ইয়াহিয়া সিনওয়ার: কে ছিলেন হামাসের এই নেতা?
ইসরায়েল দাবি করছে হামাসের নেতা ৬১ বছর বয়সী ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে হত্যা করা হয়েছে। ধারণা করা হয়, ৭ অক্টোবর ২০২৩ এর হামলার বড় পরিকল্পনকারী ইয়াহিয়া। এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসীর তালিকায় তার নাম ছিল। খবর বিবিসি-এর।
ইসরায়েলের সঙ্গে হামাসের যুদ্ধের শুরুতেই গাঁ ঢাকা দেন ইয়াহিয়া সিনওয়ার। এ যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ১২০০ জন নিহত হয়েছেন এবং ২৫১ জনকে অপহরণ করা হয়েছে।
তবে ইয়াহিয়া সিনওয়ার মৃত্যু খুব একটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। কারণ হাজার হাজার ইসরায়েলি সেনা ড্রোন, ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও গুপ্তচরের মাধ্যমে তার অবস্থান খুঁজে বের করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি বলেন, "ইয়াহিয়া সিনওয়ার হলেন কমান্ডার এবং তিনি মারা গেছেন।"
ধারণা করা হতো, সিনওয়ার গত বছর বেশিরভাগ সময় গাজার নিচের সুড়ঙ্গগুলোতে লুকিয়ে ছিলেন। সেখানে তার দেহরক্ষীরা ছিলেন এবং যাতে তাকে ট্র্যাক করা না যায় সেজন্য খুব কম মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। তাছাড়া ইসরায়েলি বন্দীদের তিনি ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে থাকতে পারেন, এমন ভয়ও ছিল ইসরায়েলের।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ গাজায় অপারেশন চালিয়ে একটি ভবনের ভিতর ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে হত্যা করে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী। আইডিএফ-এর তথ্য মতে, সেসময় সেখানে কোনো ইসরায়েলি বন্দী ছিল না। গতকাল বৃহস্পতিবার তার মৃত্যুর ঘোষণা দেওয়ার পর তার লাশ শনাক্ত করতে ইয়াহিয়ার আঙ্গুলের ছাপ ও দাঁতের রেকর্ড দেখানো হয়।
ইয়াহিয়া সিনওয়ার মৃত্যুর বিষয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, "যিনি আমাদের জনগণের ওপর ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যা চালিয়েছেন, হাজার হাজার ইসরায়েলি সেনাকে হত্যা করেছেন, আমাদের শত শত নাগরিককে হত্যা করেছেন, তিনি আজ আমাদের বীর সেনাদের হাতে নিহত হয়েছেন। আমরা যেমনটি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, তার সঙ্গে সে হিসাব মেটালাম।"
ইতোমধ্যেই গাজায় হামাসের আরও অনেক শীর্ষ নেতাকে হত্যা করেছে বলে দাবি ইসরায়েলের। তাদের সবাইকেই ৭ অক্টোবর হামলার পর মৃত ঘোষণা করা হয়েছে। এ মৃতদের তালিকায় রয়েছেন হামাসের সামরিক শাখার ইজ্জাদিন আল-কাসসাম ব্রিগেডের মোহাম্মদ দেইফ। আইডিএফ-এর দাবি, তাকে জুলাই মাসেই গাজায় এক বিমান হামলায় হত্যা করা হয়েছে।
ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের (ইসিএফআর) সিনিয়র পলিসি ফেলো হিউ লোভাট গত বছর বলেছিলেন, "তিনি বিশ্বাস করেন ৭ অক্টোবরের হামলার পরিকল্পনার পেছনে মোহম্মদ দেইফ ছিলেন। কারণ এটি একটি সামরিক অপারেশন ছিল। সিনওয়ার সম্ভবত সেই দলের অংশ ছিলেন। তারা মিলে এটি পরিকল্পনা ও প্রভাবিত করেছিলেন।"
এদিকে হামাসও অভিযোগ করেছে, জুলাইয়ে তাদের মূল নেতা ইসমাইল হানিয়াকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। পলাতক থাকা সত্ত্বেও, সিনওয়ারকে পরবর্তী মাসেই হানিয়ার উত্তরসূরি হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
উত্থান ও গ্রেপ্তার
ইয়াহিয়া সিনওয়ার গাজার দক্ষিণে খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আবু ইব্রাহিম নামে পরিচিত ছিলেন। তার বাবা-মা আশকেলন থেকে ফিলিস্তিনে এসেছেন। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে শুরু হওয়া যুদ্ধে বিপুল সংখ্যক ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে তারাও বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েন এবং এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন। পরবর্তীতে তারা সেখানকার শরণার্থীতে পরিণত হন। ফিলিস্তিনরা যুদ্ধের এ সময়কে 'আল-নাকবা' (বিপর্যয়) বলে থাকেন।
খান ইউনিস সেকেন্ডারি স্কুল ফর বয়েজে পড়াশোনা করেন ইয়াহিয়া সিনওয়ার। পরে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি ভাষায় স্নাতক সম্পন্ন করেন।
কারাগারে ইয়াহিয়া সিনওয়ারের চারবার সাক্ষাৎকার নেওয়া ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নেয়ার ইস্ট পলিসির ফেলো এহুদ ইয়ারি জানান, খান ইউনিসে মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি বিশাল আস্তানা ছিল। শরণার্থী শিবিরের দরিদ্র যুবকদের মসজিদে যেতে উদ্বুদ্ধ করতে বিশাল আন্দোলন গড়ে তুলেছিল এ ইসলামিক গ্রুপটি। পরে স্থানটি হামাসের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হয়ে দাঁড়ায়।
১৯৮২ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে সিনওয়ার প্রথমবার 'ইসলামিক কার্যকলাপের' জন্য ইসরায়েলের হাতে গ্রেপ্তার হন। পরে ১৯৮৫ সালে তিনি আবারও গ্রেপ্তার হন। এসময় তিনি হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন।
তেল আবিবের ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের সিনিয়র গবেষক কোবি মাইকেল বলেন, 'সিনওয়ার ও ইয়াসিন একে-অপরের খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। সংগঠনের আধ্যাত্মিক নেতার সঙ্গে এ সম্পর্ক পরবর্তীতে আন্দোলনে সিনওয়ারকে একটি 'হ্যালো ইফেক্ট' দেয়।
১৯৮৭ সালে হামাস প্রতিষ্ঠিত হয়। এর দু'বছর পর ইয়াহিয়া সিনওয়ার গোষ্ঠীর সবচেয়ে ভয়ংকর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা 'আল-মাজদ' প্রতিষ্ঠা করেন। সেসময় তার বয়স ছিল মাত্র ২৫ বছর।
'আল-মাজদ' নৈতিক অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়ার জন্য কুখ্যাত ছিল। কোবি মাইকেল এ বিষয়ে বলেন, 'সেক্স ভিডিও' বিক্রি করে এমন দোকানগুলোকে তারা তাদের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নির্ধারণ করেছিল। তাছাড়া ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক আছে কিংবা সহযোগিতা করছে এমন সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে তাদের হত্যা করতো এ সংস্থাটি।
ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নেয়ার ইস্ট পলিসির ফেলো এহুদ ইয়ারি জানান, ইসরায়েলের সহযোগী এমন সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি 'অমানবিক হত্যাকাণ্ড' চালিয়েছেন ইয়াহিয়া সিনওয়ার। কিছু হত্যাকাণ্ড তিনি নিজ হাতে করেছেন এবং এর জন্য তিনি গর্বিতও ছিলেন।
এক ইসরায়েলি কর্মকর্তার বরাতে জানা যায়, সিনওয়ার এক সন্দেহভাজন গুপ্তচরকে শাস্তি দেওয়ার কথা স্বীকার করেছিলেন। সিনওয়ার বলেছিল, তিনি ওই ব্যক্তির ভাইকে দিয়ে তাকে জীবন্ত কবর দেওয়ান। আর কবর দেওয়ার জন্য কোদালের পরিবর্তে একটি চামচ ব্যবহার করতে দেন।
