সুনাকের মহা বাজি কনজারভেটিভ দলের ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ পরাজয় দিয়ে শেষ হলো
আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাজ্যে ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়েছে বামপন্থী দল লেবার পার্টি। এরইসঙ্গে ব্রিটেনের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন লেবার নেতা কিয়ার স্টারমার। এর মধ্যে দিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের দল কনজারভেটিভ পার্টির দীর্ঘ ১৪ বছরের শাসনক্ষমতার ইতি হতে যাচ্ছে।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে গত মে মাসের শেষের দিকে আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন সুনাক। দেশটিতে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও সুনাক চলতি বছরের ৪ জুলাই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন।
সুনাকের এ সিদ্ধান্তে দ্বিমত জানিয়েছিলেন তারই নির্বাচনী প্রচার ক্যাম্পেইনের প্রধান। নির্বাচনে সুনাকের জন্য কি ফল অপেক্ষা করছে, সে বিষয়ে হয়তো তখন তিনি খুব কমই আঁচ করতে পেরেছিলেন।
সুনাক এ নির্বাচন নিয়ে বেশ বড় ধরনের বাজিই ধরেছিলেন বলা চলে। তিনি আশা করেছিলেন, তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী লেবার পার্টির স্টারমারকে ঠিকই পরাজিত করতে পারবেন। তবে হয়েছে এর উল্টো। লেবার পার্টির কাছে ধরাশায়ী হয়েছে কনজারভেটিভ পাটির। এমনকি দলটির এই পরাজয়কে ইতিহাসের সবচেয়ে শোচনীয় বলেও বর্ণনা করা হচ্ছে।
পরাজয় মেনে নিয়ে শুক্রবার স্থানীয় সময় ভোর ৫টার দিকে সুনাক বলেন, 'আমি দুঃখিত। ব্রিটিশ জনগগণ সুস্পষ্ট রায় দিয়েছেন। এ পরাজয়ের দায় আমার।'
নির্বাচনে এমন পরাজয়ের কারণে কনজারভেটিভ নেতারা একে-অপরকে দোষারোপ করছেন। অবশ্য দোষারোপ করার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। কনজারভেটিভ পার্টির দীর্ঘ ১৪ বছরের শাসনক্ষমতার ইতি হচ্ছে যেন হঠাৎ করেই। যা দলটির নেতারা খুব সহজে মেনে নিতে পারছেন না। তাদের অনেকের মনেই এখন এ আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে হয়ত এ পরাজয় তাদের এক প্রজন্ম ক্ষমতার বাইরে রাখবে।
একদিকে ব্রেক্সিটপন্থী আলোচিত নেতা নাইজেল ফারাজের কট্টর ডানপন্থী দল রিফর্ম ইউকে এর উল্লেখজনক সাফল্য, অন্যদিকে কেন্দ্রে স্টারমারের আধিপত্য ৩০০ বছরের পুরনো এই রাজনৈতিক দলটির ভবিষ্যৎকে আবারও প্রশ্নের মধ্যে ফেলেছে।
কনজারভেটিভ দলের এমন হতাশাজনক ফলাফলের বিষয়ে দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারা একেক রকমের মতামত জানিয়েছেন। তবে তারা একটি বিষয়ে একমত। সেটি হলো- তারা নির্বাচনের জন্য সুনাকের নেওয়া কৌশলকে বিপর্যয় হিসেবে দেখছেন।
তিনজন মন্ত্রিপরিষদ সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্লুমবার্গকে জানিয়েছেন যে কনজারভেটিভদের জন্য এটি এ পর্যন্ত প্রত্যক্ষ করা সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি।
নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর মন্ত্রিপরিষদের সদস্য পেনি মরডান্ট বলেছেন, 'কনজারভেটিভ পার্টি বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। কারণ, দলটি জনগণের আস্থা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।'
সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী গ্র্যান্ট শ্যাপস বলেছেন, 'ব্যক্তিগতভাবে আমাদের নিজেদের মতপার্থক্য দূর করতে না পারায় ভোটাররা হতাশ হয়েছেন।'
গত ৬ জুন ডি-ডে'র ৮০তম বার্ষিকী উপলক্ষে ফ্রান্সে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন সুনাক। কিন্তু এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারের জন্য অনুষ্ঠান শেষ না করেই তিনি দেশে ফেরেন। এতে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। এজন্য অবশ্য পরে তিনি সবার কাছে ক্ষমাও চান। তবে তার এ কর্মকাণ্ডে দেশপ্রেমিক ভোটারদের মনে তার প্রতি ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
