ইউরোপে এটিএম থেকে লাখ লাখ টাকা লুট করছে অপরাধীরা, জার্মানি কেন মূল লক্ষ্য
২০২৩ সালের ২৩ মার্চ প্রথম প্রহরে জার্মানির ক্রোনবার্গ শহরের বাসিন্দারা কয়েকটি বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম থেকে জেগে ওঠেন।
একদল অপরাধী শহরের কেন্দ্রস্থলে থাকা একটি ফ্ল্যাট ভবনের নিচের এটিএম মেশিন বোমা দিয়ে উড়িয়ে দেয়। এতে ভবনের গুরুতর ক্ষতি হয় এবং বাসিন্দাদের সরিয়ে ফেলা হয়। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের মতে, প্রত্যক্ষদর্শীরা কালো পোশাক পরা কয়েকজনকে একটি কালো গাড়িতে চেপে পাশের মহাসড়কের দিকে পালিয়ে যেতে দেখেছেন।
দুর্বৃত্তরা ১ লাখ ৩০ হাজার ইউরো নিয়ে যায় এবং এতে অর্ধ মিলিয়ন ইউরোর সমপরিমাণ ক্ষতি হয় বলে জার্মানির ফেডারেল ক্রিমিনাল পুলিশ অফিস জানায়। ফেডারেল ক্রিমিনাল পুলিশ অফিস (বিকেএ) এর এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংক ডাকাতির পরিবর্তে, ইউরোপের অপরাধী গোষ্ঠীগুলো এটিএম মেশিনকে সহজ এবং কম ঝুঁকিপূর্ণ লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিচ্ছে।
ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ জার্মানিতে গত কয়েক বছর ধরে প্রায় প্রতিদিনই এটিএম মেশিন লুট করার ঘটনা ঘটছে। দেশটিতে নগদ লেনদেন এখনও প্রচলিত থাকায় এমন ডাকাতি অনেক বেশি লাভজনক। অপরাধীরা একটি এটিএম মেশিন লুট করে সেখান থেকেই লাখ লাখ ইউরো নিয়ে যেতে পারে।
ইউরোপোল এ ধরনের ডাকাতির ঘটনা কমাতে বড় ধরনের আন্তঃসীমান্ত অভিযান পরিচালনা করছে; যার মূল লক্ষ্য হলো, সুসংগঠিত অপরাধী চক্রকে নির্মূল করা।
এ মাসের শুরুর দিকে জার্মানি, ফ্রান্স এবং নেদারল্যান্ডসের কর্তৃপক্ষ বিস্ফোরক ব্যবহার করে এটিএম আক্রমণের সাথে জড়িত একটি অপরাধী চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে বলে ইউরোপোল এক বিবৃতিতে জানায়।
এ ঘটনায় ২০২২ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে যাদের আটক করা হয়েছে,তারা মিলিয়ন মিলিয়ন ইউরো লুট করেছেন এবং সমপরিমাণ সম্পত্তির ক্ষতি করেছেন বলে জানায় ইউরোপোল।
অপরাধী গোষ্ঠীটি ফ্রান্সের বিভিন্ন জায়গাকে "লুকানোর স্থান" হিসেবে ব্যবহার করছে এবং ফরাসি একটি ভাড়া গাড়ির কোম্পানির গাড়ির ওপর নির্ভর করেছে বলে ইউরোপোলের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
জার্মানি, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসের তদন্তকারীদের একটি বৃহত্তর অভিযানের অংশ হিসেবে এসব গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধের স্থান থেকে পালানোর জন্য ব্যবহৃত গাড়ি তিন দেশের বিভিন্ন স্থানের যেসব কোম্পানি থেকে ভাড়া নেওয়া হয়েছে, সেখানে তল্লাশি চালিয়েছে।