ইয়ারি বলেন, "সিনওয়ার এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি চাইলেই তার চারপাশে তার অনুসারীদের জড়ো করতে পারতেন। তাদের মধ্যে এমন অনেক ব্যক্তি ছিলেন যারা সিনওয়ারকে ভয় পেতেন এবং তার সঙ্গে কোনো বিরোধে যেতে চাইতেন না।"
১৯৮৮ সালে সিনওয়ারের বিরুদ্ধে দুজন ইসরায়েলি সেনা সদস্যকে অপহরণ ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়। ওই বছরই তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১২ ফিলিস্তিনিকে হত্যার দায়ে ইসরায়েল তাকে দোষী সাব্যস্ত করে চারটি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।
কারাগারের বছরগুলো
সিনওয়ার, ১৯৮৮ থেকে ২০১১ সাল, ২২ বছরেরও বেশি সময় ইসরায়েলের কারাগারে কাটিয়েছেন। এর মধ্যে নির্জন কারাবাসের সময়গুলো তাকে আরও উগ্র করে তুলেছিল বলে মনে করা হয়।
ইয়ারি বলেন, "তিনি তার শক্তি ব্যবহার করে কোনো দয়ামায়া ছাড়াই নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি বন্দীদের মধ্যে নিজেকে নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি বন্দীদের পক্ষে কারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতেন এবং বন্দীদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখতেন।"
ইসরায়েলি সরকার একটি মূল্যায়নে কারাগারে থাকা সিনওয়ারকে 'নিষ্ঠুর, কর্তৃত্ববাদী, প্রভাবশালী, অস্বাভাবিক সহনশীল, চালাক ও ম্যানিপুলেশনের অধিকারী' হিসেবে বর্ণনা করেছে। আর ছোটখাটো জিনিসে সন্তুষ্ট থাকাসহ কারাগারের অন্য বন্দীদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় গোপন রাখতে পারবেন সিনওয়ার।
ইয়ারির মূল্যায়ন অনুসারে, সিনওয়ার একজন সাইকোপ্যাথ। তবে তিনি আরও বলেন, "সিনওয়ারকে শুধু একজন সাইকোপ্যাথ ভেবে থাকলে আপনি ভুল করবেন। কারণ সে অত্যন্ত চতুর ও বিচক্ষণ। সে মুহূর্তের মধ্যে তার ব্যক্তিগত আকর্ষণের ধরণ পরিবর্তন করে ফেলতে পারেন।
সিনওয়ার যখন ইসরায়েলকে ধ্বংস করতে হবে এবং ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য কোনো জায়গা নেই বলতেন তখন মজা করে ইয়ারিকে বলতেন, তার জন্য ব্যতিক্রম কিছু তৈরি করবেন।
কারাগারে থাকাকালীন সিনওয়ার হিব্রু ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠেন। তিনি সবসময় ইসরায়েলি সংবাদপত্র পড়তেন। ইয়ারি আরবি ভাষায় পারদর্শী হওয়া সত্ত্বেও তার সঙ্গে সিনওয়ার হিব্রু ভাষায়ই কথা বলতেন। এ বিষয়ে ইয়ারি বলেন, "সিনওয়ার হিব্রু ভাষায় আরও দক্ষ হতে চেয়েছিলেন। আমি মনে করি, তিনি কারাগারের ওয়ার্ডেনদের চেয়ে আরও শুদ্ধভাবে হিব্রু বলে কারও উপকার করতে চেয়েছিলেন।"
২০১১ সালে এক চুক্তির অংশ হিসেবে সিনওয়ার মুক্তি পান। সে চুক্তি অনুসারে, ইসরায়েলের শুধু এক আইডিএফ-এর সেনা সদস্য, গিলাদ শালিতের বিনিময়ে ১০২৭ জন ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলি আরব বন্দী মুক্তি পায়।
শালিত পাঁচ বছর হামাসের বন্দী ছিলেন। হামাসের শীর্ষ সামরিক কমান্ডারদের একজন সিনওয়ারের ভাই শালিতকে অপহরণ করেছিলেন। পরবর্তীতে সিনওয়ার আরও অনেক ইসরায়েলি সেনা সদস্যদের অপহরণের আহ্বান জানিয়েছিল।
ততক্ষণে, ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় তার দখলদারিত্বের অবসান ঘটিয়েছে এবং হামাস নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রতিপক্ষ ইয়াসির আরাফাতের ফাতাহ পার্টির সদস্যদের অনেককে উঁচু ভবন থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করে নিশ্চিহ্ন করেছে।
