ভ্যান গগ, ট্রাম্প, সোনার টয়লেট ও ক্যাটেলানের ৬.২ মিলিয়ন ডলারের কলার সম্পর্ক কোথায়?
ইতালির শিল্পী মরিজিও ক্যাটেলান প্রায়ই সংবাদের শিরোনাম হন। তার 'কমেডিয়ান' (২০১৯) নামক শিল্পকর্ম, ডাক্ট টেপ দিয়ে দেয়ালে আটকানো একটি কলা নিলামকারী প্রতিষ্ঠান সদেবিজ-এর সমকালীন শিল্প নিলামে ৬.২ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি হয়েছে। চীনা বংশোদ্ভূত ক্রিপ্টো উদ্যোক্তা জাস্টিন সান শিল্পকর্মটি কিনে নেন।পরবর্তীতে এক ভিডিওতে শিল্পকর্মটির নতুন মালিক সানকে এক ভিডিওতে কলাটি খেতে দেখা যায় [নিলামে বিজয়ীকে কলা পচে গেলে তা বদলে দেওয়ার (যদি বদলাতে চান) নির্দেশিকা দেওয়া হয়]।
কিন্তু ভ্যান গগের সাথে ক্যাটেলানের কাজের সম্পর্ক কোথায়? ২০১৭ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অফিস নিউইয়র্কের সলোমন আর.গুগেনহাইম মিউজিয়ামের কাছে ভ্যান গগের 'ল্যান্ডস্কেপ উইথ স্নো' (ফেব্রুয়ারি ১৮৮৮) চিত্রকর্ম ধার চেয়েছিল। কিন্তু মিউজিয়াম সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং ট্রাম্পকে তার বদলে ক্যাটেলানের 'আমেরিকা' (২০১৬) নামক ভাস্কর্য, যেটি মূলত ছিল একটি সোনার টয়লেট, সেটি ধার নেওয়ার প্রস্তাব দেয়। এই পালটা প্রস্তাব হোয়াইট হাউজ কর্তৃপক্ষের মনে ধরেনি এবং তারা সেটি উপেক্ষা করে।
গুগেনহাইম মিউজিয়াম জানিয়েছিল, তারা ভ্যান গগের 'ল্যান্ডস্কেপ উইথ স্নো' ধার দিতে পারেনি, কারণ এটি "খুব বিরল পরিস্থিতি ছাড়া কোথাও নিয়ে যাওয়া নিষেধ।" তবে দ্য আর্ট নিউজপেপার-এর অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, মিউজিয়াম পরবর্তীতে ইউরোপের চারটি প্রদর্শনীতে এটি ধার দিয়েছে। প্রদর্শনীগুলো যথাক্রমে, স্পেনের বিলবাও (২০১৮), ফ্রান্সের এক্স-অঁ-প্রোভঁস (২০১৯), ইতালির মিলান (২০১৯) এবং ফ্রান্সের আর্ল-এ (২০২৩) অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সুতরাং, মিউজিয়ামের এই অজুহাত এখন দুর্বল মনে হচ্ছে, কারণ ২০১৮-১৯ সালে ইউরোপের প্রদর্শনীতে চিত্রকর্মটি ধার দেওয়ার প্রস্তাব হোয়াইট হাউজের প্রস্তাবের আগেই এসে থাকতে পারে।
গুগেনহাইমের তৎকালীন প্রধান কিউরেটর ন্যান্সি স্পেক্টর ২০১৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, হোয়াইট হাউজের কিউরেটর ডোনা স্মিথকে একটি ইমেইলে চিত্রকর্মটি ধার দেওয়ার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। তার পরিবর্তে ১৮ ক্যারেট-এর সোনার টয়লেটটি ধার দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, "যদি প্রেসিডেন্ট এবং ফার্স্ট লেডি এটিকে হোয়াইট হাউসে স্থাপন করতে আগ্রহী হন।"
'আমেরিকা' নামক টয়লেটটি গুগেনহাইম সেন্টার ফর ভিজিটরদের জন্য ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে একটি টয়লেট কিউবিকেলে স্থাপন করা হয়েছিল। এটি স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছিল ২০১৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, ঠিক সেদিন যেদিন ন্যান্সি হোয়াইট হাউজের কাছে মেইল পাঠিয়েছিলেন। তাই, সম্ভবত এটি তার মাথায় ছিল এবং তখনই এটি ধার দেওয়ার বিষয়টি তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।
স্পেক্টর হোয়াইট হাউজকে বলেছিলেন: "এটি অবশ্যই অত্যন্ত মূল্যবান এবং কিছুটা ভঙ্গুর, তবে আমরা এর স্থাপন এবং যত্ন নেওয়ার জন্য সমস্ত নির্দেশনা প্রদান করব।" শেষে তিনি বলেন, "আমরা দুঃখিত যে আপনার আসল অনুরোধ [ভ্যান গগের জন্য] পূর্ণ করতে পারিনি, তবে আশা করি এই বিশেষ প্রস্তাবটি আপনার আগ্রহের হতে পারে।"