ইউরোপোল জানিয়েছে, অপরাধীরা মূলত আতশবাজি থেকে তৈরি কঠিন বিস্ফোরক ব্যবহার করে এটিএমগুলো উড়িয়ে দেয়। এটি একটি বিপজ্জনক পদ্ধতি এবং এতে ব্যাপক ক্ষতি হয়। ২০২৩ সালে জার্মানিতে এটিএম ডাকাতির কারণে ২৮.৪ মিলিয়ন ইউরোর অতিরিক্ত ক্ষতি হয়েছে বলে বিকেএ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এই গ্যাংগুলোর অধিকাংশ নেদারল্যান্ডসে ভিত্তিক। এরা ডাকাতির সময় এবং দ্রুত গাড়িতে পালানোর সময় বড় ঝুঁকি নেয় এবং নিরাপত্তার বিষয়ে কোনও চিন্তা করে না। তারা সাধারণত শান্ত ও আবাসিক এলাকার এটিএমগুলোকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নির্বাচন করে কারণ এগুলো আক্রমণ করা সহজ। এই আক্রমণগুলো বিল্ডিংয়ের ক্ষতি করতে পারে, যা বাসিন্দাদের জন্য বিপজ্জনক।
কিছু ক্ষেত্রে, এই আক্রমণগুলো প্রাণঘাতী হতে পারে।
গত ১১ নভেম্বর জার্মানির ভিয়ার্নসহেইমে একটি এটিএম ডাকাতির ঘটনা বাজেভাবে শেষ হয়। ৪০ হাজার ইউরো চুরির পর ডাচ অপরাধীদের একটি ত্রয়ী একটি চুরি হওয়া নম্বরপ্লেট লাগানো ভিডব্লিউ গলফ গাড়ি নিয়ে দ্রুত পালানোর চেষ্টা করে। পুলিশ যখন তাদের তাড়া করে তখন তারা এ৬ মহাসড়কের বিপরীত দিকে গাড়ি চালানো শুরু করে।
তিনজনের মধ্যে দুইজন একটি বিশ্রাম স্থলে ধরা পড়েন। কিন্তু ৩০ বছর বয়সী চালক পালিয়ে যায় এবং ঘণ্টায় ২০০ কিলোমিটার গতিতে বিপরীত দিকে গাড়ি চালিয়ে একটি ভ্যানে আঘাত করে।
ভ্যানের চালক এবং যাত্রী উভয়ই গুরুতর আহত হন এবং আহত যাত্রী কিছুদিন পর হাসপাতালে মারা যান। গলফ ভ্যানের চালক গুরুতর আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার হন এবং পরে তাকে আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
বাড়ছে অপরাধের হার
জার্মানি বর্তমানে ইউরোপে এটিএম বোমা হামলার প্রধান লক্ষ্য। দেশটির নগদ অর্থ ব্যবহারের প্রবণতা এই অবস্থাকে সহজ করেছে।
জার্মানিতে ৫১ হাজারের বেশি এটিএম রয়েছে আর নেদারল্যান্ডসে এটিএম-এর সংখ্যা ৫ হাজার। জার্মানির ৮৩.৩ মিলিয়ন নাগরিকের অধিকাংশই তাদের নিকটস্থ এটিএমের কাছে এক কিলোমিটারের মধ্যে বাস করেন। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বুন্দেসব্যাংক-এর প্রতিবেদনে তথ্য দেওয়া হয়েছে।
কোভিড-১৯ মহামারির কারণে অনেক ইউরোপীয় দেশ নগদ অর্থ ব্যবহার কমিয়ে দিলেও, জার্মানিতে এখনও নগদ অর্থ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বুন্দেসব্যাংক-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সকল লেনদেনের অর্ধেক নগদ অর্থ দিয়ে সম্পন্ন হয়েছে।
জার্মানির জনগণ নগদ অর্থকে নিরাপদ পেমেন্ট পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনা করে। এটি তাদের গোপনীয়তা বাড়ায় এবং ব্যয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখে। ২০১৬ সালে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রবীণ জার্মানরা নগদ ব্যবহার করেন বেশি। দেশটির অতীতের কঠিন স্মৃতির প্রভাবে এমনটি হতে পারে বলে ধারণা করা হয়।
বুন্দেসব্যাংক-এর জনাথন বেয়ারম্যান বলেন, "ডিজিটালাইজেশন বা মহামারি নগদ অর্থের জনপ্রিয়তা কমাতে পারেনি। লেনদেনের ক্ষেত্রে নগদ অর্থ এখনও জার্মানিতে সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম।"