নৃশংস নিয়মকানুন
সিনওয়ার গাজায় ফিরে আসার পর তাকে তৎক্ষণাৎ একজন নেতা হিসেবে গ্রহণ করা হয় বলে জানান গবেষক মাইকেল। হামাসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে অনেক বছর ইসরায়েলের কারাগারে থাকায় তিনি এ মর্যাদা পেয়েছেন বলে ধারণা করা হয়।
তবে মাইকেল বলেন, "মানুষ তাকে ভয় পেত কারণ তিনি নিজ হাতে মানুষ হত্যা করেছেন। তিনি খুব নিষ্ঠুর ও আক্রমণাত্মক এবং একইসাথে ক্যারিশমাটিক ছিলেন।"
তার বিষয়ে ইয়ারি বলেন, "তিনি বক্তা ছিলেন না। তিনি যখন জনসাধারণের সঙ্গে কথা বলতেন তখন মনে হতো 'মব থেকে কেউ কথা বলছেন' এমন মনে হতো।"
ইয়ারি জানান, কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সিনওয়ার ইজ্জাদিন আল-কাসসাম ব্রিগেডের সঙ্গে একটি জোটও গড়েন এবং প্রধান স্টাফ মারওয়ান ঈসার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন। ২০১৩ সালে, তিনি গাজায় হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হন এবং পরে ২০১৭ সালে এর প্রধান হন।
সিনওয়ারের ছোট ভাই মোহাম্মদও হামাসে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ২০১৪ সালে হামাস তার মৃত্যুর ঘোষণা দেওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি অনেকবার দাবি করেছেন, তিনি কয়েকবার ইসরায়েলের হত্যাচেষ্টার হাত থেকে বেঁচে গেছেন।
এর পরবর্তী সময়ে সংবাদমাধ্যমে এমন রিপোর্ট এসেছে, যেখানে বলা হয়েছে মোহাম্মদ এখনও বেঁচে আছেন, হামাসের সামরিক শাখায় সক্রিয় এবং গাজার নিচে সুড়ঙ্গের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছেন। এমনকি ৭ অক্টোবরের হামলায়ও তার ভূমিকা থাকতে পারে।
সিনওয়ারের নিষ্ঠুরতা ও সহিংসতার জন্য তাকে 'খান ইউনিসের কসাই' উপাধি দেওয়া হয়।
ইয়ারি বলেন, "সিনওয়ার নৃশংস নিয়মকানুন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং হামাসের সদস্যরা জানতো তার আদেশ অমান্য করলে তাদের জীবন বিপদে পড়ে যাবে।"
সিনওয়ারের বিরুদ্ধে এক হামাস নেতাকে হত্যার অভিযোগও রয়েছে। ২০১৫ সালে অর্থ পাচার ও সমকামিতার অভিযোগে হামাস কমান্ডার মাহমুদ ইশতিওয়ির গ্রেপ্তার হন এবং তার ওপর অনেক অত্যাচার চালানো হয় ও তাকে হত্যা করা হয়।
২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তরের প্রতিবাদে এক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ইসরায়েল থেকে গাজা উপত্যকাকে আলাদা করে সীমান্ত বেড়া ভেঙ্গে হাজার হাজার ফিলিস্তিনিদের প্রতি তার সমর্থনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।
সেই বছরই শেষের দিকে পশ্চিম তীরে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) অনুগত ফিলিস্তিনিদের একটি হত্যাচেষ্টার হাত থেকে বেঁচে গেছেন বলে দাবি করেন।
তবে তিনি কিছু সময় সংকটময় পরিস্থিতিতে সমঝোতা প্রদর্শন করেছিলেন। ইসরায়েলের সঙ্গে সাময়িক অস্ত্রবিরতি, বন্দী বিনিময় এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পুনর্মিলন সমর্থন করেছিলেন। মাইকেল বলেন, এসময় কিছু বিরোধী তার বিরুদ্ধে অতিরিক্ত মৃদু থাকার অভিযোগ তুলেছিলেন।
ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানে অনেকেই মনে করেন, বন্দী বিনিময়ের অংশ হিসেবে সিনওয়ারকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া একটি ভয়াবহ ভুল ছিল।
