গরম এখন মানুষের সহ্যের বাইরে, তীব্র গরম যেভাবে বিপদ ঘটায়
২০২১ সালের ১০ জুলাই, ৩৭ বছর বয়সি আল্ট্রা-ম্যারাথন রানার ফিলিপ ক্রেসিক আট মাইলের ট্রেইল রান করতে ক্যালিফোর্নিয়ার প্লিজ্যান্টন রিজ রিজিওনাল পার্কে আসেন।
গ্রীষ্মের সুন্দর সকালে তাপমাত্রা তখনও ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গাড়িতে নিজের ফোন আর পানির বোতল রেখে দৌড় শুরু করেন ফিলিপ।
বেশ জোরেশোরেই শুরুটা করেছিলেন, প্রতি ৬ মিনিটে অতিক্রম করছিলেন প্রায় ৫ মাইল দূরত্ব। কিন্তু পরিস্থিতি ধীরে ধীরে খারাপে মোড় নেয়, তাপমাত্রা পৌঁছায় ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
ক্রেসিকের স্মার্টওয়াচ ও এর সাথে যুক্ত বিশেষ রানিং অ্যাপের জিপিএস ডেটা থেকে জানা যায়, তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে গতি কমতে থাকে তার, ট্রেইল ট্র্যাক থেকে সরে অনিয়মিতভাবে দৌড়াতে থাকেন তিনি।
মধ্যাহ্নভোজের জন্য স্বামী ঘরে ফেরত না আসায় পুলিশকে খবর দেন তার স্ত্রী। তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় পরে, ক্রেসিকের মৃতদেহ পাওয়া যায়। ময়নাতদন্তে আঘাতজনিত আঘাতের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি; পুলিশ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে তিনি সম্ভবত তাপজনিত অসুস্থতায় মারা গেছেন।
এটা শুধু ক্রেসিকের গল্প নয়। প্রচণ্ড গরমে দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে গিয়ে অনেক মানুষই এভাবে মৃত্যুবরণ করছেন। দুপুরের ঘোরাঘুরি, পরিবার নিয়ে ভ্রমণ, আউটডোর কনসার্ট, এমনকি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা না থাকায় ঘরের ভেতরেও মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, দেশটিতে প্রায় ২৪,৮৪৯টি হিট স্ট্রোকের ঘটনা ঘটেছে এবং ১ মার্চ থেকে ২০ মে পর্যন্ত অন্তত ৫৬ জন হিট স্ট্রোকে মৃত্যুবরণ করেছেন। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বছরের শুরুর তাপপ্রবাহের সময় দেশব্যাপী আনুমানিক ৩৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
এছাড়া, চলতি বছরের জুনে হজ চলাকালে মক্কায় তাপমাত্রা ১২০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের ওপরে উঠে যাওয়ায় প্রায় ১ হাজার ৩০০ মানুষের মৃত্যু ঘটে।
তাপপ্রবাহ হলো চরম আবহাওয়ার সবচেয়ে মারাত্মক ধরণ। মানবসৃষ্ট জলবায়ু সংকট বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বাড়িয়ে তুলছে এবং এর প্রভাব দীর্ঘায়িত করে তুলছে।
গত জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের ডেথ ভ্যালিতে ৫৩.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপাঙ্কের রেকর্ড হয়। একইদিনে, চীনের ডেথ ভ্যালি বা মৃত্যু উপত্যকা-খ্যাত জিনজিয়াং প্রদেশের টার্পান ডিপ্রেশন অঞ্চলে তাপমাত্রা পৌঁছায় ৫২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে।
অধিক তাপমাত্রা ও উচ্চ আর্দ্রতার কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতি এখন মানুষের সহ্য সীমার বাইরে, আমাদের দেহ খাপ খাইয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছে।
হিট চেম্বারের ভেতরে
দৌড়বিদ ফিলিপ ক্রিসিক ছিলেন তরুণ, অত্যন্ত ফিট এবং অভিজ্ঞ। যারা শারীরিকভাবে বেশি ফিট তারা ঝুঁকিতে কম থাকলেও কেউই এর ঊর্ধ্বে নন, এমনকি বিশ্বের শীর্ষ ক্রীড়াবিদরাও না। অলিম্পিক গেমস শুরু হওয়ার সাথে সাথে প্যারিসে এই সপ্তাহে তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ায় অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।
বিজ্ঞানীরা এখনও বোঝার চেষ্টা করছেন যে তাপ কীভাবে শরীরকে প্রভাবিত করে। এর একটি পদ্ধতি হলো কৃত্রিম চেম্বার ব্যবহার করা: কক্ষগুলোতে যেখানে তারা বিভিন্ন তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার মাত্রায় মানুষের প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা করে। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে তাপ কীভাবে শরীরকে প্রভাবিত করে তা দেখতে যুক্তরাজ্যের সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি চেম্বার পরিদর্শন করেছে সিএনএন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিওলজি এবং বায়োকেমিস্ট্রির অধ্যাপক ড্যামিয়ান বেইলি বলেন, 'আমরা ধীরে ধীরে তাপমাত্রা বাড়াতে থাকব এবং এর প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করব।
বিশ্রাম কিংবা হালকা অনুশীলনের মধ্যে হার্ট রেট, মস্তিষ্কের রক্ত প্রবাহ এবং ত্বকের তাপমাত্রার মতো গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণগুলো বিভিন্ন যন্ত্রের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করেন বেইলি।
