১৫ বছরে প্রথমবার যুক্তরাষ্ট্রে চীনকে পিছনে ফেলে শীর্ষে ভারতীয় শিক্ষার্থীরা
বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চীনা শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার জন্য ও আমেরিকান ড্রিমের আকর্ষণে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিতো। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চীনের কনসালটেন্সি ফার্মগুলো ভালোই প্রসার লাভ করেছিল। অনেক অভিভাবকই সন্তানদের বিদেশে পাঠানো জন্য বিভিন্ন ক্লাস ও ট্রেনিংয়ের পিছনে বড় অঙ্কের অর্থ ঢালতেন।
কিন্তু সেই চিত্র এখন বদলাচ্ছে।
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে চীনা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কমছে। গত শিক্ষাবর্ষে, যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আগতদের মধ্যে ভারতীয় শিক্ষার্থী সবচেয়ে বেশি। ২০০৯ সালের পর প্রথমবারের মতো চীন এই শীর্ষস্থান হারিয়েছে।
গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ননপ্রফিট ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন এ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে আসা বিদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক চতুর্থাংশই চীনা নাগরিক। তবে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও বেড়ে হয়েছে ২৯ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিবর্তন নীতিগত এবং জনমতের পরিবর্তনের প্রতিফলন। অনেক চীনা শিক্ষার্থী এবং তাদের পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে নিরাপত্তা, বর্ণবাদ ও বৈষম্য এবং অভিবাসন সমস্যার বিষয়ে উদ্বিগ্ন। পাশাপাশি, অন্যান্য দেশের বিকল্প সুযোগ এবং চীনের নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নও এই পতনের কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এরই মধ্যে গত বছর ভারত বিশ্বের সর্বাধিক জনসংখ্যার দেশ হিসেবে চীনকে ছাড়িয়ে যায়। দেশটির ৪০ শতাংশেরও বেশি মানুষের বয়স ২৫ বছরের নিচে। এ তরুণ শক্তি বিশ্ব অর্থনীতির নতুন চালিকা শক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। অন্যদিকে, চীনের জনসংখ্যা কমে আসছে এবং সেখানে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত শিক্ষাবর্ষে যুক্তরাষ্ট্রে তিন লাখ ৩১ হাজার ৬০০-এর বেশি ভারতীয় শিক্ষার্থী পড়াশোনা করতে এসেছে।
হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অন কনটেম্পোরারি চায়না অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ডের গবেষক ম্যালি প্রাইথার্চ বলেন, চীনা ও আমেরিকান উভয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে উভয় দেশে গিয়ে পড়াশোনার আগ্রহ কমছে। তিনি জানান, মহামারির সময় তিনি বেইজিংয়ের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আমেরিকার বিষয়ে মতামত নেন।
একসময় চীনের শিক্ষার্থীদের তাদের বাবা-মা ও শিক্ষকরাই বলতেন, "আমেরিকায় যাও, পড়াশোনা কর, ভালো চাকরি পাবে, ভালো জীবন কাটাতে পারবে।" কিন্তু প্রথম মেয়াদে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়া, কোভিড-১৯ মহামারির সময় বর্ণবাদ ও এশিয়াবিরোধী ঘৃণার তীব্রতা এ স্বপ্নকে ভেঙে দেয়। প্রাইথার্চ বলেন, এসব পরিস্থিতির কারণে শিক্ষার্থীরা তাদের 'আমেরিকান ড্রিম' নিয়ে দ্বিধায় আছে।
একটি পরিবর্তিত চীন
২০০০ এর শেষ এবং ২০১০ এর শুরু দিকে চীনের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছিল। এসময়টাতে চীন দ্রুত দরিদ্র মুক্ত হয়েছে শক্তিশালী অর্থনীতিতে রূপ নিতে শুরু করে। সেসময় ১৯৭০ এর দশকের শেষ দিকে শুরু হওয়া সংস্কার এবং উন্মুক্ত নীতির সুফল পেতে শুরু করেছিল চীন।
২০০১ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডাব্লিউটিও) যোগ দেয় চীন এবং ২০০৮ সালে
২০০১ সালে চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) যোগদান এবং ২০০৮ সালের সফল অলিম্পিক আয়োজন দেশটির বৈশ্বিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে। এই সময়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চীনা শিক্ষার্থীদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে।
বর্ধিত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কারণে অনেক চীনা পরিবারও আর্থিকভাবে বিদেশে পড়াশোনার সামর্থ্য অর্জন করে। ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে চীনা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৯৮,২০০, যা ২০১৯ সালে বেড়ে ৩৬৯,৫০০-তে পৌঁছায়।
কিন্তু ২০১৬ সাল থেকে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। ট্রাম্পের প্রথম নির্বাচনী প্রচারণা এবং পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ ও মহামারির সময় সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে।
এর প্রভাব তাদের বিভিন্ন নীতির উপরও পড়ে। ট্রাম্প প্রশাসন চীনের সঙ্গে ফুলব্রাইট প্রোগ্রাম বাতিল করে এবং কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় যুক্তরাষ্ট্রে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ও গণিত (এসটিইএম) বিষয়ে পড়তে আসা চীনের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভিসা দেওয়াও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র এক হাজারের বেশিচীনা শিক্ষার্থী এবং গবেষকের ভিসা বাতিল করে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দায়িত্ব নেওয়ার পরও এই নীতিগুলোর বেশ কয়েকটি বহাল থাকে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, প্রতি মাসে কয়েক শিক্ষার্থীসহ একশরও বেশি চীনা নাগরিক, যুক্তরাষ্ট্র থেকে জোরপূর্বক বহিষ্কৃত হচ্ছেন। চীন এটিকে বৈষম্যমূলক বলে উল্লেখ করেছে। তারা শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষার আহ্বান জানায়।
