এআই’র কারণে এক বছরেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর ৬০ মিলিয়ন চাকরি
আমরা ইতোমধ্যেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে এআই'র ব্যবহার বৃদ্ধি এরই মধ্যে সতর্ক ঘণ্টা বাজাচ্ছে। ইন্টার-আমেরিকান ডেভলপমেন্ট ব্যাংকের (আইডিবি) উদ্ভাবিত একটি সূচকে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র এক বছরের মধ্যে ৪৩ মিলিয়ন চাকরির উপর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব পড়বে। মেক্সিকোতে এ সংখ্যা ১৬ মিলিয়নে গিয়ে ঠেকেছে। আগামী পাঁচ বছরে এই সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রে ৬০ মিলিয়ন ও মেক্সিকোতে ২২ মিলিয়ন হতে পারে। আর এক দশকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে এ সংখ্যা ৭০ মিলিয়ন এবং মেক্সিকোতে ২৬ মিলিয়ন ছাড়াবে।
আইডিবি'র প্রধান অর্থনীতিবিদ ও সূচকের সহ-উদ্ভাবক এরিক পারাডো বলেন, "এ হিসাবগুলো সরাসরি চাকরি হারানোর সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। তবে এটি দেখায় বেশিরভাগ পেশা ঝুঁকিতে রয়েছে। আর সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা পেশাগুলো থেকে সুযোগও অনেক বেশি।" তিনি এ বিষয়ে বলেন, "এর জন্য একটি পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন যা এআইকে মোকাবিলায় সহায়তা করবে।"
উদ্ভাবিত এআই-জেনারেটেড ইনডেক্স অফ অকুপেশনাল এক্সপোজারের মাধ্যমে গণনা করে বের করা হয়েছে, আগামী এক থেকে পাঁচ ও দশ বছরে ৭৫০টির বেশির পেশা ও এসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পেশার ওপর প্রভাব ফেলবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
সূচক অনুসারে, এক বছরের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ৯৮০ মিলিয়ন চাকরির উপর কোনো না কোনোভাবে এই নতুন প্রযুক্তির প্রভাব পড়বে। এটি বৈশ্বিকভাবে ২৮ শতাংশ কর্মশক্তির সমান কাজ করতে পারে। পাঁচ বছরের মধ্যে এ সংখ্যা ৩৮ শতাংশে এবং দশ বছরে ৪৪ শতাংশে গিয়ে পৌঁছাবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চাকরি হারানোর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না থাকলেও, বিশ্বের প্রায় অর্ধেক কর্মসংস্থানের ওপর এটি প্রভাব ফেলবে। এটি ১৯ শতকের শিল্প বিপ্লব পরবর্তী সময়ের মতো প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে। এ বিষয়ে এরিক পারাডো বলেন, "এটি একটি শিল্প বিপ্লব যা দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর বাস্তবায়নে সময় কম লাগবে। তাই আমাদের দ্রুত সমন্বয় করতে হবে এবং সেই কারণেই আমরা এই গবেষণাটি করছি, যাতে একটি সতর্কবার্তা দেওয়া যায়।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা আশাবাদী, আমরা মনে করি প্রযুক্তিগত পরিবর্তন উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করবে। চাকরি প্রতিস্থাপন হওয়ার মানে এই নয় যে কর্মসংস্থান কমে যাবে, কারণ নতুন পেশা তৈরির সুযোগ আসবে। আমরা অতীতে এটি ঘটতে দেখেছি।"
প্রথম দেখায় মনে হতে পারে চাকরির বাজারে সংকট দেখা দিচ্ছে। কিন্তু সেটিকে সুযোগে পরিণত করার জন্য সুপারিশ করেছেন এ গবেষণার লেখকরা। এরিক পারাডো বলেন, "আমরা পরামর্শ দিচ্ছি যে শিক্ষা এবং পুনপ্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে বড় ধরনের বিনিয়োগ করা উচিত। এগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সম্পূরক দক্ষতা গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।"
নারী, সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী
গবেষণায় আরও সুপারিশ করা হয়েছে, সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করা বিশেষ করে নারীদের। এ বিষয়ে এরিক পারাডো বলেন, "গবেষণায় দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর নারীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কারণ তারা যেসব কাজের সঙ্গে যুক্ত তার সবগুলোই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ। এসব কারণে ৪০ শতাংশ নারী ক্ষতিগ্রস্ত হবে।" তাই নীতি নির্ধারণের সময় এই লিঙ্গ বৈষম্য বিবেচনায় নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন এরিক পারাডো।
আর্থ-সামাজিক স্তরেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ঝুঁকি রয়েছে। কম শিক্ষিত কর্মী এবং যাদের কাজের জন্য কম প্রশিক্ষণ প্রয়োজন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে তারা বেশি প্রভাবিত হবে। আয়ের ক্ষেত্রে, যুক্তরাষ্ট্রে যারা কম উপার্জন করে তারা বেশি ঝুঁকিতে থাকবে, অন্যদিকে মেক্সিকোতে এই পরিবর্তনটি শ্রমজীবী শ্রেণি এবং মধ্যবিত্ত উভয়ের চাকরিতে প্রভাব
ক্ষেত্রভেদে ঝুঁকিও ভিন্ন রকম। যেসব কাজের জন্য আরও বেশি ব্যক্তিগত মানদণ্ডের প্রয়োজন, সেগুলি প্রতিস্থাপন করা বেশি কঠিন হবে। সূচকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানের একটি তালিকা রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ পেশাগুলোর মধ্যে রয়েছে টেলিফোন অপারেটর, টেলি মার্কেটিং, ঋণ মূল্যায়ক, মেশিন অপারেটর এবং ট্রাভেল এজেন্সির মতো কাজ। কিছু ক্ষেত্রে, যেমন টেলিফোন অপারেটরের ক্ষেত্রে ৯২ শতাংশ চাকরি প্রভাবিত হবে।
দমকলকর্মী ও ক্রীড়াবিদদের কাজ অপ্রতিস্থাপনযোগ্য
অপরদিকে কিছু পেশা রয়েছে যেগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন নেই। সেগুলো হলো- ক্রীড়া, শিক্ষকতা এবং দমকলকর্মী সম্পর্কিত কাজ। সূচকের একটি উদ্ভাবনী দিক হলো এটি প্রতিটি পেশার কাজগুলোকে আলাদা করে মূল্যায়ন করে। এতে দেখা গেছে যে প্রতিটি পেশার মধ্যে এমন কিছু বিশেষজ্ঞ কাজ রয়েছে যেগুলি তুলনামূলকভাবে সহজে প্রতিস্থাপনযোগ্য।
উদাহরণস্বরূপ, চিকিৎসা ক্ষেত্রে একজন রেডিওলজিস্টের চাকরি হারানোর সম্ভাবনা বেশি। সেখানে একজন মনোবিজ্ঞানী, ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জন বা এমনকি একজন নার্সের ক্ষেত্রে এ ঝুঁকি কম।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ঝুঁকি জাতি বা উৎসভেদেও ভিন্ন হয় কিনা তা নিয়ে কোনো বিশ্লেষণ করা হয়নি। কিন্তু জানা যায়, আফ্রিকা বংশোদ্ভূত আমেরিকান ও লাতিনরা বেশিরভাগই কম আয়ের চাকরিতে নিয়োজিত। তাই অনুমান করা সহজ হয়, এ নতুন প্রযুক্তির বিকাশে তারাও বেশি প্রভাবিত হবে।
আইডিবি'র এ গবেষণার লক্ষ্য হলো, জনসাধারণ ও বেসরকারি নীতিকে এমনভাবে পরিচালিত করা যাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নেতিবাচক প্রভাব প্রতিহত করা যায়। শ্রমিকদের এই রূপান্তরের সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচির পাশাপাশি, গবেষণায় সরকারকে সামাজিক নিরাপত্তা উন্নয়নের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে স্বল্পমেয়াদে আরও শক্তিশালী কর্মসংস্থান বীমা এবং কর্মীদের জন্য ভর্তুকি প্রবর্তনের মাধ্যমে মানুষকে নতুন শ্রম মডেল আত্মস্থ করার সুযোগ দিতে হবে। এতে ছোট ব্যবসাকে সহায়তা, শ্রমবাজারের পর্যায়ক্রমিক মূল্যায়ন এবং নৈতিক উন্নয়নের প্রচারের কথাও বলা হয়েছে।
এরিক পারাডো বলছেন, "এমন একটি পরিবর্তন মোকাবিলা করতে স্কুলগুলোকেও মানিয়ে নিতে হবে।" এ বিষয়ে তিনি সরকারকে স্কুল কারিকুলামে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, "এ প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এখানে স্থায়ীভাবেই থাকবে।"