হিজবুল্লাহর হুমকিতে শঙ্কায় সাইপ্রাস, কোন বিষয়গুলো ঝুঁকিতে রয়েছে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, লেবাননে ইসরায়েলকে হামলা চালাতে সহায়তা করলে সাইপ্রাসের বিরুদ্ধে হিজবুল্লাহর প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপদেশটির নাজুক ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানকে তুলে ধরেছে।
হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ ১৯ জুনের ভাষণে বলেন,'লেবাননে হামলা চালানোর জন্য ইসরায়েল সাইপ্রাসের বিমানবন্দর ও ঘাঁটি ব্যবহার করলে সাইপ্রাসকে 'যুদ্ধের অংশ' হিসেবে বিবেচনা করা হবে।'
তিনি বলেন, 'সাইপ্রাস সরকারের সতর্ক হওয়া উচিত।'
অনেকের কাছেই এই হুমকি একটি বড়সড় ধাক্কা।
নাসরুল্লাহর মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সাইপ্রাসের প্রেসিডেন্ট নিকোস ক্রিস্টোদৌলাইদেস সাংবাদিকদের বলেন, 'সামরিক সংঘাতে সাইপ্রাস কোনোভাবেই জড়িত নয়।'
রাজধানী নিকোসিয়ার বাসিন্দা এক আইনজীবী অ্যাঞ্জেলিনা প্লিয়াকা বলেন, 'আমি এর কোনো কারণ (হিজবুল্লাহর হুমকির) বুঝতে পারছি না। আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই এবং আমরা ইসরায়েলকে সমর্থন করি না।'
সাইপ্রাসের অবস্থান
গাজায় ইসরায়েলের আট মাসের বিধ্বংসী যুদ্ধে ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা আরও ঘনিয়ে এসেছে। কারণ হিজবুল্লাহ এর আগেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামলা-পাল্টা হামলা চালিয়েছে।
বিশ্লেষকরা দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে আসছেন যে, ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধ এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ ও ক্রীড়ানকদের টেনে আনতে পারে।
৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উত্তেজনা বাড়লেও, হিজবুল্লাহ এর আগে সাইপ্রাসকে সরাসরি হুমকি দেয়নি। ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে সাইপ্রাসের। তবে গাজায় ত্রাণ সরবরাহের জন্য একটি স্টেজিং পোস্ট হিসেবেও কাজ করেছে দেশটি।
নাসরুল্লাহর হুমকির ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে নিকোসিয়াও যে হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লার মধ্যে আছে এ বিষয়টি স্পষ্ট বোঝা গেছে।
সাইপ্রাস আগে থেকেই আশেপাশের বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আসা অভিবাসী অনুপ্রবেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন।
পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট অসলো (পিআরআইও) সাইপ্রাস সেন্টারের পরিচালক হ্যারি জিমিত্রাস আল জাজিরাকে বলেছেন, হিজবুল্লাহর হুমকি 'সাইপ্রাসের জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে দেশটি কোথায় অবস্থিত এবং কত সহজেই পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হতে পারে।'
দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে পূর্বাঞ্চলীয় রাষ্ট্র এবং লেবাননের উপকূল থেকে মাত্র ১৬০ কিলোমিটার (১০০ মাইল) দূরে অবস্থিত।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটি মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে ইইউর সেতু হিসেবে ভূমিকা পালনের চেষ্টা করছে। একদিকে ইরানের সঙ্গে যোগাযোগের চ্যানেলগুলো বজায় রেখেছে, অন্যদিকে দেশটি ইসরায়েল ও মিশরের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
তিজিমিত্রাস বলেন, '২০১০-১১ সাল থেকে সাইপ্রাস ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'বিশেষত নেতানিয়াহু সরকার সাইপ্রাসকে রাজনৈতিক, আর্থিক, জ্বালানি এবং সামরিক দিক থেকে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে প্রকাশ করেছে এবং ইইউ'র সঙ্গে নিজেদের (ইসরায়েল) সম্পর্ক উন্নয়নে এই মিত্রতাকে কাজে লাগিয়েছে।'
এই সম্পর্ক সত্ত্বেও, সাইপ্রাস গাজা এবং ইসরায়েল-লেবানন সীমান্তের সংঘাত থেকে তার দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করেছে।
ক্রিস্টোডৌলাইডস মানবিক করিডোরের বিষয়ে ইঙ্গিত করে বলেছেন, 'আমাদের দেশ কোনোভাবেই সংঘাতে জড়িত নয় এবং সমস্যার অংশ নয়।'
ইইউভুক্ত একটি দেশ হুমকির মুখে
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট এবং সাইপ্রাস ও পূর্ব ভূমধ্যসাগর বিশেষজ্ঞ জেমস কের-লিন্ডসে বলেন, সাইপ্রাস সরকার 'সতর্ক হয়ে গেছে'।
তিনি বলেন, হিজবুল্লাহ ইইউভুক্ত একটি দেশের বিরুদ্ধে হুমকি দিচ্ছে। কীভাবে এর জবাব দেওয়া হবে তা নিয়ে ইউরোপে আলোচনা হবে এবং ইরানকে এটি বন্ধ করার আহ্বান জানানো হবে।
