তৈরি হচ্ছে মাত্র তিন মিনিটে; ভবিষ্যতের স্নিকার হবে মোজার মতো হালকা!
সুইস স্নিকার ব্র্যান্ড 'অন' তাদের ব্যতিক্রমী ডিজাইন এবং উদ্ভাবনী প্রযুক্তির জন্য বরাবরই আলোচনায় ছিল। তাদের প্রথম ছিদ্রযুক্ত সোলের জুতা অনেক স্নিকারপ্রেমীর নজর কাড়ে। এখন তারা একটি নতুন ধরনের জুতা বাজারে এনেছে, যা স্প্রে প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি এবং খুবই হালকা—যেন মোজার মতো।
এই নতুন স্নিকারটি তৈরি করতে ব্যবহৃত হচ্ছে এক ধরনের বিশেষ প্রযুক্তি, যেখানে রোবটিক হাতের সাহায্যে পায়ের আকারে একটি ছাঁচ তৈরি করা হয় এবং তার ওপর স্প্রে করে স্নিকারের উপরের অংশ তৈরি করা হয়।
প্রচলিত উৎপাদন পদ্ধতিতে যেখানে আলাদা আলাদা কাপড় কাটা ও সেলাইয়ের প্রয়োজন হয়, তার বদলে একটি পায়ের আকৃতির ছাঁচ রোবটিক হাত দিয়ে ঘোরানো হয়, আর তাতে স্প্রে করলেই তৈরি হয়ে যায় স্নিকার।
লাইটস্প্রে নামে পরিচিত এই নতুন প্রযুক্তিতে মাত্র তিন মিনিটে একটি স্নিকার তৈরি করা সম্ভব। এটি জুতা শিল্পে স্বয়ংক্রিয়তা আনার পথে একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যেখানে প্রচলিত পদ্ধতিতে একটি স্নিকার তৈরি করতে ২০০ জোড়া মানুষের হাতের প্রয়োজন হয়, সেখানে এই পদ্ধতিতে কাজ সম্পন্ন করতে লাগে শুধুমাত্র কয়েকজনের অংশগ্রহণ।
'প্রচলিত প্রক্রিয়ায় যেখানে ২০০ জন মানুষ যুক্ত থাকে, এখানে সেখানে খুবই অল্পসংখ্যক মানুষ কাজ করে,' বলেছেন অন-এর কো-সিইও মার্ক মাওরার।
লাইটস্প্রে প্রযুক্তিতে তৈরি প্রথম জুতা হলো ক্লাউডবুম স্ট্রাইক এলএস। এটি হালকা ওজনের, লেসবিহীন এবং দৌড়বিদদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি। এই জুতার দাম ৩০০ ডলার, যা নাইক এবং অ্যাডিডাসের মতো শীর্ষস্থানীয় পণ্যের তুলনায় প্রতিযোগিতামূলক। তবে, অন ভবিষ্যতে আরও কম মূল্যে স্প্রে-জুতা এবং দৈনন্দিন স্নিকার বাজারজাত করার পরিকল্পনা করেছে।
লাইটস্প্রে প্রযুক্তি বড় পরিসরে ব্যবহার করা সম্ভব হলেও এর সঙ্গে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। ফুটওয়্যার বিশেষজ্ঞ ম্যাট পাওয়েল বলেন, 'এই প্রযুক্তি আকর্ষণীয়, কিন্তু এটি কার্যকর হবে কেবল তখনই যখন এটি সাশ্রয়ী মূল্যে উৎপাদন সম্ভব হবে।'
এছাড়া, এই নতুন জুতার প্রতি গ্রাহকদের গ্রহণযোগ্যতা কতটা হবে, তাও এখনই বলা যাচ্ছে না। অনেকেই এই জুতার আরাম এবং কার্যকারিতার প্রশংসা করেছেন। তবে, কিছু ব্যবহারকারী বলেছেন যে জুতাটি পরতে কিছুটা অসুবিধা হয় এবং এর মোজাসদৃশ গঠন দীর্ঘমেয়াদে টিকবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।
তবে, অন-এর মতে, এই জুতার ভিন্নধর্মী ডিজাইন বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু এটি বাজারে আলোচনার জন্ম দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
