ইসরায়েল এবং গাজার আলোকচিত্রীরা তাদের যে ছবির কথা ভুলতে পারছেন না
গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে অতর্কিত হামলা চালায় হামাস। ওই হামলার সাইরেন বেজে ওঠার পর থেকে নিউ ইয়র্ক টাইমসের ফটো সাংবাদিকরা এ সংকটের চিত্র তুলে ধরতে শুরু করেন।
এরপরের বছরজুড়ে, ইসরায়েলের সামরিক অভিযান, ফিলিস্তিনের গাজায় সহিংসতা ও হামাস নেতৃত্বাধীন আক্রমণ ও সংঘাতের সব কিছুই তারা পর্যবেক্ষণ করে এসেছেন।
যুদ্ধের সময় ছবি তোলার কাজে নিয়োজিত সাত ফটোগ্রাফার সেই চিত্রগুলো নিয়ে কথা বলেছেন। এ ঘটনাগুলো তাদের মনে গভীরভাবে দাগ কেটেছে।
আশকেলোন, ইসরায়েল, অক্টোবর ২০২৩
আশ্রয়ের জন্য ছুটে চলা
আমি যখন এই ছবিটি তুলি তখন সতর্কসংকেত বাজচ্ছিল। এটি ছিল ৭ অক্টোবরের বিকেল এবং আশ্রয়ের জন্য দৌড়ে চলা নারীটি হলেন এভগেনিয়া সিমানোভিচ। তিনি গাজা সীমান্তের কাছে অবস্থিত উপকূলীয় শহর আশকেলোনে তার বাড়ির আশেপাশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন এবং কাছাকাছি জ্বলতে থাকা আগুন পরীক্ষা করছিলেন।
সেদিন সকালে হামাসের হামলার প্রথম রকেটগুলো নিক্ষেপের পর তখনও উঠতে থাকা কালো ধোঁয়া অনুসরণ করে আমি সেখানে এসেছিলাম। ওই মুহূর্তে অসংখ্য রকেট নিক্ষেপ করা হচ্ছিল। সিমানোভিচ এবং আমি মাত্র কথাবার্তা শুরু করেছিলাম। কিন্তু আশকেলোনে একবার সতর্ক সংকেত শোনার পর মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছাতে হয়।
— তামির খলিফা
কফার আজা, ইসরায়েল, অক্টোবর ২০২৩
মৃতদেহগুলো বের করে আনা হচ্ছিল
১০ অক্টোবর কিবুটজ কফার আজার পরিস্থিতি ছিল অনিশ্চয়তায় ঘেরা এবং ভীতিকর। সেদিন ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের তৃতীয় দিন ছিল। সেনা সদস্যরা বাড়ি থেকে মৃতদেহ উদ্ধার করছিল এবং কিছু হামলাকারীর লাশ তখনও অক্ষত অবস্থায় মাটিতে পড়ে ছিল।
এটি ছিল আক্রমণের প্রথম আঘাতপ্রাপ্ত স্থানগুলোর একটি। যখন আমি সেখানে পৌঁছালাম, তখন আমি অবাক হয়ে গেলাম যে গাজা নিরাপত্তা বেষ্টনীর কতটা কাছে কিবুটজটি এবং এই উপলব্ধি হয় যে, মানুষ এতদিন ধরে একটি বৈরী প্রতিবেশীর কাছাকাছি শান্তিতে বসবাস করে আসছিল।
আমি মনে করতে পারি যে, আমি যা প্রত্যক্ষ করছিলাম তা খুব সতর্কভাবে নথিভুক্ত করতে হয়েছিল। সেই সময় আমরা জানতাম না কতজন ইসরায়েলি নিহত হয়েছে বা অপহৃত হয়েছে। সর্বত্র গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল।
— সের্গেই পোনোমারেভ
মধ্য গাজা উপত্যকা, অক্টোবর ২০২৩
একটি পরিবারের শোক
আমি এই নারীকে দেখেছিলাম দেইর আল বালাহের আল-আকসা শহীদ হাসপাতালের । সেদিন এত মানুষ নিহত হয়েছিল যে লাশগুলো বাইরে সারি করে রাখা ছিল। আর তিনি সেই সারিগুলোর মধ্যে হাঁটছিলেন এবং তার ভাই-বোনদের খুঁজছিলেন।
