্থীদের। বিশেষ করে ফ্রান্স ও জার্মানিতে বড় ব্যবধানে জয়লাভ করতে যাচ্ছে কট্টর ডানপন্থী দলগুলো।
২৭টি দেশের বুথফেরত জরিপে দেখা যাচ্ছে, ইউরোপীয় কমিশনের বর্তমান প্রধান উরসুলা ভন ডার লেনের মধ্য-ডানপন্থি দল ইউরোপীয়ান পিপলস পার্টি (ইপিপি) ইইউ পার্লামেন্টের ৭২০টি আসনের মধ্যে ১৯১টি আসনে জিতেছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা মধ্য-বামপন্থি সোস্যালিস্টস অ্যান্ড ডেমোক্র্যাটরা (এস অ্যান্ড ডি) ১৩৫টি আসন পেয়েছে। তৃতীয় স্থানে থাকা উদারপন্থি রিনিউ গ্রপ ৮৩টি আসন পেয়েছে।
কেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ?
নির্বাচনে ইউরোপীয়দের ভোট আগামী পাঁচ বছরের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ ঠিক করে দেবে, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন, অভিবাসন, জাতীয়তাবাদের মতো বিষয়গুলো নির্বাচনের ফলাফলের ওপর অনেকটা প্রভাব বিস্তার করবে।
ডানপন্থী এবং কট্টর ডানপন্থী দলগুলো ইউরোপে জনপ্রিয়তা পাওয়ায় নির্বাচনের ফলাফলে ইতোমধ্যেই এর প্রভাব দেখতে পাওয়া গেছে। বুথফেরত জরিপ অনুযায়ী, মধ্য-ডানপন্থী ইউরোপিয়ান পিপলস পার্টি ইউরোপীয় পার্লামেন্টে আরও নিয়ন্ত্রণ অর্জন করেছে। ফ্রান্স ও জার্মানিতে কট্টর ডানপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো বুথফেরত জরিপে এগিয়ে থাকলেও আশানুরূপ ফলাফল পায়নি মধ্যপন্থী, উদারপন্থী, গ্রিন পার্টি কিংবা বাম দলগুলো।
ব্রাসেলস ও স্ত্রাসবুর্গে অবস্থিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংসদ ইউরোপের নাগরিকদের জন্য আইন তৈরি করে এবং বার্ষিক বাজেট অনুমোদন করে, যা এই বছরে মোট ১৮৯ বিলিয়ন ইউরো নির্ধারন করা হয়েছে। এটি ইইউ অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর সরকারের সাথে সমন্বয় করে গঠিত কাউন্সিলের মাধ্যমে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নেয়। ইইউ নির্বাচনের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করেই ইউরোপীয় কমিশনের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কে হবেন তা নির্ধারণ করা হয়।
কীভাবে ইইউ নির্বাচনে ভোট দেয়া হয়? কোন দেশের আসন সংখ্যা কত?
ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনের জন্য ৬ জুন নেদারল্যান্ডসে প্রথম ভোট গ্রহণ শুরু হয়। তারপরে শুক্রবার আয়ারল্যান্ড এবং চেক প্রজাতন্ত্র, শনিবার ইতালি, লাটভিয়া, মাল্টা এবং স্লোভাকিয়ায় নির্বাচন আয়োজিত হয়। রোববার ইউরোপীয় ইউনিয়নের অধিকাংশ সদস্য রাষ্ট্রে ভোট আয়োজিত হয়েছে।
যদিও বেশিরভাগ দেশ একদিনে ভোট দেয়, চেক প্রজাতন্ত্রে ভোট দেওয়ার জন্য শনিবার পর্যন্ত সময় ছিল এবং ইতালিতে শনিবার বিকেল থেকে রোববার পর্যন্ত ভোট হয়েছে। বেলজিয়ানরা রোববার শুধু ইউরোপীয় নির্বাচনেই নয়, জাতীয় ও আঞ্চলিক নির্বাচনেও ভোট দিয়েছে।
বেশিরভাগ ইইউ দেশে ভোট দেওয়ার সর্বনিম্ন বয়স ১৮। কিন্তু জার্মানি, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম এবং মাল্টায় ১৬ বছর বয়সেই ভোট দেয়া যায়। গ্রীসে ভোট দেয়ার জন্য সর্বনিম্ন বয়স ১৭ বছর। লুক্সেমবার্গ এবং বুলগেরিয়ার মতো কিছু দেশে ভোট দেয়া বাধ্যতামূলক৷
নির্বাচনের ফলাফল আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব দ্বারা নির্ধারিত হওয়ায় প্রতিটি ভোট গুরুত্বপূর্ণ। যদিও কিছু দেশে ন্যূনতম ৫ শতাংশ ভোট পড়ার রেকর্ড রয়েছে। ২০১৯ সালের ইইউ নির্বাচনে গড় ভোটার ছিল ৫০.৭ শতাংশ।
যুক্তরাজ্য ইইউ ছাড়ার আগে গত ইউরোপীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের আসনগুলো পুনর্বণ্টন করা হয়েছে বা রিজার্ভ রাখা হয়েছে।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য (এমইপি) সংখ্যা প্রতিটি দেশের জনসংখ্যার সমানুপাতিক। উদাহরণস্বরূপ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে জনবহুল দেশ জার্মানির ৯৬ জন এমইপি রয়েছে, যেখানে ফ্রান্সের রয়েছে ৮১ জন এবং ইতালির ৭৬ জন। গ্রিস, সুইডেন, পর্তুগাল এবং চেক প্রজাতন্ত্রের মতো প্রতিটি দেশে ২১ জন করে এমইপি রয়েছেন। মাল্টা, লুক্সেমবার্গ এবং সাইপ্রাসে ন্যূনতম ছয়জন এমইপি রয়েছেন।
ইউরোপীয় পার্লামেন্ট কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
ইউরোপীয় পার্লামেন্ট হল একমাত্র ইইউ প্রতিষ্ঠান যেটির সদস্যরা ২৭ দেশের ভোটারদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ইইউ এর নির্বাহী শাখা ইউরোপীয় কমিশন এবং ইইউ সরকারের মন্ত্রীদের সমন্বয়ে গঠিত কাউন্সিলের সাথে সমন্বয় করে।
পার্লামেন্ট আইন সংশোধন ও পাস করা, আন্তর্জাতিক চুক্তি করা ও সংশোধনীর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং ইইউ-এর বার্ষিক বাজেট অনুমোদন করার মাধ্যমে ইইউ আইন ও নীতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ইইউ কমিশনকে আইন প্রণয়নের জন্যও অনুরোধ করতে পারে।
এমইপিরা কমিশন এবং কাউন্সিলের কাজ তত্ত্বাবধান করে এবং কমিশনের প্রস্তাবিত আইন গ্রহণের জন্য কাউন্সিলের সাথে দায়িত্ব ভাগ করে নেয়। বেশিরভাগ এমইপিরা জাতীয়তা দ্বারা বিভক্ত না হয়ে বিস্তৃত রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সদস্য। তাই তারা প্রায়ই তাদের দল এবং দেশের মধ্যে আনুগত্যের ভারসাম্য বজায় রাখে।
প্রধান রাজনৈতিক দল কোনগুলো?
ঐতিহ্যগতভাবে ইইউ এর সবচেয়ে বড় দুটি দল হলো মধ্য-ডানপন্থী ইউরোপিয়ান পিপলস পার্টি (ইপিপি) এবং মধ্য-বামপন্থী প্রোগ্রেসিভ এলাইয়েন্স অব সোশ্যালিস্ট অ্যান্ড ডেমোক্র্যাটস (এসএন্ডডি)। কিন্তু অন্যান্য দলগুলো ক্রমশ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
উদারপন্থী রিনিউ ইউরোপ গ্রুপ এবং গ্রিনস/ইউরোপিয়ান ফ্রি অ্যালায়েন্স গত পার্লামেন্টে বৃহত্তম ছিল। কিন্তু ডানপন্থী এবং কট্টর ডানপন্থী দল ইউরোপীয় কনজারভেটিভস এন্ড রিফর্মিস্টস (ইসিআর) এবং আইডেন্টিটি অ্যান্ড ডেমোক্রেসি (আইডি) গ্রুপ নিয়ে গঠিত দুটি গ্রুপ নির্বাচনে বড় জয়ের আশা করছে।
ইইউতে দুটি ছোট দলও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি হল ছোট বামপন্থী জিউই/এনজিএল গ্রুপিং এবং অন্যটি হাঙ্গেরির জাতীয়তাবাদী ফিডেজ সদস্য থেকে শুরু করে স্পেনের কাতালুনিয়া অঞ্চলের অল্প কয়েকজন বিচ্ছিন্নতাবাদী এমইপিদের দল।
বুথ ফেরত জরিপ অনুযায়ী নির্বাচনের ফলাফল কী?