২০১৯ সালে মিলান ডিজাইন শোতে এক শিক্ষার্থীর প্রদর্শন থেকেই লাইটস্প্রে প্রকল্পের সূচনা। জোহানেস ফেলচার্ট নামের ওই শিক্ষার্থী শিশুদের হ্যালোউইন খেলনার হট গ্লু স্প্রে পরিবর্তন করে জটিল ত্রিমাত্রিক ফর্ম তৈরির প্রযুক্তি প্রদর্শন করছিলেন। এই প্রযুক্তির সম্ভাবনা বুঝতে পেরে, সুইস স্নিকার ব্র্যান্ড 'অন' তাকে ইন্টার্ন হিসেবে নিয়োগ দেয়।
'আমরা বলেছিলাম, তুমি কাজ করো, আমরা টাকা দেব', আর তাই জোহানেসকে আমরা একটি কর্নার এবং রোবট আর্ম দিয়ে কাজ করার সুযোগ দিয়েছিলাম,' বলেন অন-এর ইনোভেশন বিভাগের সিনিয়র পরিচালক ইলমারিন হেইটজ।
এক বছরের গবেষণার পর, অন একটি ২০ সদস্যের ডেভেলপমেন্ট টিম গঠন করে। এই টিমে মাত্র তিনজনের জুতার ডিজাইন নিয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল। দলে ছিল উপাদান বিজ্ঞানী, থ্রিডি মডেলিং বিশেষজ্ঞ এবং রোবটিক্স বিশেষজ্ঞরা, যারা নতুন উৎপাদন প্রক্রিয়া তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা নিয়ে কাজ শুরু করেন। জোহানেসও ইন্টার্ন থেকে সিনিয়র লিড হিসেবে পদোন্নতি পান।
স্প্রে প্রযুক্তির সূক্ষ্মতা আনতে ছিল নানা চ্যালেঞ্জ। স্নিকারের উপরের অংশ তৈরি হয় পলিমার নামক কৃত্রিম উপাদান দিয়ে, যা তাপমাত্রা এবং মিশ্রণের ওপর নির্ভর করে বিভিন্নভাবে আচরণ করে। শত শত পরীক্ষার পর টিম এমন একটি ফর্মুলা তৈরি করতে সক্ষম হয় যা টেকসই, নমনীয় এবং আরামদায়ক।
'অন' তাদের লাইটস্প্রে প্রযুক্তিকে আরও উন্নত করার পথে এগোচ্ছে। জোহানেস ফেলচার্ট জানিয়েছেন, এই প্রক্রিয়া আরও উন্নত করা সম্ভব, যাতে একজোড়া জুতা তৈরিতে তিন মিনিটের বদলে মাত্র দুই মিনিট সময় লাগে। টিম এখন এমন একটি প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে, যা স্নিকারের সোলসহ সম্পূর্ণ জুতা তৈরি করতে পারবে।
যদিও বড় কারখানাগুলো প্রচলিত পদ্ধতিতে জুতা দ্রুত তৈরি করে, লাইটস্প্রে প্রযুক্তি এই প্রক্রিয়াকে সহজ করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। এখানে কাঁচামাল হিসেবে শুধু পলিমার ব্যবহার করা হয় এবং বেশিরভাগ কাজ মেশিন দিয়ে করা হয়। ফলে এশিয়ার কারখানা থেকে পণ্য পরিবহনের সময় ও খরচ বাঁচানো সম্ভব।
বর্তমানে 'অন'-এর কাছে মাত্র দুটি লাইটস্প্রে মেশিন রয়েছে। তবে, তারা শিগগিরই আরও মেশিন যুক্ত করার পরিকল্পনা করছে, যাতে তারা আরও বেশি পরিমাণে জুতা উৎপাদন করতে পারে।
এই বছর, অন তাদের নতুন জুতা পরীক্ষার জন্য কেনিয়ার দৌড়বিদ হেলেন ওবিরিকে একটি জুতা পাঠায়। প্রথমে সন্দিহান থাকলেও, জুতাটি পরে তিনি ব্যক্তিগত সেরা সময় রেকর্ড করেন। পরে, তিনি বোস্টন ম্যারাথন জিতে নেন এবং প্যারিস অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করেন।
অন-এর বিক্রি ২০২৩ সালে ৪৭ শতাংশ বেড়ে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। তাদের মার্কিন বাজারে অবস্থান শক্তিশালী, যেখানে কোম্পানিটি ২০২১ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়।