ইসরায়েলিরা মনে করেন, তারা একটি ভ্রান্ত নিরাপত্তা অনুভূতিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তারা বিশ্বাস করেছিল, হামাসকে অর্থনৈতিক প্রণোদনা এবং আরও কাজের অনুমতি দিলে তাদের আন্দোলনটি যুদ্ধের আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু এটি একটি অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয়কর ভুল হিসেবেই প্রমাণিত হয়েছে।
ইয়ারি বলেন, সিনওয়ার নিজেকে 'ফিলিস্তিন মুক্ত করার জন্য নিয়তিবদ্ধ ব্যক্তি' হিসেবে দেখতেন এবং 'গাজার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বা সামাজিক পরিষেবার উন্নতির' ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ ছিল না।
২০১৫ সালে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে সিনওয়ারকে 'বিশেষভাবে মনোনীত বৈশ্বিক সন্ত্রাসী' হিসেবে তালিকাবদ্ধ করে। ২০২১ সালের মে-তে ইসরায়েলি বিমান হামলাগুলো চালানো হয় সিনওয়ারের বাড়ি এবং দপ্তরগুলোকে লক্ষ্য করে। ২০২২ সালের এপ্রিলে টেলিভিশনে এক ভাষণে জনগণকে যেকোনো উপায়ে ইসরায়েলকে আক্রমণ করার জন্য উৎসাহিত করেন।
বিশ্লেষকরা সিনওয়ারকে হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরো ও এর সশস্ত্র শাখা ইজ্জাদিন আল-কাসসাম ব্রিগেডের মূল ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত করেন।
২০২৩ সালের ১৪ অক্টোবর ইসরায়েল সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র সিনওয়ারকে 'শয়তানের প্রতিচ্ছবি' বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও বলেন, "সিনওয়ার ও তার পুরো দল আমাদের নজরদারিতে আছে। আমরা ওই ব্যক্তির কাছে পৌঁছাবো।"
সিনওয়ার ইরানেরও ঘনিষ্ঠ ছিলেন। একটি শিয়া দেশের সঙ্গে একটি সুন্নি আরব সংগঠনের সম্পর্ক সুস্পষ্ট নয়। তবে উভয়েরই লক্ষ্য হলো, ইসরায়েল রাষ্ট্রকে শেষ করা এবং জেরুজালেমকে ইসরায়েলি দখল থেকে 'মুক্ত' করা।
তারা একসঙ্গে কাজ করতে শুরু করেছে। ইরান হামাসকে অর্থায়ন, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করে। এভাবে হামাসের সামরিক সক্ষমতা তৈরি এবং হাজার হাজার রকেটের একটি অস্ত্রাগার তৈরিতে সাহায্য করে ইরান।
২০২১ সালে সিনওয়ার একটি ভাষণে ইরানের এ সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, "ইরান যদি না থাকত, ইসরায়েলকে প্রতিরোধে ফিলিস্তিনের এ সক্ষমতা থাকতো না।"
ইয়াহিয়া সিনওয়ারের মৃত্যু হামাসের জন্য একটি বড় ধাক্কা।
আগস্টে হানিয়ার মৃত্যুতে হামাস যখন সিনওয়ারকে গোষ্ঠীর প্রধান নেতা হিসেবে নির্বাচিত করে তখনই এটি তাদের জোরালো প্রতিবাদ ও স্থিতিশীলতার সচেতন পদক্ষেপ ছিল। তার চেয়ে আরও আপোষহীন ব্যক্তিত্ব গোষ্ঠীতে আর কেউ ছিল না।
গাজা উপত্যকায় চলমান ইসরায়েলী সামরিক বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ বন্ধে চুক্তি করতে চায় কিনা, সিদ্ধান্ত এখন হামাসের হাতে। কিংবা এর বিপরীতও হতে পারে। তারা এ যুদ্ধ এবং প্রতিরোধ চালিয়ে যেতে পারে। যদিও এ সংঘাত ইতোমধ্যে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের ওপর বড় বিপর্যয় ডেকে এনেছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন সম্প্রতি বলেছেন, গাজার মধ্যে একটি অস্ত্রবিরতি চুক্তি '৯০ শতাংশ সম্পন্ন' হয়েছে। সিনওয়ারের মৃত্যু সেই চুক্তি সম্পন্ন করার এবং ইসরায়েলী জিম্মিদের দেশে ফিরিয়ে আনার একটি সুযোগ হতে পারে।
তবে এর বিপরীতও ঘটতে পারে। কারণ ক্ষুব্ধ হামাস সদস্যরা যেকোনো ধরনের আপস থেকে নিজেদের আরও দূরে ঠেলে দিতে পারে।
অনুবাদ: সাদিয়া আফরিন রেনেসাঁ