১৯ জুনের ভাষণে নাসরুল্লাহ দুই বছর আগে সাইপ্রাসে ইসরায়েলি বাহিনীর লেবাননে আগ্রাসন চালানোর অনুকরণে চালানো আগ্রাসী সামরিক মহড়ার কথা উল্লেখ করেছেন।
রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের (আরইউএসআই) স্থল যুদ্ধ বিষয়ক সিনিয়র রিসার্চ ফেলো জ্যাক ওয়াটলিং বলেন, হিজবুল্লাহর হুমকি মূলত সাইপ্রাসে ব্রিটিশ ঘাঁটিকে লক্ষ্যবস্তু করার ব্যাপারে 'সবচেয়ে বড় ইঙ্গিত'।
১৯৬০ সাল পর্যন্ত সাইপ্রাস ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল এবং দেশটি স্বাধীনতা লাভের পরেও সেখানে যুক্তরাজ্যের দুটি বিশাল সামরিক ঘাঁটি রয়ে গেছে।
২০০৬ সালে হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধের সময় লেবানন থেকে ব্রিটিশ নাগরিকদের দেশত্যাগে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
এছাড়া যুক্তরাজ্যের বিমান বাহিনী ২০০৩ সালে ইরাক এবং ২০১১ সালে লিবিয়া আক্রমণে এবং ২০১৪ সালে ইরাকে আইএসআইএল (আইএসআইএস)-এর বিরুদ্ধে বিমান হামলায় আরএএফ আক্রোতিরি ঘাঁটি ব্যবহার করেছিল।
জানুয়ারিতে আরএএফ ইয়েমেনের হুথিদের বিরুদ্ধে হামলা চালানোর জন্য ঘাঁটিটি ব্যবহার করেছিল। যাতে হুথিরা ইসরায়েল-সংশ্লিষ্ট মনে করা জাহাজগুলোতে হামলা চালোনো থেকে বিরত থাকে।
অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম ডিক্লাসিফায়েড ইউকে গত মে মাসে জানিয়েছিল, অক্টোবরে গাজায় বোমা হামলা শুরু করার পর থেকে ব্রিটেনের সামরিক বাহিনী ইসরায়েলে ৬০টি ফ্লাইট পাঠিয়েছে, যার বেশিরভাগই আক্রোতিরি থেকে।
লন্ডনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ওই বিমানগুলো কী বহন করছিল তা প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
ডিক্লাসিফাইড যুক্তরাজ্য আরও বলেছে, ঘাঁটিটি যুক্তরাষ্ট্র গোপনে ইসরাইলে অস্ত্র পাচারের জন্য ব্যবহার করছিল।
এছাড়া, গাজায় বোমা হামলার জন্য তাদের সাইপ্রাসের ঘাঁটিগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে কি না বা ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান সেখানে অবতরণ করেছে কি না সে বিষয়েও ব্রিটিশ সরকার কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
তবে ওয়াটলিং বলেন, হিজবুল্লাহর জন্য যুক্তরাজ্যের ঘাঁটিগুলো সাইপ্রাস থাকা সবচেয়ে বড় কৌশলগত হুমকি।
তিনি বলেন, 'আমি (নাসরুল্লাহর বক্তব্য শুনে) মনে করি, হিজবুল্লাহ ইসরায়েলকে উত্তেজনা না বাড়াতে চাপ দিতে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রকে আহ্বান জানানোর চেষ্টা করছে।
যেহেতু হিজবুল্লাহর কাছে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, তাই বলতেই হবে এটি একটি উল্লেখযোগ্য হুমকি।
শরণার্থী সংকট
এটাই সাইপ্রাসের একমাত্র ভূ-রাজনৈতিক মাথাব্যথা নয়।
ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে সাইপ্রাস রাশিয়ার সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ক নষ্ট করেছে এবং পশ্চিমাদের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান জানিয়েছে।
তবে সামরিক হামলার হুমকি ছাড়াও হিজবুল্লাহ সাইপ্রাসকে ভিন্নভাবে চাপে ফেলতে পারে।
নৌপথে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে সাইপ্রাসের দূরত্ব মাত্র কয়েক ঘণ্টার। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মধ্যে জনসংখ্যার অনুপাতে সবচেয়ে বেশি শরণার্থী রয়েছে দেশটিতে।
গত মে মাসে নাসরুল্লাহ লেবানন সরকারকে 'সমুদ্রপথ উন্মুক্ত করার' আহ্বান জানিয়েছিলেন, যাতে সিরীয়রা সাইপ্রাসে প্রবেশ করতে পারে।
তিজিমিত্রাস বলেছেন, 'লেবাননে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেলে লেবাননের অভিবাসীদের ঢেউ সামলানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল সাইপ্রাস। এর আগেও দুইবার লেবানন থেকে বিপুল অভিবাসীর ঢেউ দেশটিতে আছড়ে পড়েছে।'
তিনি বলেন, 'বর্তমানে যে অবস্থা, তাতে অতীতের মতো যদি ফের বিপুল অভিবাসী সাইপ্রাসে আসে, তবে তা নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত কঠিন হবে।'
নিকোসিয়াভিত্তিক আইনজীবী নিকোলেত্তা জর্জিয়াদো-ও এ কথায় সুর মিলিয়ে বলেছেন, সাইপ্রিয়টরা তাদের দেশে সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধির চেয়ে শরণার্থীর ঢেউ নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন।
তিনি বলেন, 'যদি এই হুমকি বাস্তবে পরিণত হয় তবে এটি যুদ্ধের মাধ্যমে হবে না, এটি হবে সাইপ্রাসকে সিরিয়ান ও লেবাননের শরণার্থীতে ভরিয়ে তোলার মাধ্যমে।'
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি