রাশিয়ার কুরস্কে উত্তর কোরিয়ার সেনা মোতায়েন করা হয়েছে: ন্যাটো
রাশিয়ার কুরস্ক সীমান্ত অঞ্চলে উত্তর কোরিয়ার সৈন্য মোতায়েন এবং এ অঞ্চলে ইউক্রেনীয় বাহিনীর শক্ত অবস্থান থাকার বিষয়টি প্রথমবারের মতো নিশ্চিত করেছে ন্যাটো।
সোমবার (২৮ অক্টোবর) দক্ষিণ কোরিয়ার নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুত্তে। বৈঠকের পর তিনি জানান, কয়েক সপ্তাহের গোয়েন্দা প্রতিবেদনের পর সৈন্য মোতায়েনের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ন্যাটো প্রধান এই সৈন্য মোতায়েনকে 'উল্লেখযোগ্যভাবে উত্তেজনা বৃদ্ধি' এবং ইউক্রেন যুদ্ধের 'বিপজ্জনক সম্প্রসারণ' হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
গত সপ্তাহে এক সংবাদ সম্মেলনে রুশ ভূখণ্ডে উত্তর কোরিয়ার সৈন্য মোতায়েনের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, "এটি আমাদের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত।" তিনি বলেন, "আমরা এটি ব্যবহার করব কি না; কোথায়, কীভাবে অথবা আমরা কোনো মহড়া, প্রশিক্ষণ বা অভিজ্ঞতা বিনিময় করব কি না, তা আমাদের বিষয়।"
পিয়ংইয়ংয়ের সৈন্যরা রাশিয়ায় সক্রিয় রয়েছে বলে রুত্তের সোমবারের বক্তব্য প্রথমবারের মতো ন্যাটোর আনুষ্ঠানিক স্বীকারোক্তি ছিল। তিনি আরও জানান, উত্তর কোরিয়া ইতোমধ্যেই ইউক্রেনে ব্যবহারের জন্য রাশিয়ায় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং কোটি কোটি গোলাবারুদ পাঠিয়েছে।
রুত্তে বলেন, এর বিনিময়ে প্রেসিডেন্ট পুতিন উত্তর কোরিয়াকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এড়াতে সহায়তা করার জন্য সামরিক প্রযুক্তি ও অন্যান্য সহায়তা পাঠাতে সম্মত হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, এই অংশীদারিত্ব "বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।"
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এর [পূর্বের টুইটার] একটি পোস্টে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন লিখেছেন, "উত্তর কোরিয়ার সৈন্যদের রাশিয়ার আগ্রাসী যুদ্ধকে সমর্থন করার জন্য মোতায়েন করা হয়েছে। এটি এই যুদ্ধের উত্তেজনা বৃদ্ধি করেছে এবং বৈশ্বিক শান্তির জন্য হুমকি।"
উরসুলা আরও জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের সমমনা অংশীদারদের সঙ্গে মিলে এর "প্রতিক্রিয়া জানাবে"।
ঠিক কতজন উত্তর কোরিয়ার সৈন্য রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছে তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে এই মাসের শুরুতে দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, অন্তত ১ হাজার ৫০০ উত্তর কোরিয়ার সৈন্য ইতোমধ্যেই রাশিয়ায় পৌঁছেছে।
সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগ থেকে জানানো হয়, প্রায় ১০ হাজার উত্তর কোরিয়ার সৈন্যকে পূর্ব রাশিয়ায় প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়েছে।
পেন্টাগনের মুখপাত্র সাবরিনা সিং জানিয়েছেন, রাশিয়ায় অবস্থানরত কিছু উত্তর কোরীয় সৈন্য ইউক্রেনের "কাছাকাছি অবস্থানে" পৌঁছেছেন। তিনি আরও বলেন, এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন কারণ তারা রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলে যুদ্ধ বা যুদ্ধ সহায়তায় অংশ নিতে পারে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, উত্তর কোরিয়ার রাশিয়াকে ইউক্রেনে সাহায্য করার বিষয়টি "খুবই বিপজ্জনক"।
রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে তীব্র লড়াই অব্যাহত থাকার মধ্যেই রাশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে হাজার হাজার সৈন্য পুনরায় মোতায়েন করা হয়েছে। এতে ইউক্রেনের অগ্রগতি ধীর হয়েছে।
ইউক্রেন প্রায় ২৫০ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল দখল করেছে। কিন্তু পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়ার গতি উল্লেখযোগ্যভাবে বাধাগ্রস্ত করতে পারেনি। কুরস্কে উত্তর কোরিয়ার সৈন্যদের উপস্থিতি ইউক্রেনীয় বাহিনীর ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
ইউক্রেনের একজন জ্যেষ্ঠ মুখপাত্র নিউইয়র্ক টাইমসকে জানিয়েছেন, প্রায় ৫ হাজার উত্তর কোরীয় বিশেষ সৈন্য সীমান্ত অঞ্চলে রুশ বাহিনীতে যোগ দিতে পারে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি শুক্রবার বলেছেন, তারা [উত্তর কোরীয় সৈন্য] কয়েক দিনের মধ্যেই যুদ্ধে নামতে পারে বলে তার সরকারের কাছে তথ্য আছে।
পশ্চিমা নেতারা সতর্ক করে বলেছেন, এ ধরনের পদক্ষেপ সংঘাত আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। পুতিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র ও বেলারুশের নেতা আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোও এই মূল্যায়নের সাথে একমত প্রকাশ করেছেন। তিনি বিবিসিকে বলেছেন, এ ধরনের পদক্ষেপ "সংঘাত বৃদ্ধির দিকে এক ধাপ" এগিয়ে নেবে।
২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর থেকে রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। এ বছর, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন এবং প্রেসিডেন্ট পুতিন একটি চুক্তি করেছেন। চুক্তি অনুযায়ী, তারা একে অপরকে আক্রমণের বিরুদ্ধে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্র বারবার উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে রাশিয়ায় সামরিক সরঞ্জাম, বিশেষ করে ক্ষেপণাস্ত্র ও উৎক্ষেপণ সরঞ্জাম পাঠানোর অভিযোগ জানিয়ে এসেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাষাগত সমস্যা ও সাম্প্রতিক যুদ্ধে অংশগ্রহণের অভাবের কারণে উত্তর কোরিয়ার সৈন্যদের সহায়তার ক্ষমতা সীমিত হতে পারে।
ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, রুশ সৈন্যরাও উত্তর কোরিয়ার সৈন্যদের কমান্ড ও সরবরাহ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে।
আড়াই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে উভয় পক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ডাচ প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুত্তে জানিয়েছেন, প্রায় ৬ লক্ষাধিক রুশ সৈন্য এ যুদ্ধে নিহত বা আহত হয়েছে।
অন্যদিকে, জেলেনস্কি সম্প্রতি জানান, প্রায় সাড়ে ৬ লাখ রুশ সৈন্য নিহত বা আহত হয়েছে। তিনি বলেন, রাশিয়া তাদের সৈন্যদের মৃতদেহ সংগ্রহ করছে না। ফলে অনেকের মৃতদেহ মাটিতে পচে যাচ্ছে।
উভয় পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিহতের সংখ্যা খুব একটা জানানো হয় না। তবে বিবিসির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, রাশিয়ার ৭০ হাজারেরও বেশি সৈন্য নিহত হয়েছে।
ফেব্রুয়ারিতে জেলেনস্কি জানান, রাশিয়ার পূর্ণাঙ্গ আক্রমণের পর প্রায় ৩১ হাজার ইউক্রেনীয় সেনা নিহত হয়েছে। তবে, পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে জানিয়েছে।