ঈদুল আজহা: যুদ্ধের মধ্যে গাজায় আরেকটি দুঃখ-শোকের ‘ঈদ’
ইসরায়েল গাজাকে মানুষের বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছে। চাপিয়ে দিয়েছে দীর্ঘযুদ্ধ। ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি, স্কুল, হাসপাতাল, মসজিদ, গির্জা, বিশ্ববিদ্যালয় বা জরুরী অবকাঠামো। খাদ্য দূরের কথা, সুপেয় পানিও যেখানে নেই– তারমধ্যেই আরেকটি ঈদ এল।
ঈদুল আজহায় পশু কোরবানি দেন মুসলমানরা। কোরবানির অর্থ ত্যাগ, উৎসর্গ, বিসর্জন। কোরবানির গোশত দরিদ্র, প্রতিবেশী, ও আত্মীয়-পরিজনদের সাথে ভাগাভাগি করে নেন সবাই।
পশু কিনে কোরবানি দিতে আর্থিক সামর্থ্য দরকার। গাজা ভূখণ্ডের মানুষ বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র জনগোষ্ঠী। তার ওপর আট মাস ধরে যুদ্ধে সব আমদানি বন্ধ, ব্যবসাবাণিজ্য, দোকানপাট ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত টিকে থাকাটাই এক সংগ্রাম। এই মুহূর্তে গাজার সবাই অভাবী। ইসরায়েলের আট মাসের গণহত্যা ও সামরিক অভিযানে দুর্ভিক্ষ নেমে এসেছে ফিলিস্তিনের এ ভূখণ্ডে। গাজায় মানবিক ত্রাণ সাহায্য পৌঁছাতেও বাধা দিচ্ছে ইসরায়েল।
চারপাশে স্বজন হারানোর শোক, ক্ষুধার্ত শিশু ও বয়োবৃদ্ধের মলিন মুখ। কারোর মনেই আর ঈদের অনুভূতি নেই।
দক্ষিণ গাজার এক বালুময় জমিতে তাবু খাঁটিয়ে পরিবারসহ আশ্রয় নিয়েছেন বাস্তুহারা জায়না কামুনি। তিনি বলেন, 'গত পাঁচ মাস ধরে কোনোরকম মাংস খেতে পাইনি। ফলে এবারের ঈদুল আজহা-ও গত ঈদুল ফিতরের মতোই হবে।"
মাস-দুয়েক আগেও যুদ্ধের মধ্যেই ঈদুল ফিতর কাটে গাজাবাসীর। ঈদের দিনেও বর্বর হামলার শিকার হয় ফিলিস্তিনিরা। প্রতিদিন মানবিক পরিস্থিতির আরো অবনতি হচ্ছে। আহতদের চিকিৎসার জন্য ওষুধ, স্বাস্থ্যসেবার দরকারি অবকাঠামো নেই।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে এক সামরিক অভিযান চালায় হামাস। ওই দিন থেকেই ইসরায়েল এক অপপ্রচার শুরু করে। দাবি করে, হামাসের হাতে ১,২০০ জন নাগরিক নিহত হওয়ার। কিন্তু, পরে জানা যায়, বেসামরিক ইসরায়েলিদের অনেকেই নিহত হয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর আক্রমণে। অন্যদিকে, এই হামলার জবাবে গাজার ৩৭ হাজারের বেশি মানুষ বোমা, বুলেট, মিসাইল, রকেট আর গোলায় হত্যা করেছে ইসরায়েল। প্রতিদিন আরো মানুষকে হত্যা করছে। হতাহতের সংখ্যা ৮০ হাজার বা এক লাখেরও বেশি বলে ধারণা করছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
ফিলিস্তিনিদের সহায়তাদানের জন্য গঠিত জাতিসংঘের সংস্থা– ইউএনআরডব্লিউএ গত শনিবার সামাজিক মাধ্যমে করা পোস্টে উল্লেখ করেছে, "গাজায় মানবিক সহায়তা প্রদানকে অব্যাহতভাবে বাধা দেওয়ার ফলে সেখানে চরম মাত্রায় অনাহার দেখা দিয়েছে।" চরম অপুষ্টিতে ভোগা ৫০ হাজারের বেশি শিশুর এখন চিকিৎসা করানো দরকার বলেও ওই পোস্টে জানানো হয়।
ঈদুল ফিতরের আগেও যুদ্ধবিরতির আলোচনা নিয়ে আশায় বুক বেধেছিল গাজাবাসী। কিন্তু, ফল এসেছে শূন্য। এর আগে ইসরায়েল ও পশ্চিমা বিশ্বের গোয়ার্তুমির কারণে বড়দিন ও ইস্টারের সময়েও লড়াই বন্ধ হয়নি। গাজার সংখ্যালঘু খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীও ধর্মীয় উৎসবের জন্য ছাড় পায়নি। ফলে গাজাবাসী বাইডেন প্রশাসনের উদ্যোগে যুদ্ধবিরতির আলোচনা থেকে কিছু পাওয়ার আশা রাখে না।
মধ্য গাজার দেইর আল বালাহ এলাকার অধিবাসী ৫৩ বছরের আদনান আব্দুল আজিজ। যুদ্ধের আগের বছরগুলোয় তিনি দুম্বা বা ভেড়া কিনে কোরবানি দিতে পেরেছিলেন। ঈদের দিন তাঁর বাড়িতে ভেড়ার কলিজা দিয়ে সকালের নাস্তা তৈরি করা হতো। ফিলিস্তিনের ঐতিহ্যবাহী রেসিপিতে রান্না হতো গোশত। নিজেদের ভাগের অংশ রেখে, নিয়ম অনুযায়ী বাকিটা দরিদ্র ও আত্মীয়–স্বজনদের মধ্যে বিলিবন্টন করতেন।
গাজায় বাজারে নিত্যপণ্যের সরবরাহ নেই। যা আছে তার অবিশ্বাস্য অগ্নিমূল্য। সাধ্যের মধ্যে যা পান –পরিবারের জন্য সে খাদ্য প্রতিদিন কেনার চেষ্টা করেন আজিজ। অবর্ণনীয় সংগ্রাম যেখানে প্রতি মুহূর্তের, সেখানে ঈদের ভোজের তো প্রশ্নই আসে না।
ঈদ উৎসবের খাওয়া-দাওয়াই শুধু নয়, আরো অনেক কিছুই এবছরই অভাববোধ করেন আজিজ। তিনি বলেন, ঈদে আত্মীয়দের বাড়ি বাড়ি যাওয়া, সবাই একসাথে আড্ডা দেওয়া, বাচ্চাদের সালামি দেওয়া, সবার জন্য নতুন পোশাক কেনা, বাড়িতে তৈরি করা মিষ্টি, ঈদের নামাজ আদায় থাকে কত আয়োজন। এবছর কোনোটাই করা যাচ্ছে না। "সবাই দুঃখ ভারাক্রান্ত, প্রত্যেকেই কোনোকিছু, নয়তো কাউকে হারিয়েছে।"
অনুবাদ: নূর মাজিদ