সন্তানদের পরনে ছেঁড়া জামা-জুতো দেখে বুক ভেঙে যাচ্ছে গাজার বাবা-মায়ের
ইসরায়েলের হামলায় গাজায় যারা বাস্তুচ্যুত হয়েছেন তাদের একজন ৩৪ বছর বয়সী রাওয়ান বদর। এখন তিনি সন্তানদের নিয়ে বাস্তুচ্যুত একটি শিবিরে থাকছেন। তিনি যে ঘরটিতে থাকেন, সেই ঘরের বাইরে রোদে কিছু জামা-কাপড় শুকাতে দিচ্ছিলেন তিনি। তার চোখে-মুখে তখন ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। পাশেই খেলছিল তার ছয় বছর বয়সী মেয়ে মাসা।
রাওয়ান জানালেন, যুদ্ধের আগে তিনি রঙ-বেরঙয়ের বাহারি সব পোশাক পরতে পছন্দ করতেন। বন্ধুদের সেগুলো দেখাতেও ভালো লাগত তার। কিন্তু এখন তার পোশাকগুলোর অবস্থা শোচনীয়। সব পোশাকই মলিন, ছেঁড়া। তার ঘরের মেঝেতে দেখা গেল, কয়েকটি শার্ট ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
গত বছরের অক্টোবরে ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা শুরু হলে গাজা সিটি থেকে বাস্তুচ্যুত হয় রাওয়ানের পরিবার। তার স্বামী আহমেদ (৩৮)। এ দম্পতির চার সন্তান। ইয়ারা (১১), মোহাম্মাদ (৮), মাসা (৬) ও খালেদ (৩)।
ঘরবাড়ি ছাড়ার সময় তারা খুব বেশি কিছু সঙ্গে নিতে পারেননি, কেবল জরুরি প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস ছাড়া। তারা ভেবেছিলেন খুব শিগগিরই হয়ত বাড়িতে ফিরবেন। কিন্তু তাদের সে আশায় গুড়ে বালি।
রাওয়ান বলেন, ''আমি সবকিছু ছেড়ে এসেছি। মাসা আমাকে মাঝে মাঝে তার পোশাকগুলোর কথা জিজ্ঞাসা করে। ওর সবকয়টি জামার কথাই ওর মনে আছে। ঈদের লাল জামাটির কথাও জিজ্ঞাসা করে। ওর পছন্দের একটি পায়জামা ছিল, সেটির কথাও জানতে চায়। আমি জানি না ওর এসব প্রশ্নের উত্তর কীভাবে দিতে হয়।''
এখন রাওয়ানের সন্তানদের পরার জন্য ভালো কোনো পোশাক নেই। প্রতিদিন তারা একই জামা-কাপড় পরে। আর ঘন ঘন ধুয়ে দেওয়ার কারণে সেসব জামা-কাপড়ের অবস্থাও ভালো না।
রাওয়ান বলেন, ''প্রতিদিনই আমি ওকে বলি 'আগামীকাল' আমরা বাড়ি ফিরব। আমি মিথ্যা বলি। আমরা তো আর ফিরতে পারব না।''
কথাগুলো শেষ না হতেই খোলা আগুনের ওপর বসানো রান্না হলো কি না, তা দেখতে গেলেন রাওয়ান।
রাওয়ানের হাতে যখন খরচের মতো টাকা থাকে, তখন অন্য অভিভাবকের মতো তিনিও সন্তানদের জন্য এটা-ওটা কিনে থাকেন। কিন্তু এখন গাজায় বেছে বেছে সন্তানদের জন্য মানানসই পোশাক কেনার মতো অবস্থা বা সুযোগ কোনোটিই তার নেই। যেসব পোশাক পাওয়া যায়, সেগুলোও দেখা যায় মাপে হয় না, কোনোটা ছোট, কোনোটা বা বড়। বাধ্য হয়ে এগুলোই কিনতে হয় ক্রেতাদের।
রাওয়ান সন্তানদের জন্য পোশাক কেনার পর সেগুলো নিয়ে আবার দর্জির কাছে যেতে হয় তাকে। দর্জির কাছ থেকে সন্তানদের যার যার শরীরের মাপমতো সেগুলো ঠিকঠাক করে আনতে হয়।