চেম্বারের তাপমাত্রা ২৩ থেকে ৪০ ডিগ্রিতে উন্নীত করা হয়, আর কক্ষের আর্দ্রতা ৮৫ শতাংশে। বেইলি জানান, মৃত্যুর মূল কারণ এই অতিরিক্ত আর্দ্রতা, যার সাথে মানুষ সহজে মানিয়ে নিতে পারে না।
ঘাম যেভাবে শরীর ঠাণ্ডা রাখে
ঘাম শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি। গরমে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে তা স্বাভাবিক রাখতে ঘাম হয়। আমাদের চামড়ার লাখ লাখ ছিদ্রপথ দিয়ে এই ঘাম শরীরের বাইরে বের হয়ে আসে।
ঘাম বাষ্পীভূত হওয়ার সাথে সাথে বাতাসে তাপ স্থানান্তর করে ত্বককে শীতল করে। তবে, খুব গরম এবং আর্দ্র অবস্থায় এই প্রক্রিয়াটি ভালোভাবে কাজ করে না।
অত্যধিক ঘাম পানিশূন্যতা সৃষ্টি করে। অনেক সময় মস্তিষ্ক সংকেত দিতে পারে না শরীরের জন্য আরও পানির প্রয়োজন, যে কারণে তৃষ্ণা কম লাগে এবং শরীরে পানির ঘাটতিও থেকে যায়।
খুব আর্দ্র পরিস্থিতিতে, ঘাম আপনাকে কার্যকরভাবে শীতল করে না। যখন বায়ু খুব আর্দ্র থাকে, ঘাম ধীরে ধীরে বাষ্পীভূত হয় বা একেবারেই হয় না। এ কারণে শরীরের তাপমাত্রাও হ্রাস পায় না।
হৃদপিণ্ডের ওপর চাপ
হার্ভার্ড টিএইচ চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেলথের ইমার্জেন্সি ফিজিশিয়ান ড. ক্যাথারিনা গিউডিস বলেন, হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালীই প্রথম শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে কাজ করে।
তিনি জানান, দেহের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা স্থিতিশীল রাখতে হৃৎপিণ্ডকে আরও বেশি পরিশ্রম করতে হয়। শরীরের যেখানে অতিরিক্ত তাপ, সেখানে রক্ত ঠেলে দেয় তাপ কমাতে।
কিন্তু ঘাম ঝরার সাথে সাথে রক্তের পরিমাণও হ্রাস পায়। এজন্য রক্তচাপ বজায় রাখতে হার্টকে আরও জোরে রক্ত সঞ্চালন করতে হয়।
মস্তিষ্কে কী ঘটে
মস্তিষ্কের ছোট অংশ হাইপোথ্যালামাস, যা দেশের শীতলীকরণ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। এটি দেহের ঘাম ঝরানো এবং দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮.৬ ফারেনহাইট বা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস রাখতে রক্ত প্রবাহকে নির্দেশ দেয়। কিন্তু হাইপোথ্যালামাসের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে এই প্রক্রিয়াটি ব্যর্থ হয়।
প্রচণ্ড গরমে মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ কমে যায়, শ্বাস প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যায় এবং ঘাড় এবং মাথার খুলির রক্তনালিগুলো সংকুচিত হয়।
গরমে মস্তিষ্কের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন এবং গ্লুকোজ সরবরাহ হ্রাস পায়, যা মানুষের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করতে পারে, মানসিক স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে পারে এবং খারাপ সিদ্ধান্তের দিকে পরিচালিত করতে পারে।
অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির চিকিৎসক ও গবেষক ড. পোপ মোসলে বলেন, 'আপনি যদি গরমে অভ্যস্ত না হন, তাহলে আপনার মস্তিষ্ক দ্রুত আক্রান্ত হয় এবং ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যা আপনার জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
অতিরিক্ত গরম যেভাবে মৃত্যু ঘটায়
অতিরিক্ত গরম আবহাওয়ায় আমাদের শরীর প্রচুর পরিমাণে অভ্যন্তরীণ তাপ তৈরি করে। সাধারণত ত্বকের মাধ্যমে ঘাম এবং তাপ বিকিরণ করে আমরা নিজেদের ঠান্ডা রাখি। তবে বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে, যেমন প্রচণ্ড তাপ, উচ্চ আর্দ্রতা, বা প্রচণ্ড রোদে অতিরিক্ত পরিশ্রমের সময়, এ শীতল করার প্রক্রিয়া ব্যর্থ হতে পারে। যার ফলে হিট স্ট্রোক হয়।
হিটস্ট্রোকের প্রাথমিক লক্ষণগুলো হলো মাথা চক্কর দেওয়া, বমি বমি ভাব, শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়া কিংবা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। হিটস্ট্রোকে শরীর, ডিহাইড্রেটেড এবং নিজেকে শীতল করার ক্ষমতা হারাতে শুরু করে।
বেইলি বলেন, যখন আপনার শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের ওপরে উঠতে শুরু করে তখন ধীরে ধীরে আপনার মৃত্যুর সম্ভাবনা বাড়তে থাকে। আপনার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো কাজ করা বন্ধ করে দেয়। রক্তে টক্সিন বাড়তে থাকে এবং সবশেষে হার্ট ফেলিওর হয়।
ড. মোসলে বলেন, হিটস্ট্রোক শরীরের এটি একটি প্রদাহজনিত, মাল্টি-সিস্টেম ফেলিওর। দ্রুত চিকিৎসা না নিলে আপনার মৃত্যু ঘটাবে এটি। সুস্থ হয়ে উঠলেও প্রায় ৩০ শতাংশের মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন