গাজায় ৩ পিস আলুর দাম ৪০ ডলার!
গাজায় বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে খাদ্যের দাম ব্যাপক বেড়ে গেছে। সেখানে মানুষের কাছে ত্রাণ পাঠানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। অক্টোবর থেকে পরিবারগুলো ফলমূল বা সবজি খেতে পারেনি এবং ১০ জন শিশুর মধ্যে ৯ জনই অপুষ্টিতে ভুগছে। এই ছবিগুলোতে রক্ত বা ধ্বংসাবশেষ নেই, তবে এগুলো দুই মিলিয়ন মানুষের মানবিক বিপর্যয়ের বাস্তবতা তুলে ধরেছে।
১. উত্তর গাজার একটি বাজারে ২৫ আগস্ট ছবি তোলা এই তিনটি আলুর দাম ১৫০ শেকেল, যা প্রায় ৪০ ডলারের সমান। তবে সেগুলো পাওয়া গেলেই কেবল কেনা সম্ভব, কারণ বোমাবর্ষণ এবং ব্যাপক স্থানচ্যুতির কারণে অধিকাংশ খামার ও বাগান পরিত্যক্ত হয়ে গেছে এবং দুই মিলিয়নেরও বেশি মানুষের জন্য মানবিক সাহায্য এখনও খুবই অপ্রতুল। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে শুরু হওয়া যুদ্ধের আগে এই আলুর দাম ছিল প্রায় ২ শেকেল, যা ৫৪ সেন্টের সমান। ইন্টিগ্রেটেড ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) থেকে প্রাপ্ত সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গাজার মোট জনসংখ্যার ৯৬ শতাংশ মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। সর্বশেষ ফলাফলে দেখা গেছে, প্রায় ৪,৯৫,০০০ সংখ্যক মানুষ বিপর্যস্ত খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং গাজা দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে।
২. গাজার উত্তরাঞ্চলে তিনটি মরিচ ও দুইটি রসুনের দাম প্রায় ৫০ শেকেল, যা প্রায় ১৩.৫০ ডলারের সমান। এখানে দাম বিশেষভাবে বেশি, কারণ খুব কম পরিমাণে মানবিক সাহায্য পৌঁছায়। 'এক কেজি শসার দাম ১০০ ডলারে পৌঁছেছে। এমন দামে কেউ সবজি কিনতে পারে না। গাজার আল-মেজান সংস্থার সদস্য সামির জাকুত এই সংবাদপত্রকে জানান, ভাগ্যবানরা একটি শসা, একটি টমেটো, একটি পেঁয়াজ কিনতে পারেন।
৩. বর্তমানে গাজার উত্তরে এই ক্যানজাত পণ্যগুলির দাম প্রায় ১২০ শেকেল, যা প্রায় ৩২ ডলারের সমান। 'ক্যানজাত খাবারের গুণমান কিছুটা উন্নত হয়েছে। সামির জাকুত জানান, এসব ক্যানজাত খাবার প্রথমে শুধু মিশর থেকে আসত, এখন জর্ডান থেকেও আসে। কিন্তু একবছর বয়সী শিশুরা এ ক্যানজাত খাবার খেতে পারে না। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডাব্লিউএফপি) যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রথমবারের মতো উত্তর গাজায় তাদের রান্নাঘর গুলো থেকে গরম খাবার সরবরাহ করতে সক্ষম হয়েছে। এসব খাদ্যগুলোতে তাজা সবজি (আলু ও পেঁয়াজ) রয়েছে। তবে মানবাধিকার কর্মী এবং মিশনের উপর আক্রমণ প্রয়োজনীয় সাহায্যের প্রবাহ এবং বিতরণ কমে যাওয়ায় ঝুঁকি বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ- গাজায় কার্যক্রম চলমান থাকলেও, ২৮ আগস্ট এক কনভয়ের উপর আক্রমণের পর কর্মী চলাচল সাময়িকভাবে স্থগিত করতে হয়েছে ডাব্লিউএফপি'র।
৪. শিশুদের পাউডারের দুধ ও সিরিয়ালের কৌটার দাম প্রায় ১০০ শেকেল, যা প্রায় ২৭ ডলারের সমান। ইউনিসেফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গাজার ৯০ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে এবং তাদের 'বেঁচে থাকা, গ্রোথ ও শারীরিক উন্নয়ন'র জন্য এটি একটি গুরুতর হুমকি।
৫.এই চিড়া, চাল, ডাল, ফ্রিকেহ এবং বুলগুরের ব্যাগগুলির দাম প্রায় ১২০ শেকেল (৩২ ডলার)। এই খাদ্যগুলো ফিলিস্তিনি রান্নায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। ত্রাণের ট্রাকের মাধ্যমে গাজায় এগুলো সরবরাহ করা হয় এবং কিছু মানুষ এগুলো সংগ্রহ করার পর পুনরায় বিক্রি করেন। যদিও প্রয়োজনের তুলনায় এখনও অপ্রতুল, তারপরও তাজা ফলমূলের তুলনায় সবজি, শস্য এবং ক্যানজাত খাদ্য কিছুটা সহজে পাওয়া যায়। গাজায় এমন কিছু পরিবার রয়েছে যারা ১১ মাস ধরে একটি টমেটো, একটি আপেল বা একটি ডিম খেতে পারেনি। অপুষ্টির মাত্রা অনিশ্চিত অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছে।
৬. এই তিনটি পেয়ারার দাম প্রায় ১১ ডলার। জাকুত বলেন, "গাজায় পুনরায় চাষাবাদ শুরু করার জন্য কোন বীজ, সার বা ফসল বা প্রয়োজনীয় কাঁচামাল নেই।" এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পানি সমস্যা, যা খুবই অপ্রতুল। যে সামান্য পরিমাণ পানি আছে তা সেচের জন্য ব্যবহার করা যাচ্ছে না। মে মাসে ইসরায়েল রাফাহর মিশরের সঙ্গে গাজার সীমান্ত টার্মিনাল বন্ধ করে দেয়। এ সীমান্ত দিয়েই অধিকাংশ ত্রাণ গাজায় সরবরাহ হতো। এখন কেরেম শালোম নামে একটি নতুন ক্রসিং ব্যবহার করা হচ্ছে। ১ আগস্ট থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত ১,৭১৩ ট্রাক ত্রাণ গাজায় প্রবাহিত হয়েছে। এপ্রিল মাসে, এ সংখ্যা ৫,০০০ এর বেশি ছিল। জাকুত প্রশ্ন করেন, "ইসরায়েলি হামলার অনেক দিক রয়েছে, কিন্তু সেগুলোর সবই মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। কেন ট্রাকগুলো উত্তর দিকে যেতে দেয়া হচ্ছে না?"