বেইজিংয়ের সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইবার সিকিউরিটি বিষয়ে স্নাতকোত্তর করা গবেষক লি জিং বলেন, অ্যাকাডেমিক সম্মেলনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্রে ভিসার জন্য তিনবার আবেদন করেও ব্যর্থ হন। এতে তার প্রায় ৬৯০ মার্কিন ডলার খরচ হয়। তিনি বলেন, "আমার অ্যাকাডেমিক পটভূমির কারণে হয়ত ভিসা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।"
কোভিড মহামারি
মহামারির সময় যুক্তরাষ্ট্রে চীনা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে যায় এবং এখনো তা পূর্ণ মাত্রায় ফেরেনি। ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশনের গবেষণা প্রধান মিরকা মার্টেল সোমবার জানান, "গত তিন বছরে চীনের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কমেছে, বিশেষত স্নাতক পর্যায়ে।"
এডুকেশন ফার্স্ট নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্মের তথ্য অনুযায়ী, হংকং এবং ম্যাকাও থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার জন্য আবেদন করা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ১০ শতাংশ কমেছে। প্রতিষ্ঠানটির জেনারেল ম্যানেজার স্টিভেন হোন এ তথ্য জানান।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এমন পরিসংখ্যানে বিস্মিত হননি চীনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা। চীনা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম উইবোতে একজন লিখেছেন, "২০১৮ সালে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং প্রযুক্তিগত বিধিনিষেধ শুরু হওয়ার পর থেকে অনেক (চীনা) শিক্ষার্থীকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে।"
আরেক ব্যবহারকারী বলেন, "আমি আমার সন্তানকে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করতে পাঠাতে চাই না। কারণে সেখানে সহিংসতা, ডাকাতি, বন্দুক সহিংসতা এবং মাদকের মতো নিরাপত্তাজনিত সমস্যা রয়েছে।"
এছাড়া মহামারির সময় এশিয়াবিরোধী বর্ণবাদজনিত অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় নিরাপত্তার নিয়ে উদ্বেগ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদেশি পরিবারগুলোর জন্য বন্দুক সহিংসতা সবসময়ই চিন্তার বিষয় ছিল। তবে মহামারির সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিস্তৃত ব্যবহারের ফলে এই ধরনের হামলার ভিডিও এবং খবরগুলো অনলাইনে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। এর প্রভাব চীনের পরিবারগুলোর উপর আরও বেশি পড়েছে বলে মনে করেন গবেষক ম্যালি প্রাইথার্চ।
মহামারিকালে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ব্যর্থতার প্রভাব চীনা শিক্ষার্থীদের মনে গভীর প্রভাব ফেলেছে, বলেছেন গবেষক ম্যালি প্রাইথার্চ। যদিও চীনের কঠোর জিরো-কোভিড নীতি এবং এর বিশৃঙ্খল সমাপ্তি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ ছিল, তবুও তারা যুক্তরাষ্ট্রে কোভিডের অবাধ বিস্তারকে সরকার ও গণতন্ত্রের ব্যর্থতা হিসেবে দেখেছে।
বেইজিংয়ের এক শিক্ষার্থী প্রাইথার্চকে প্রশ্ন করে বলেন, "আমেরিকায় বলে তুমি স্বাধীন, কিন্তু যদি রাস্তায় যদি নিরাপদে হাঁটতে না পারো, তাহলে সেটি কী স্বাধীনতা?"
এডুকেশন ফার্স্টের স্টিভেন হোনের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার সংখ্যা কমলেও বিদেশে পড়াশোনার আগ্রহ কমেনি। তিনি বলেন, "আমরা যুক্তরাষ্ট্রে সামান্য পতন দেখছি কারণ কানাডা, যুক্তরাজ্য এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে অভিবাসন-সহায়ক নীতি চালু হয়েছে। ফলে অভিভাবকদের জন্য বিকল্পের সংখ্যা বেড়েছে।"
এছাড়া চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মানের উন্নয়নও বড় ভূমিকা রেখেছে। প্রাইথার্চ জানান, অনেক চীনা অধ্যাপক, যারা আগে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াতেন, এখন দেশের উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার কারণে চীনে ফিরে যাচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, এখন অনেক শিক্ষার্থী মনে করেন, আইভি লিগ বা শীর্ষ কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা না করলে মার্কিন ডিগ্রি আর আগের মতো প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা দেয় না। বরং চীনে সরকারি চাকরির স্থিতিশীলতা ও সুবিধার কথা চিন্তা করে অনেকেই ভাবছেন যে বিদেশি ডিগ্রি তাদের এসব ক্ষেত্রে অসুবিধা তৈরি করতে পারে।
তারপরও যুক্তরাষ্ট্র চীনা শিক্ষার্থীদের শীর্ষ গন্তব্য। বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও প্রযুক্তির ওপর স্নাতকের জন্য এখনও যুক্তরাষ্ট্র প্রথম পছন্দ তাদের। এই ক্ষেত্রগুলোর সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং গবেষণা অনুদানের বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত বলে জানান হোন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিয়ান ক্র্যাভেন বলেন, "আমরা চীন থেকে আসা শিক্ষার্থীদের যুক্তরাষ্ট্রে স্বাগত জানাই। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো চীনা শিক্ষার্থীদের গুরুত্ব দেয়।"
তবে এই বার্তা শিক্ষার্থীদের কাছে কতটা চীনা পৌঁছেছে, সেটি ভিন্ন প্রশ্ন। প্রাইথার্চ বলেন, "অনেক শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে পরিবার নিয়ে ভাবছেন এবং মনে করছেন চীন এখন ভালো অবস্থানে রয়েছে। অন্তত এটি নিরাপদ।"
অনুবাদ: সাদিয়া আফরিন রেনেসাঁ