একসময় তিনি তার বোনকে খুঁজে পান, যিনি গর্ভবতী ছিলেন এবং আগের রাতে প্রসব বেদনা শুরু হয়েছিল বলে তিনি জানান। এরপর তিনি তার মৃত বোনের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেন। তিনি বলেন, "তুমি সন্তানের জন্ম দেওয়া নিয়ে ভয় পাচ্ছিলে, আর এখন তুমি নিজেই বিশ্রামে চলে গেছো।" তিনি তার মৃত ভাইদের সঙ্গেও কথা বলার চেষ্টা করেন। তাদের নাম ধরে ডাকেন। তাদের গুণাবলির কথা বলতে থাকেন। তিনি কাঁদছিলেন কিন্তু নিজেকে দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছিলেন, আর আশেপাশের লোকজন তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল।
স্যাটেলাইটের চিত্র অনুসারে, ইসরায়েলি সেনারা লেবাননে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের কাছে অবস্থান নিয়েছে। ইসরায়েলের দক্ষিণে একটি বন্দুক হামলায় একজন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন বলে জরুরি সেবা সংস্থা জানিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গাজার লোকজন লেবাননে গোলাগুলির মধ্যে পড়লে কী করতে হবে, সে বিষয়ে পরামর্শ শেয়ার করছেন। আমার সাতজন বোন আছে। আমি যখন ছবি তুলি, প্রায়ই তাদের কথা মনে পড়ে এবং আমি তাদের নিয়ে সবসময়ই চিন্তিত থাকি। আমি আমার সন্তানদের নিয়েও চিন্তিত, বিশেষত যখন দেখি আমার সাংবাদিক সহকর্মীরা তাদের সন্তানদের বোমাবর্ষণে হারাচ্ছেন। যদি আমি তাদের হারাই? অথবা তারা যদি আমাকে হারায়? এসব নিয়ে আমি সবসময় সঙ্কিত থাকি।
— সামার আবু এলউফ
রেইম, ইসরায়েল, অক্টোবর ২০২৩
তাদের কাছে কী ছিল?
নোভা ফেস্টিভ্যাল গণহত্যার স্থান দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আমি এমন কিছু জিনিস দেখেছিলাম যা আমাকে আমার নিজের জিনিসের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। ফ্লিপ-ফ্লপ, টুথব্রাশ, ব্যাকপ্যাক- সব জিনিসই ছিল পরিচিত ব্র্যান্ডের। এই এলাকাটি একটি বন্ধ সামরিক অঞ্চলে পরিণত হয়েছিল। এটি ছিল প্রায় জনশূন্য আর একমাত্র শব্দ ছিল বোমা বিস্ফোরণের।
সেই মুহূর্ত, এই ট্র্যাজেডি আমার কাছে এখন অত্যন্ত ব্যক্তিগত হয়ে উঠেছিল। এই জিনিসগুলো কারও হতে পারে, যাদের আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। তাদের কেউ হয়ত এখন আর জীবিত নেই অথবা কেউ হয়ত বেঁচে আছে।
এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বিপরীতে এত হত্যার চিহ্ন এবং খোলা আকাশের নিচেও মৃত্যুর গন্ধ, আমার মধ্যে এমন এক মিশ্র অনুভূতির জন্ম দিয়েছিল যা আমি কখনোই কল্পনা করতে পারিনি।
— আমিত এলকায়াম
খান ইউনিস, গাজা, অক্টোবর ২০২৩
হতাহত
এই ছেলেটির মুখের অভিব্যক্তি আমাকে গভীরভাবে আঘাত করেছিল।
