অবশেষে মরিশাসের হাতে গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপপুঞ্জ তুলে দিচ্ছে যুক্তরাজ্য, তবে থাকছে সামরিক ঘাঁটি
ভারত মহাসাগরের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি দ্বীপপুঞ্জের সার্বভৌমত্ব মরিশাসের হাতে তুলে দিচ্ছে বলে ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাজ্য। দ্বীপপুঞ্জটি অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে যুক্তরাজ্যের দখলে ছিল। খবর বিবিসির।
দীর্ঘ আলোচনার পর একটি চুক্তির আওতায় এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপের মাধ্যমে চাগোস দ্বীপপুঞ্জ মরিশাসের কাছে হস্তান্তর করবে যুক্তরাজ্য।
এই দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় প্রবালপ্রাচীর দিয়েগো গার্সিয়াও রয়েছে। এটি যুক্তরাষ্ট্র তার নৌবাহিনী ও দূরপাল্লার বোমারু বিমানের জন্য সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে।
যুক্তরাজ্য ও মরিশাসের প্রধানমন্ত্রীদের যৌথ বিবৃতিতে জানান, এ চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে চলমান জটিল দরকষাকষির সমাপ্তি ঘটল।
তবে দ্বীপপুঞ্জ ফিরিয়ে দিলেও দিয়েগো গার্সিয়ায় যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি থাকবে। এ শর্তই চুক্তিটি সম্পাদিত হওয়ার মূল কারণ। উল্লেখ্য, এ অঞ্চলে চীন, ভারত ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা ক্রমেই বাড়ছে।
যত দ্রুত সম্ভব চুক্তিটির আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে উভয় পক্ষ।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টার্মার ও মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী প্রবিন্দ জুগনাথ বলেছেন, তারা দিয়েগো গার্সিয়ায় অবস্থিত ঘাঁটির দীর্ঘমেয়াদি, নিরাপদ ও কার্যকর পরিচালন নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সচিব ডেভিড ল্যামি বলেছেন, এ চুক্তির অন্যতম সুবিধা হচ্ছে একটি 'সম্ভাব্য অবৈধ অভিবাসন পথ' বন্ধ হবে।
তিন বছর ধরে দ্বীপে একটি বেড়াবেষ্টিত শিবিরে শ্রীলঙ্কার তামিলদের একটি দল আটক রয়েছে। তাদের কোথায় পাঠানো হবে, তা নিয়ে জটিল আইনি লড়াই চলছে। চুক্তির ঘোষণার ফলে তাদের কী হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
মরিশাসকে বার্ষিক পেমেন্ট ও অবকাঠামোতে বিনিয়োগের একটি আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ দিচ্ছে যুক্তরাজ্য।
মরিশাস চাগোস দ্বীপপুঞ্জে পুনর্বাসন কর্মসূচি শুরু করতে পারবে, তবে দিয়েগো গার্সিয়ায় সে অনুমতি পাবে না। দিয়েগো গার্সিয়ায় যুক্তরাজ্য 'প্রাথমিকভাবে' ৯৯ বছর সামরিক ঘাঁটি পরিচালনা করবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই 'ঐতিহাসিক চুক্তিকে' স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, 'জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী' একটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটির ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করেছে এ চুক্তি।
চাগোসের বাসিন্দারা অবশ্য নিজেদের বাসভূমির ভবিষ্যৎ নিয়ে এক সুরে কথা বলছেন না। তাদের কেউ কেউ মরিশাস ও সিশেলেস-এ, আবার অনেকে সাসেক্সের ক্রলি-তে বাস করছেন। তাদের কেউ কেউ বিচ্ছিন্ন দ্বীপে ফিরে যেতে চান, আবার অনেকে যুক্তরাজ্যে নিজেদের অধিকার ও মর্যাদা চান। অন্যরা বলছেন, দ্বীপপুঞ্জের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে বাইরের কারোর হস্তক্ষেপ কাম্য নয়।
গত কয়েক বছরে যুক্তরাজ্য 'ব্রিটিশ ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল' ক্রমবর্ধমান কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়েছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, তাদের শীর্ষ আদালত ও সাধারণ পরিষদ মরিশাসের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
মরিশাস সরকার দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে, ১৯৬৮ সালে তাদের স্বাধীনতার বিনিময়ে চাগোস দ্বীপপুঞ্জ যুক্তরাজ্যের কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য করা হয়েছিল।
ওই সময় ব্রিটিশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি গোপন চুক্তিও করে ফেলে। ওই চুক্তি অনুযায়ী, বৃহত্তম প্রবালপ্রাচীর দিয়েগো গার্সিয়াকে সামরিক ঘাঁটি হিসেবে লিজ দেওয়া হয়।
এখানে বসবাসরত ১ হাজার অধিবাসীকে জোর করে উচ্ছেদ করে ব্রিটেন। এ ঘটনার জন্য যুক্তরাজ্য পরে ক্ষমাও চেয়েছে। তারা প্রতিশ্রুতি দেয়, এই দ্বীপগুলো যখন আর কৌশলগতভাবে প্রয়োজন হবে না, তখন সেগুলো মরিশাসকে ফিরিয়ে দেবে।
কিন্তু কিছুদিন আগপর্যন্তও যুক্তরাজ্য দাবি করত, এসব দ্বীপের ওপর মরিশাসেরও কোনো বৈধ দাবি নেই।
কয়েক দশক ধরে ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র মরিশাস এই সমস্যায় জোরালো আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে লড়াই করছে।
১৯৬০-এর দশকের শেষদিকে ও ১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে যারা নিজেদের বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, তাদের অনেকে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আদালতেও গেছেন।
তবে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক জনমত বদলাতে শুরু করে।
আফ্রিকান দেশগুলো ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠে কথা বলা শুরু করেছে, যুক্তরাজ্যকে উপনিবেশ ছাড়তে চাপ দিচ্ছে।
এরপর ব্রেক্সিটের ফলে অনেক ইউরোপীয় দেশ আন্তর্জাতিক ফোরামে যুক্তরাজ্যের অবস্থানকে সমর্থন দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
মরিশাস সরকার লড়াই চালিয়ে যায়। অভিযোগ করে, যুক্তরাজ্যের তাদের মৌখিক হুমকি দিয়েছে।জাতিসংঘ, আদালত ও গণমাধ্যমে আরও কৌশলী প্রচারণা কর্মসূচি নেয় মরিশাস। এমনকি ব্রিটিশ অনুমোদন ছাড়াই দ্বীপপুঞ্জে পতাকাও টানায়।
বৃহস্পতিবারের চুক্তির আলোচনাগুলি পূর্ববর্তী যুক্তরাজ্য সরকারের অধীনে শুরু হয়েছিল।
চাগোসকে মরিশাসের হাতে তুলে দেওয়ার চুক্তিই বলছে, যুক্তরাজ্য এখন আন্তর্জাতিক ফোরামে সমর্থন হারাতে চায় না। বিশেষ করে আফ্রিকার দেশগুলোর সমর্থন ধরে রাখতে দেশটি উদগ্রীব।