উল্লেখ্য, ১৯৪৪ সালের ৬ই জুন নাৎসী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে যৌথ বাহিনীর প্রায় এক লক্ষ ৫৬ হাজার সদস্য ফ্রান্সে অবতরণ করেন। ফ্রান্সের নরম্যান্ডির উপকূলে ডি-ডে নামে খ্যাত ওই অভিযানের মধ্যে দিয়ে নাৎসী জার্মানির বিরুদ্ধে মিত্রবাহিনীর বিজয়ের সূচনা হয়।
সুনাকের এই পদক্ষেপকে ভোটাররা যে ভালোভাবে নেননি, সেটি নির্বাচনের ফলাফলেই স্পষ্ট। সুনাকের এক সহযোগী এ বিষয়ে বলেন, এটি সবচেয়ে খারাপ ভুল ছিল। যেটি শোধরানোর কোনো সুযোগ নেই।
আরেকজন বলেছিলেন, সুনাককে তখন বেশ হতাশাগ্রস্ত দেখাচ্ছিল। তারা এটাও ভেবেছিলেন যে সুনাক এ কারণে আবার পদত্যাগই করেন কি না।
এই ধাক্কার পরও সুনাক নির্বাচনে লড়াই চালিয়ে যেতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। তবে পরবর্তী সময়ে তিনি আরও খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হন।
সে সময় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, সুনাক নিজে থেকে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আগেই তার পার্লামেন্টারি সহযোগী, নির্বাচনী প্রচারণার জ্যেষ্ঠ সদস্য এবং তার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক পুলিশ কর্মকর্তাসহ ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা নির্বাচনের তারিখের কথা জানিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো- সুনাকের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য তারা ব্যক্তিগত লাভের জন্য ব্যবহার করেছেন। তবে সুনাক অভিযোগটি অস্বীকার করেননি।
সুনাকের দলের এক সদস্য জানান, কনজারভেটিভদের ওপর ভোটারদের ক্ষোভের আরেকটি কারণ এটি। এছাড়াও 'পার্টিগেট কেলেঙ্কারি'র জেরে আগে থেকেই কনজারভেটিভ দলের ওপর আক্রোশ জন্মেছিল ব্রিটিশ জনগণের। এর পর সুনাকের ঘনিষ্ঠজনদের এ কর্মকাণ্ড যেন কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়ার মতো।
পার্টিগেট কেলেঙ্কারির জেরে প্রথমে প্রধানমন্ত্রী ও পরে এমপি পদ থেকেও সরে দাঁড়িয়েছিলেন বরিস জনসন।
উল্লেখ্য, করোনা রুখতে দীর্ঘ দুই বছর লকডাউন বিধি জারি ছিল গোটা ব্রিটেনে। কিন্তু সেই লকডাউন চলাকালীনই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে অজস্র পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে। যার মধ্যে অন্তত তিনটিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বরিস নিজে উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গিয়েছিল। কয়েক মাস আগে কয়েকটি প্রথম সারির ব্রিটিশ দৈনিকে জনসনের পার্টিতে উপস্থিত থাকার ছবিও ফাঁস হয়।
এদিকে কনজারভেটিভ দলের কয়েকজন সদস্য মনে করেন, সনাকের নেওয়া কৌশল কাজে আসেনি। তাদের যুক্তি হলো- প্রচারণার শেষ দিনগুলোতে এসে সুনাক ট্যাক্স-কাটিং সংক্রান্ত বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তবে তিনি এটি করতে খুব দেরি করে ফেলেছেন। যে কারণে তিনি ভোটারদের যথেষ্ট প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে লেবার পার্টির অনেক নেতাই প্রচারণায় ট্যাক্স-কাটিংয়ের বিষয়টি সঠিকভাবে কাজে লাগিয়েছেন।
সুনাকের মিত্ররা বলছেন, নির্বাচনী ক্যাম্পেইনের চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ২০২২ সালে দলের মধ্যে যে অশান্তি তৈরি হয়েছিল, তার জন্য এবারের নির্বাচনে জেতা একটি কঠিন প্রশ্ন ছিল বলা চলে। সে সময় দলটি নানা অভ্যন্তরীণ কোন্দলের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। এমনকি পাঁচ মাসের মধ্যে তিনবার প্রধানমন্ত্রী পদে পরিবর্তন হয়েছিল।
বরিস জনসনকে ঘিরে বিতর্ক, তারপর লিজ ট্রাসের নেওয়া আর্থিক পরিকল্পনা সংক্রান্ত বিষয়গুলো ঘিরেই কনজারভেটিভ দলের ওপর থেকে জনগণের আস্থা হারাতে থাকে।
উল্লেখ্য, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের পদত্যাগের পর কনজারভেটিভ পার্টির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসেন লিজ ট্রাস। তার মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রীর উপস্থাপন করা খসড়া আর্থিক পরিকল্পনায় পুঁজিবাজারে ধস নামে। বিনিয়োগকারীরা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। এরই জেরে মাত্র ৪৯ দিনের মাথায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হন লিজ।
অনুবাদ (সংক্ষেপিত): রেদওয়ানুল হক