৭. উত্তর গাজায় দুটি ডিম কেনার জন্য প্রায় ২৪ শেকেল বা প্রায় ৬.৫০ ডলার প্রয়োজন হয়। আইপিসি রিপোর্ট অনুসারে, খাবার কেনার জন্য গাজার অর্ধেকেরও বেশি পরিবারের সদস্যরা পোশাক বিক্রি করে এবং বাকি এক তৃতীয়াংশ মানুষ বর্জ্য সংগ্রহ ও বিক্রি করে। সংস্থার বিশেষজ্ঞদের কাছে সাক্ষাৎকার দেওয়া ২০ শতাংশ মানুষ বলেছেন, তারা পুরো দিন এবং রাত খাবার ছাড়াই কাটায়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) অনুযায়ী, গাজার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ পশু যুদ্ধের কারণে মারা গেছে এবং কমপক্ষে ৬৫ শতাংশ আবাদি জমি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
৮. একটি পাউডার দুধের ব্যাগ এবং এক কিলোগ্রাম চিনি কেনার জন্য প্রায় ৩০০ শেকেল বা ৮১ ডলার খরচ করতে হয়। এই মুহূর্তে গাজায় এমন পণ্য কিনতে সক্ষম মানুষের সংখ্যা কম। ২০০৭ সালে ফিলিস্তিনি ইসলামিস্ট গ্রুপ হামাস ক্ষমতা দখল করার পর থেকে গাজা ইসরায়েলি অবরোধের অধীনে ছিল। অক্টোবরের আগে গাজার দুই-তৃতীয়াংশ জনগণ খাদ্য সহায়তা পেত। এসব খাদ্য ভর্তুকি আকারে দেওয়া হতো। তীব্র শিশুপুষ্টির অভাব ছিল তখন এক শতাংশেরও কম ছিল। এই যুদ্ধের আগে গাজার ৫৩ থেকে ৫৯ শতাংশ মানুষের অবস্থা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করতো। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র অনুযায়ী, এ যুদ্ধের ৪০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের সশস্ত্র বাহিনী মিলিশিয়ারা ইসরায়েলে অনুপ্রবেশ করে প্রায় ১,২০০ জনকে হত্যা করে এবং ২৫০ জনকে অপহরণ করে। প্রায় ১০০ অপহৃত ব্যক্তি এখনও গাজায় রয়েছেন এবং তাদের মধ্যে কতজন জীবিত তা স্পষ্ট নয়।
৯. গাজায় বর্তমানে জাম, খেজুরের জেলি এবং এক বোতল আঙুরের মোলাসের দাম প্রায় ৭৭ ডলার। এসব দ্রব্য বিলাসী এবং এগুলো খুঁজে পাওয়াও খুব কঠিন। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, গাজার বর্তমান পরিস্থিতিতে এমন পরিমাণ নগদ অর্থ কারো কাছে আছে কিনা। মাসের পর মাস ধরে ব্যাংকগুলো বন্ধ রয়েছে। গাজায় কোনো নগদ অর্থ আসছে না এবং পাঠানো অর্থ স্থানান্তরের প্রক্রিয়া ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে। জাকুত বলেন, "বিলগুলো পুরোনো, কাগজ ছিরে গেছে এবং অনেকেই কিছু বিল আর গ্রহণ করে না। তিনি আরো বলেন, " এ পরিস্থিতিতে সবকিছুর অভাব মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দিচ্ছে।"
১০. এক বোতল জলপাই তেল এবং এক বোতল রান্নার তেলের দাম ১২৫ শেকেল বা প্রায় ৩২ ডলার। জুলাই এবং আগস্ট মাসে ডাব্লিউএফপি মাত্র ২৪ হাজার টন খাদ্য সরবরাহ করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এসব সহায়তা গাজার অর্ধেক জায়াগায় পৌঁছেছে। এর ফলে তাদের বিতরণকৃত খাদ্যের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হয়েছে। সংস্থাটি জরুরি ভিত্তিতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা মেরামতের ওপর জোর দিয়েছে। এতে তারা আরো মানুষের কাছে তাদের ত্রাণ পৌঁছাতে পারবে। অধিকাংশ রাস্তা অচল এবং আসন্ন বৃষ্টি ও বন্যার কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
অনুবাদ: সাদিয়া আফরিন রেনেসাঁ