জার্মানির ভৌগলিক অবস্থানও দেশটিকে সীমান্তের অপরাধীদের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলেছে। নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে সীমান্ত এবং অনেক দ্রুত গতির হাইওয়ে থাকায় দেশটিতে এমন অপরাধ বেশি ঘটছে। নেদারল্যান্ডসে এটিএম কমে যাওয়া এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের কারণে অপরাধীরা জার্মানিতে সহজ লক্ষ্য খুঁজছে বলে জানিয়েছে নেদারল্যান্ডসের পুলিশ।
২০২৩ সালে বিকেএ-এর প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জার্মানিতে এটিএম ডাকাতির সংখ্যা ২০০৫ সাল থেকে বাড়ছে। তবে, ২০২২ থেকে ২০২৩ সালে এ হার কিছুটা কমেছে। তবুও, ২০২৩ সালে জার্মানিতে মোট ৪৬১টি ডাকাতির ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। ২০০৫ সালে জরিপ শুরু হওয়ার পর এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পূর্ববর্তী বছরের মতো ২০২৩ সালে গ্রীষ্মের মাসগুলোতে ডাকাতির সংখ্যা কমেছে। কারণ এই সময় দিনের আলো দীর্ঘ হওয়ার কারণে ধরা পড়ার ঝুঁকি বাড়ে। বিকেএ-এর প্রতিবেদন অনুসারে, অধিকাংশ অপরাধ কর্মদিবসের সময় রাত ২টা থেকে ৫টার মধ্যে ঘটেছে।
জার্মান ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রি কমিটির এক মুখপাত্র সিএনএনকে বলেন, "জার্মানিতে ইউরোপের অন্যতম বিস্তৃত এটিএম নেটওয়ার্ক রয়েছে। এই বিস্তৃত নেটওয়ার্ক কিছুটা বিদেশি সংগঠিত অপরাধী গোষ্ঠীগুলিকে আকৃষ্ট করেছে। তারা এটিএমের ঘনত্ব এবং জার্মানির নগদ অর্থের চাহিদাকে নিজেদের সুবিধা হিসেবে দেখছে।"
মুখপাত্র আরও জানান, জার্মান ব্যাংকগুলো সমস্যা সমাধানে উন্নত নিরাপত্তার পেছনে ৩০০ মিলিয়ন ইউরোরও বেশি বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, "অ্যালার্ম সিস্টেম, কালির দাগ দেওয়ার সমাধান, শক্তিশালী লকিং মেকানিজম এবং ফগিং প্রযুক্তি।" তবে, বর্তমানে জার্মানিতে নগদ অর্থ চুরি হওয়া কমানোর করার জন্য কিছু প্রযুক্তি যেমন আঠা ব্যবহারের সিস্টেম অনুমোদিত নয়।
মুখপাত্র বলেন, "এই প্রচেষ্টা এবং পুলিশের সঙ্গে বাড়তি সহযোগিতা এটিএম হামলার সংখ্যা কার্যকরভাবে কমিয়েছে। এর ফলে বিকেএ জানিয়েছে, ২০২৪ সালের চুরির সংখ্যা ইতোমধ্যে 'গত বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম'।"
জুলাইয়ে জার্মান সরকার ঘোষণা করেছে, এটিএম ডাকাতির ক্ষেত্রে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। ডাকাতদের ন্যূনতম দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হবে, যেখানে পূর্বের ন্যূনতম শাস্তি ছিল এক বছর। যদি কোনো অপরাধী কোনো ব্যক্তির স্বাস্থ্যগত ক্ষতি করে, তবে তাদের পাঁচ থেকে পনেরো বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হবে। পূর্বে এই শাস্তি অন্তত দুই বছর ছিল।
জার্মানির অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী ন্যান্সি ফেজার বলেন, "যারা এটিএম বিস্ফোরণ ঘটায়, তারা অন্য মানুষের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলছে। আমরা এখানে নির্লজ্জ অপরাধীদের এবং অত্যন্ত বিপজ্জনক বিস্ফোরকের মোকাবেলা করছি। সুতরাং এই কর্মকাণ্ডের জন্য কঠোর শাস্তি দেওয়া উচিত।"