ফ্রান্সে মেরিন লে পেনের কট্টর ডানপন্থী ন্যাশনাল র্যালি দল প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর দলের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ ভোট পেয়েছে। বুথফেরত জরিপে মাখোঁ সমর্থিত দল বড় ব্যবধানে পিছিয়ে থাকায় পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। পরাজয় মেনে নিয়ে আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন মাখোঁ।
জার্মানিতে বর্তমান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ এর সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দল মূলধারার রক্ষণশীল ও কট্টর-ডানপন্থী অলটারনেটিভ ফর জার্মানির (এএফডি) থেকে ভোটে পিছিয়ে আছে।
তবে এবারের নির্বাচনে ইতালিতে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী জর্জিও মেলোনির ফ্রাটেলি ডে ইটালিয়ার দলের ফলাফল সন্তোষজনক ছিল।
পোল্যান্ডের মধ্যপন্থী নেতা ডোনাল্ড টাস্ক এর দল নির্বাচনে ভালো করেছে। ইতোমধ্যেই সুইডেন, ফিনল্যান্ড এবং ডেনমার্কে বামপন্থীরা এবং গ্রিন পার্টি ভালো ফলাফল করেছে।
পর্তুগালের বিরোধী সোশ্যালিস্ট পার্টি (পিএস) ইউরোপীয় নির্বাচনে ৩২ শতাংশ ভোট এবং আটটি আসন নিয়ে বিজয় অর্জন করেছে, যেখানে বর্তমানে জাতীয় ক্ষমতায় থাকা মধ্য-ডানপন্থী ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স ৩১ শতাংশ ভোট ও সাতটি আসন পেয়েছে।
ইউরোপীয় কমিশনের পরবর্তী প্রধান কে হবেন?
নব-নির্বাচিত এমইপিদের প্রথম কাজগুলোর মধ্যে একটি হবে ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান নির্বাচন করা। বুথফেরত জরিপ অনুযায়ী, ইউরোপীয় কমিশনের বর্তমান প্রধান উরসুলা ভন ডার লেনের মধ্য-ডানপন্থী ইউরোপিয়ান পিপলস পার্টি ইউরোপীয় পার্লামেন্টে আরও নিয়ন্ত্রণ অর্জন করায় তার পুনঃনির্বাচিত হওয়ারই সম্ভাবনা বেশী বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইইউ এর ২৭টি রাষ্ট্রের সরকার প্রধানের সমন্বয়ে গঠিত ইউরোপীয় কাউন্সিল নির্বাচনের ফলাফল বিবেচনা করে একজন প্রার্থীকে মনোনীত করবে। প্রতিনিধিকে নির্বাচিত হতে হলে ৫০ শতাংশের বেশি এমইপির সমর্থন লাগবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনৈতিক দলগুলো 'লিড ক্যান্ডিডেটস' সিস্টেম ব্যবহার করতে পারে, যেখানে প্রতিটি গোষ্ঠী নির্বাচনের আগে কমিশনের প্রধান হিসেবে সম্ভাব্য প্রার্থীর প্রস্তাবনা দেয়। সবচেয়ে বেশি আসনের দলটি তখন ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ম্যান্ডেট পাবে।
২০১৪ সালে ইইউ নেতারা উরসুলা ভন ডার লেনকে বেছে নিয়েছিলেন যদিও তিনি প্রার্থী ছিলেন না।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়