যে রাতে আমি এই ছবিটি তুলি, সেদিন আমি খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে ঘুমাচ্ছিলাম। যখনই কাছাকাছি একটি আঘাতের শব্দ শুনলাম এবং অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ পেলাম, তখনই দ্রুত জরুরি বিভাগের প্রবেশপথের দিকে ছুটে গেলাম। এই ছেলেটি ছিল প্রথমদের মধ্যে একজন যাকে সেই শব্দ আর সহিংসতার মধ্য থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল।
প্যারামেডিকরা তাকে দ্রুত ভেতরে নিয়ে গেল। আমি তাকে শুধু আমার ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারের মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছিলাম। তবে আমি দেখেছি তার পুরো শরীর ধুলা, ছাই এবং রক্তে ঢাকা ছিল। আর তার চোখ আমার হৃদয়ে বিদ্ধ হচ্ছিল।
এরপর থেকে আহত এবং নিহত মানুষ আসতেই থাকল। বাতাসে রক্তের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল।
— ইউসুফ মাসউদ
গাজা শহর, নভেম্বর ২০২৩
অন্ধকার
এই সেনা সদস্যরা গাজার সবচেয়ে বড় মেডিকেল কমপ্লেক্স আল-শিফা হাসপাতালের বাইরে অবস্থান করছিলেন। এখানে ইসরায়েলি বাহিনী প্রায় ৪৮ ঘণ্টা আগে একটি অভিযান শুরু করেছিল।
এক চাঁদহীন রাতে সাঁজোয়া যানে করে আমাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমরা যখন গাজা শহরে প্রবেশ করি, তখন আমরা আমাদের চারপাশের ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র দেখতে পাই।
হাসপাতালের কাছে আমরা এমন ধ্বংসাবশেষ ও নিঃসঙ্গতা দেখেছিলাম যার পরিমাণ নির্ণয় করা কঠিন ছিল। সেনাবাহিনী আমাদের রোগী ও চিকিৎসকদের সাক্ষাৎকার নিতে দেয়নি। ইসরায়েল দাবি করেছিল, এই কমপ্লেক্সটি হামাসের কমান্ড সেন্টার এবং অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। কিন্তু আমাদের যা দেখানো হয়েছিল তা ছিল অস্পষ্ট।
এটি ছিল সংঘাতের পঞ্চম সপ্তাহ। আর এরই মধ্যে গাজায় মৃতের সংখ্যা ১১ হাজার ছাড়িয়ে যায়।
— ড্যানিয়েল বেরেহুলাক
তেল আবিব, ডিসেম্বর ২০২৩
প্রথম হাসি
ছবির ইনি হলেন গাল গোল্ডস্টেইন-আলমগ। তাকে তার মা, ভাই এবং বোনসহ অপহরণ করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ছবিতে তিনি তার দাদু গিওরা'র পাশে শুয়ে আছেন।
আমি এই ছবিটি একটি প্রকল্পের অংশ হিসেবে তুলেছিলাম। মূলত আমি মুক্তি পাওয়া ও উদ্ধার হওয়া অপহৃত ব্যক্তিদের ছবি তুলছিলাম। আমি কয়েকদিন ধরে এই পরিবারের সঙ্গেই ছিলাম। তারা একটি হোটেলে অবস্থান করছিলেন এবং এক সন্ধ্যায় আমি জানতে পারি যে গিওরা তার নাতি-নাতনিদের সাথে রাত কাটাচ্ছিলেন। তাদের বাবা এবং বড় বোনকে ৭ অক্টোবর তাদের বাড়িতে হত্যা করা হয়েছিল।
গাল গোল্ডস্টেইন ঘুমাতে যাওয়ার আগে তাদের এই হাসি, যুদ্ধ এবং শোকের সময়গুলো নথিভুক্ত করার পর প্রথম সুখের মুহূর্ত যা আমি ধারণ করতে পেরেছিলাম। এটি আমাকে এই যুদ্ধের সকল শিশুর জন্য একটি ভালো সমাপ্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিল।
— আভিশাগ শা'র-ইয়াশুভ