যুক্তরাজ্যে চলমান সাধারণ নির্বাচন সম্পর্কে যা জানা প্রয়োজন
যুক্তরাজ্যে আজ (৪ জুলাই) চলেছে সাধারণ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। প্রত্যাশিত সময়ের আগেই অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এই নির্বাচনের ফল কী হতে পারে তা নিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা। নানা জরিপ ও অনুমানও দেখা যাচ্ছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে।
ধারণা করা হচ্ছে যে, আগামী অক্টোবর নাগাদ ভোট অনুষ্ঠিত হবে। তবে এর আগেই নির্বাচনের ঘোষণা দেন ঋষি সুনাক। এক্ষেত্রে নানা কারণে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচন।
যা জানা প্রয়োজন
যুক্তরাজ্যে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ হয় পাঁচ বছরের। গতবার, অর্থাৎ ২০১৯ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল কনজারভেটিভ পার্টি। নিয়ম মাফিক পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন ২০২৫ সালের জানুয়ারির মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল।
যুক্তরাজ্য ৬৫০টি নির্বাচনি কেন্দ্র বা এলাকায় বিভক্ত। এই প্রত্যেক নির্বাচনি এলাকার ভোটাররা একজন সাংসদ নির্বাচন করেন। যারা তাদের হয়ে 'হাউস অফ কমন্স'-এ প্রতিনিধিত্ব করেন।
নির্বাচনি ময়দানে লড়াই করতে নামা প্রার্থীদের মধ্যে অধিকাংশ কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি। তবে কেউ কেউ আবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবেও ভোটে লড়েন।
সময়ের আগেই কেন নির্বাচন?
জনমত জরিপ অনুযায়ী, ২০২১ সাল থেকে ঋষি সুনাকের কনজারভেটিভ পার্টির জনপ্রিয়তা কমছে।
বিবিসির পলিটিক্যাল এডিটর ক্রিস ম্যাসন বলছেন, "দলের কিছু রাজনীতিবিদ মনে করেন, পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হবে না। ভোটারদের মত প্রকাশের যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তাতে নির্বাচন পিছিয়ে দিলে কনজারভেটিভ পার্টির পরাজয় আরও খারাপভাবে হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এক কথায় বলতে গেলে পরিস্থিতি এমন যে, যা করার (নির্বাচন) তা এখনই করতে হবে। নয়তো অবস্থা আরও বিরূপ হতে পারে।"
কেন এখন ভোট হওয়ার বিষয়ে উদ্যোগী ঋষি সুনাক, সে প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় তুলে ধরেছেন ক্রিস ম্যাসন। তার কথায়, "এখন প্রধানমন্ত্রী অবশ্য দেখাতে পারবেন তার কোনও একটা উদ্দেশ্য অন্তত পূরণ হয়েছে বা আপাতদৃষ্টিতে সেটা হওয়ার পথে।"
ক্রিস বলেন, "মুদ্রাস্ফীতির নিরিখে বর্তমান অবস্থাকে তার (ঋষি সুনাকের) সাফল্য হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। তবে এটা যে সরকারের কর্মকাণ্ডের উপর নির্ভর করে এমনটা নয়। কিন্তু সাধারণত মুদ্রাস্ফীতি আকাশছোঁয়া হলে সরকারকেই দোষারোপ করা হয়ে থাকে। তাই আশা করা যেতে পারে যে যখন মুদ্রাস্ফীতির হার কমের দিকে তখন সেই সফলতার ভাগ নেওয়ার চেষ্টা তারা (কনজারভেটিভ পার্টি) করবে। এবং তা কিন্তু ইতিমধ্যে হয়েছেও। বৃহত্তর অর্থনৈতিক চিত্রটাও কিছুটা উজ্জ্বল বলে মনে হচ্ছে।"
কোন দলের অবস্থান কেমন?
