লেবাননে আগ্রাসন: ইসরায়েলি অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন করা ছাড়া কোনো উদ্যোগ নেই!
এবার স্থলপথে প্রতিবেশী লেবাননে আগ্রাসন শুরু করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। এই অভিযানকে দৃঢ় সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে বিশ্বের অধিকাংশ দেশই লেবাননের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের ঘটনায় সমালোচনা করছে, জানাচ্ছে যুদ্ধবিরতির দাবি। ফলে আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো কূটনীতিক পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ যেন এরমধ্যেই ফুরিয়ে এসেছে ওয়াশিংটনের হাতে।
তবে দক্ষিণ লেবাননে 'সীমিত পরিসরের' স্থল অভিযানকে 'ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার' হিসেবে ঘোষণা করেছে ওয়াশিংটন। যদিও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েলের সামরিক প্রস্তুতি ও অভিযানের পরিসরকে কোনোভাবেই সীমিত বলার উপায় নেই। লেবাননে প্রবেশের জন্য সীমান্তে অঞ্চলে প্রস্তুত রয়েছে কমপক্ষে ৫০-৬০ হাজার সেনা।
যুদ্ধে ইসরায়েল অনেক শক্তিধর প্রতিপক্ষ হলেও – প্রতিরোধে অনড় হিজবুল্লাহ। ইরান সমর্থিত এই প্রতিরোধ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য জায়নবাদী সেনারা লেবাননের আরো ভেতরে প্রবেশ করলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই প্রেক্ষাপটে, ইসরায়েলি অভিযানের বিষয়ে দ্রুতই 'গভীর উদ্বেগ' প্রকাশ করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও জাপান।
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন বলেছেন, লেবাননের দক্ষিণ সীমান্তকে হিজবুল্লাহ মুক্ত করতে সেখানে স্থল অভিযান চালানোর প্রয়োজন সম্পর্কে ওয়াশিংটনের সম্মতির কথা তিনি ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তকে জানিয়েছেন। হিজবুল্লাহর অস্ত্র ধ্বংস করতে অন্যান্যভাবেও হামলা করতে সবুজ সংকেত দিয়েছে ওয়াশিংটন।
অস্টিন বলেন, "আমি স্পষ্টভাবে জানিয়েছি, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারকে সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্র।'
আজ মঙ্গলবার একই ধরনের বিবৃতি দিয়েছে হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদও। সেখানে ইসরায়েলের অভিযানকে 'সীমিত পরিসরের' বলে উল্লেখ করে এর পক্ষে সাফাই দেওয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্র স্থল অভিযানের পরিধি আরো বাড়ানোর বিপক্ষে, এবং ইসরায়েল-লেবানন সীমান্তে টেকসই স্থিতিশীলতার জন্য কূটনৈতিক সমাধান একমাত্র উপায় বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
গতরাতে ইসরায়েলি সেনারা লেবাননে প্রবেশ করে। ছত্রীবাহিনী, কমান্ডো ও সাঁজোয়া ইউনিটগুলোর অভিযানের মধ্য দিয়ে এ আক্রমণ শুরু হয়েছে। যদিও এক বিবৃতিতে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, হামলার পরিসর সীমিত, অঞ্চলভিত্তিক এবং শুধু হিজবুল্লাহকে নিশানা করে চালানো হচ্ছে। তবে এই ধরনের দাবি আগেও করেছে ইসরায়েল। তা সত্ত্বেও গত কয়েকদিনে তাদের বিমান হামলায় লেবাননে বহু বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। দেশটির রাজধানী বৈরুতেও নির্বিচারে বোমা ফেলেছে ইসরায়েলি জঙ্গিবিমান।
'সবচেয়ে বিপজ্জনক'
লেবাননের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতি জনগণকে হুঁশিয়ার করে বলেছেন, 'ইতিহাসের সবচেয়ে বিপজ্জনক অধ্যায়গুলোর একটির' মুখোমুখি তার দেশ। বিগত কয়েক সপ্তাহের ইসরায়েলি হামলায় বাস্তুচ্যুত ১০ লাখ লেবানিজকে ত্রাণ সহায়তা দিতে এসময় জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