স্পেক্টরের ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সি সম্পর্কে খোলামেলা মতামত ২০১৭ সালের আগস্টে একটি প্রবন্ধে প্রকাশিত হয়েছিল, যা এখনও গুগেনহাইমের ওয়েবসাইটে রয়েছে। এর শিরোনাম ছিল "ট্রাম্পের যুগে মরিজিও ক্যাটেলানের সোনার টয়লেট"। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সি "স্ক্যান্ডাল দিয়ে চিহ্নিত এবং অসংখ্য নাগরিক অধিকার ভঙ্গ করার উদ্দেশ্যপূর্ণ প্রচেষ্টার মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত। পাশাপাশি এমন একটি জলবায়ু পরিবর্তনকে অস্বীকার করা, যেটি আমাদের গ্রহকে বিপদে ফেলছে।"
"ট্রাম্প মানেই সোনার টয়লেট" উল্লেখ করে স্পেক্টর বলেন, "ক্যাটেলানের ট্রাম্পের আমেরিকা নিয়ে যে ভবিষ্যদ্বাণী, তা হয়ত গুগেনহাইমে ভাস্কর্যটি যতদিন আছে, ততদিনের জন্য একটি স্থায়ী ছাপ হয়ে থাকবে।" তিনি ২০২০ সালে গুগেনহাইম ত্যাগ করেন। তবে সেটি হোয়াইট হাউজের ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল না।
শিল্প ইতিহাসবিদরা হয়ত একদিন ভ্যান গগের অনুরোধের জবাবে স্পেক্টরের পালটা প্রস্তাবকে ধারণাগত শিল্পের একটি মজার রূপ হিসেবে বিবেচনা করবেন।
চুরি হওয়া টয়লেট
হোয়াইট হাউজ গুগেনহেইমের প্রস্তাবটি পুরোপুরি উপেক্ষা করলেও, খুব দ্রুত আরেকটি অনুরোধ আসে, যা প্রায় সমানভাবে অবিশ্বাস্য। এটি আসে এক ডিউকের কাছ থেকে, যিনি যুক্তরাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রাসাদসম বাসভবন ব্লেনহেইম প্যালেসে থাকেন। অক্সফোর্ডশায়ারে অবস্থিত এই প্রাসাদ ডিউক অব মার্লবারোর আবাসস্থল এবং উইনস্টন চার্চিলের জন্মস্থান।
ব্লেনহেইম প্যালেসের একজন কিউরেটর, যিনি একটি ক্যাটেলান প্রদর্শনীর আয়োজন করছিলেন, ২০১৮ সালে গুগেনহাইমকে "আমেরিকা" ধার দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। গুগেনহাইম এতে সম্মতি জানায় এবং সোনার টয়লেটটি চার্চিল একসময় যে টয়লেট কিউবিকলটি ব্যবহার করেছিলেন, সেখানে সংযুক্ত করা হয়। "ভিক্টরি ইজ নট অ্যান অপশন" নামের এই প্রদর্শনী ২০১৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর উদ্বোধন করা হয়।
দুর্ঘটনা ঘটে প্রদর্শনী শুরুর দুই দিন পর। গভীর রাতে চোরেরা ব্লেনহেইম প্যালেসে ঢুকে সোনার টয়লেট "আমেরিকা" চুরি করে নিয়ে যায়। দ্রুত টয়লেটটি খুলে নেওয়ার ফলে সাময়িকভাবে পানিতে ভেসে যায় ভবনটি।
চুরি হওয়ার পর থেকে শিল্পকর্মটির আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, এটি ভেঙে সোনার স্ক্র্যাপ [সোনার ভাঙা টুকরা] হিসেবে বিক্রি করা হয়েছে। ১০৩ কেজি ওজনের এই টয়লেটের বর্তমান স্বর্ণের মূল্য প্রায় ৯ মিলিয়ন ডলার।
২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে একজন ব্যক্তি চুরির দায় স্বীকার করেন এবং তিনজন নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন। মামলার শুনানি আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।
তুষারের দৃশ্য
ভ্যান গগের 'ল্যান্ডস্কেপ উইথ স্নো' বর্তমানে নিউ ইয়র্কের গুগেনহাইম জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে। এই মনোরম ছবিতে একজন মানুষ ও তার কুকুরকে একটি দূরবর্তী খামারের দিকে তুষারের মাঝে হেঁটে যেতে দেখা যায় আর পটভূমিতে রয়েছে মন্টমাঝুর পাহাড়ের সাদা চূড়া।
১৮৮৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভ্যান গগ দক্ষিণ ফ্রান্সের আর্লে পৌঁছানোর দুই দিন পর এই দৃশ্য আঁকেন। এই অঞ্চলে তুষার খুবই অস্বাভাবিক। ভাই থিওকে পাঠানো এক চিঠিতে ভ্যান গগ লিখেছিলেন, "তুষারে ঢাকা প্রাকৃতিক দৃশ্য, সাদা চূড়াগুলো আকাশের সঙ্গে মিলে যেন জাপানি শীতকালীন দৃশ্যের মতো ছিল।" মন্টমাঝুরের চূড়া সম্ভবত তাকে মাউন্ট ফুজির ছবির কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল।
তুষারাচ্ছন্ন ঠান্ডায় কাজ করতে গিয়ে ভ্যান গগ যতই কষ্ট করে থাকুন না কেন, তিনি হয়ত ভাবেননি একদিন তার এই ছবিটি আমেরিকার হোয়াইট হাউজে প্রদর্শনের জন্য চাওয়া হবে।