সাম্প্রতিক জনমত জরিপ বলছে নির্বাচনি প্রচারের শুরু থেকেই সুনাকের কনজারভেটিভ পার্টি তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী লেবার পার্টির থেকে বেশ খানিকটা পিছিয়ে। আসলে ছবিটা কিন্তু গত ১২ মাস ধরে প্রায় একই ছিল। জরিপ অনুযায়ী, লেবার পার্টি ধারাবাহিকভাবে ৪০ শতাংশের উপরে এর উপরে জনসমর্থন পেয়ে এসেছে।
এখন এমনটা হতেই পারে যে, জনমত জরিপ সঠিক নয়। ঋষি সুনাকও আশা করবেন নির্বাচনি প্রচার এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতায় থাকাকালীন তার সাম্প্রতিক সাফল্য এবং দলের বিষয়ক সিদ্ধান্ত কনজারভেটিভ পার্টির পক্ষে খেলা ঘুরিয়ে দিতে পারবে। মুদ্রাস্ফীতির হার হ্রাস ও তার দলের নীতির উপর মনোনিবেশের মতো ইস্যু নির্বাচনি ময়দানে প্রভাব ফেলবে বলে তিনি আশাবাদী।
জরিপ অনুযায়ী, এখনও পর্যন্ত অভিবাসন বিরোধী ডানপন্থী দল রিফর্ম ইউকে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। কিন্তু তাদের সমর্থন সারা দেশে সমানভাবে ছড়িয়ে রয়েছে। ফলে সেই সমর্থনকে সংসদের আসনে পরিণত করা কঠিন হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, লিবারেল ডেমোক্র্যাটস - যারা আগে দেশের তৃতীয় বৃহত্তম দল ছিল তারা জরিপ অনুযায়ী ভোটের নিরিখে গড়ে প্রায় ১০ শতাংশে মোটামুটি ধারাবাহিকভাবে রয়েছে। তাদের টার্গেট করা আসনে মনোনিবেশ করে আসন্ন নির্বাচনে ভাল ফলের বিষয়ে আশাবাদী লিবারেল ডেমোক্র্যাটস।
ঋষি সুনাকের 'রোয়ান্ডা নীতি'র ভবিষ্যৎ কী?
যুক্তরাজ্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই কিছু আশ্রয়প্রার্থীদের রোয়ান্ডায় পাঠিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ঋষি সুনাক। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে এই নীতিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন তিনি।
সুনাকের যুক্তি ছিল, এই নীতি বাস্তবায়িত হলে তা ছোট ছোট নৌকায় চেপে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে যুক্তরাজ্যে ঢুকে পড়ার ঘটনাকে ঠেকাবে। কিন্তু প্রত্যাশিত সময়ের আগেই সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করার পর সুনাক জানিয়েছিলেন যে, যদি তিনি পুনর্নির্বাচিত হন তাহলে শুরু হবে এই প্রকল্প।
এদিকে, লেবার পার্টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে তারা ক্ষমতায় এলে এই পরিকল্পনা বাতিল করা হবে। এর ফলে প্রশ্ন উঠেছে আদৌ কাউকে রোয়ান্ডায় পাঠানো হবে কি-না।
ইতোমধ্যে 'রোয়ান্ডা নীতি'র পিছনে ২৪ কোটি পাউন্ড (৩০ কোটি ৫০ লাখ ডলার) ব্যয় করা হয়েছে। ছয় সপ্তাহের নির্বাচনি প্রচারে এই নীতিকে ঘিরে যুক্তরাজ্যের দুটো প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যে বিভাজন রেখা বেশ স্পষ্ট।
নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী কারা?
বর্তমানে যে দুই দল সবচেয়ে বেশি ভোট পেতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে তারা হলো ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি ও লেবার পার্টি।
৪৪ বছর বয়সি ঋষি সুনাক কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ২০২২ সালে যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী হন তখন তার বয়স ছিল ৪২। আধুনিক সময়ে ব্রিটেনের সবচেয়ে কম বয়সের প্রধানমন্ত্রী সুনাক। শুধু তাই নয়, তার হাত ধরেই এই প্রথমবার কোনও ব্রিটিশ-ভারতীয় ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।
অন্যদিকে, লেবার পার্টির নেতৃত্বে রয়েছেন স্যার কিয়ের স্টারমার। তার বয়স ৬১ বছর। ২০২০ সালে জেরেমি করবিনের পর দলের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নির্বাচিত হন তিনি। এর আগে 'ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিস'-এর প্রধান ছিলেন মি. স্টারমার। পাবলিক প্রসিকিউশনের পরিচালক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
নির্বাচনের আগে সংসদের চিত্র
নির্বাচনের আগে সংসদ 'ডিসলভ' করার বা 'ভেঙে দেওয়ার' জন্য রাজাকে আনুষ্ঠানিকভাবে আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী সুনাক। সে অনুযায়ী সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে পদমর্যাদা হারিয়েছেন সাংসদরা।
ভোটের ফল ঘোষণার পর যা হবে
ভোট গণনার পর যে দলের কাছে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সাংসদ রয়েছে সেই দলের নেতাকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার এবং সরকার গঠন করার জন্য আহ্বান জানান রাজা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাংসদ থাকা দলের নেতাই হন সংসদে বিরোধী দলনেতা।
যদি কোনও দলই সাংসদের নিরিখে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায় তাহলে সেই দল নিজেদের সাংসদদের উপর নির্ভর করে আইন পাশ করতে পারে না। এর ফলে 'হাং পার্লামেন্ট' বা ত্রিশঙ্কু অবস্থার সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতিতে বৃহত্তম দল সিদ্ধান্ত নিতে পারে অন্য দলের সঙ্গে মিলে জোট সরকার গঠনের। অথবা সংখ্যালঘু সরকার হিসাবে কাজ করতে পারে। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতে কোনও আইন পাশ করার সময় তাদের অন্য দলের ভোটের উপর নির্ভর করে থাকতে হবে।