জাতিসংঘ প্রতিনিধিদের সাথে এক বৈঠকে তিনি বলেন, 'বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের মৌলিক সহায়তা দেওয়ার চলমান প্রচেষ্টাকে জোরদার করতে আমরা জরুরিভাবে আরো ত্রাণ সহায়তা প্রদানের আহ্বান জানাই।'
লেবাননে জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয়ক ইমরান রিজা আরো ৪২৬ মিলিয়ন ডলারের জরুরি ত্রাণ সহায়তার আহ্বান জানিয়েছেন। সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত বেসামরিক মানুষকে এই সহায়তা দিতে হবে।
'যথেষ্ট সম্পদ ছাড়া পুরো দেশটির জনসংখ্যাকে মানবিক সহায়তা দেওয়া সম্ভব হবে না, যা তাঁদের জরুরি ভিত্তিতে দরকার।' তবে এভাবে বেসামরিক মানুষকে লক্ষ্য করে হামলা হতে থাকলে– কোনো পরিমাণ ত্রাণ সহায়তা দিয়েই মানবিক বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না বলেও সতর্ক করেছেন তিনি।
জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের মুখপাত্র লিজ থ্রসেল বলেছেন, 'বড় পরিসরে স্থল আগ্রাসন' শুরু হলে জনমানুষের ভোগান্তি আরো বাড়বে।
()
'আঞ্চলিক অখণ্ডতা'
ইসরায়েলি অভিযানের নতুন এই পর্ব সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উদ্বেগ ছড়িয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, লড়াইয়ের তীব্রতা বাড়ার ঘটনায় 'গভীর উদ্বেগ' প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে, সেখানে বলা হয় "লেবাননের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত তার অবিচল সমর্থনকে পুনর্ব্যক্ত করছে।"
সংঘাত আরো ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং বেসামরিক সম্পূর্ণরূপে নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানের ওপর জোর দেওয়া হয় এ বিবৃতিতে।
এছাড়া, আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান, লেবাননের নাগরিকদের জন্য আরো ১০০ মিলিয়ন ডলারের জরুরি সহায়তা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন।
সামাজিক মাধ্যম 'এক্স' (সাবেক টুইটারে) কাতারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আব্দুলআজিজ আল-খুলাইফি হুঁশিয়ার করে বলেছেন, 'লেবাননে আগ্রাসন চালানোর ফলে সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতি তৈরি হবে।'
তিনি বলেন, 'অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে দেশটির অখণ্ডতা ও নিরাপত্তার জন্য আমাদের অবিচল সমর্থন প্রয়োজন। লেবাননের ভ্রাতৃপ্রতীম মানুষের পাশে দাঁড়ানো কেবল নৈতিক দায়িত্বই নয়, বরং তা অপরিহার্য।'
অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান
বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের দেশগুলোও অবিলম্বে এই সংঘাতের অবসান করার আহ্বান জানাচ্ছে। এটি আঞ্চলিক যুদ্ধের হুমকি বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে বলেও মনে করছে তারা।
জাপান সরকার অবিলম্বে একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা এবং সংঘাতের আরো বিস্তাররোধে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে।
অন্যদিকে রাশিয়া বলেছেন, 'সংঘাতের ভৌগলিক সীমা বাড়ছে, যা এই অঞ্চলকে (মধ্যপ্রাচ্য) আরো অস্থিতিশীল করছে এবং উত্তেজনা বৃদ্ধি করছে।'
মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধের বিস্তাররোধে ইসরায়েলের প্রতি তাঁদের স্থল অভিযান বন্ধের দাবি জানিয়েছেন স্পেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জোট- জি-৭ এর বর্তমান সভাপতি ইতালি জানিয়েছে, সংঘাত অবসানে তারা চেষ্টা চালিয়ে যাবে।
অন্যদিকে সামরিক জোট ন্যাটোর নতুন প্রধান মার্ক রুট্টে বলেছেন, লেবাননে সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহের দিকে ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখছেন তিনি।