সন্তানদের ব্যবহৃত কাপড়গুলো ছিঁড়ে গেলে রাওয়ান নিজেই সুই-সুতা দিয়ে সেগুলো সেলাই করে দেন। একবার মাসাকে প্রায় ৪০ ডলার দিয়ে জুতা কিনে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। আর এ কারণে পরিবারটি পুরো এক সপ্তাহ খাবার কিনতে পারেনি।
গাজায় এখন দর্জি আর মুচিরা সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত। মধ্য গাজার দেইর আল-বালাহ মার্কেটের পথের ধারে ধারে তাদের দেখা মেলে।
মার্কেটটিতে বাস্তুচ্যুত আর ক্লান্ত মানুষের অভাব নেই, যারা বাজারের এদিক থেকে ওদিকে ছুটছেন। কেউ খাবার খুঁজছেন, কেউ খুঁজছেন অন্য কোনো প্রয়োজনীয় জিনিস। এসব মানুষের মধ্যে এমন বহু মানুষ রয়েছেন, যাদের আসলে কোনো কিছুই কেনার সামর্থ্য নেই।
রাস্তার এক কোণে সেলাই মেশিন নিয়ে বসেছেন ২৭ বছর বয়সী রায়েদ বারবাখ। তিনি সেখানে এক জোড়া ট্রাউজার সেলাই করছিলেন। তার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন এক পুরুষ ও এক নারী। তারাই ট্রাউজারটি সেলাইয়ের জন্য নিয়ে এসেছেন।
বারবাখ নিজেও একজন উদ্বাস্তু। বাড়ি ছেড়ে আসার সময় তিনি তার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস সেলাই মেশিনটি নিয়ে দেইর-আল-বালায় এসেছেন। তিনি বললেন, ''আমি প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত করি। কাপড় সেলাই করাতে ও শরীরের মাপমতো ঠিকঠাক করে নিতে বহু কাস্টমার আসে।''
বারবাখ জানালেন, কিছুদিন আগে এক ব্যক্তি তার একটি শার্ট নিয়ে এসেছিলেন। তিনি সেটি কেটে তার তিন বছর বয়সী বাচ্চার জন্য দুটি শার্ট বানিয়ে দিতে বলেন। ওই ব্যক্তির চাকরি ছিল না। তাই সন্তানের জন্য নতুন জামা কেনার টাকাও তার ছিল না। সন্তানকে খুশি করতে তাই নিজের শার্টটিই নিয়ে এসেছিলেন তিনি।
বারবাখের পাশে জুতা সেলাইয়ের কাজ করছিলেন ৪০ বছর বয়সী সাইদ হাসান। তিনি এসেছেন দেইর আল-বালাহ থেকে। নিয়মিত এ বাজারেই বসেন তিনি। এছাড়া মাঝেমধ্যে বাস্তুচ্যুত বিভিন্ন শিবিরে ঘুরে ঘুরে লোকেদের জুতা, ব্যাগ সেলাই করে দেন।
হাসান জানালেন, কখনও কখনও লোকেরা তার কাছে এমন জুতা নিয়ে আসে, যেগুলো আসলে সেলাই করেও পায়ে দেওয়ার উপযোগী করার মতো না। এরপরও তারা সেটি সেলাই করে দিতে বলেন, যাতে কোনো রকমে হলেও সেটি পরা যায়।
একদিন এক ব্যক্তি কয়েক টুকরো ফোম নিয়ে এসে হাসানকে বলেছিলেন, এগুলো দিয়ে তার বাচ্চাদের জন্য জুতা বানিয়ে দিতে।
হাসান বললেন, একে তো আমি জুতা বানাতে পারি না। কারণ, জুতা বানানোর জন্য নির্দিষ্ট সরঞ্জাম প্রয়োজন, যা আমার কাছে নেই। আর দ্বিতীয়ত আপনি আমাদের রাস্তাগুলোর দিকে তাকান। আমাদের ধ্বংস হওয়া রাস্তাগুলোয় লোহাও টেকে না। সেখানে ফোমের জুতা কীভাবে টিকবে?
তিনি আরও বলেন, "সত্যিই তাদের এখনকার মতো খারাপ অবস্থা আমি এর আগে কখনও দেখিনি। বাচ্চাদের ভালো রাখার জন্য তারা (বাবা-মা) যতটা কষ্ট সইছেন, তা সত্যিই অসহনীয়।''
অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক