সাবেক ২ ইসরায়েলি এজেন্ট জানালেন, কীভাবে লেবাননে পেজার হামলা চালানো হয়েছিল
দুজন সাবেক ইসরায়েলি গোয়েন্দা কর্মকর্তা দাবি করেছেন, লেবাননের শিয়া গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ ইসরায়েলে তৈরি ওয়াকিটকি ও পেজার ব্যবহার করেছিল এবং সেগুলোর মধ্যে বিস্ফোরক ছিল। তারা ১০ বছর ধরে এগুলো ব্যবহার করেছে।
এই দুই সাবেক মোসাদ কর্মকর্তার সঙ্গে সিবিএস নিউজের এক সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, হিজবুল্লাহকে ধোঁকা দিয়ে হাজার হাজার ওয়াকিটকি এবং পেজার বিক্রি করা হয়েছিল। তারা জানত না, সেগুলো ইসরায়েলে তৈরি।
সেপ্টেম্বরে লেবাননে দুটি পৃথক ঘটনায় কয়েক হাজার পেজার এবং ওয়াকিটকি বিস্ফোরিত হয়ে বহু লোক নিহত হয় এবং হাজার হাজার মানুষ আহত হয়। ইসরায়েল দাবি করে, হামলা শুধু হিজবুল্লাহ সদস্যদের লক্ষ্য করে ছিল। তবে লেবাননের কর্মকর্তারা জানান, সাধারণ মানুষও হামলার শিকার হয়েছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান এই হামলাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
হামলার সময়, ইসরায়েল এবং হিজবুল্লাহর মধ্যে সংঘর্ষ চলছিল। ২০২৩ সালে ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের একদিন পর থেকেই সংঘর্ষ আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
২০২৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর লেবাননের বিভিন্ন এলাকায় একসাথে হাজার হাজার পেজার বিস্ফোরিত হয়ে ব্যবহারকারীরা ও আশেপাশের মানুষ আহত বা নিহত হন এবং আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
পরদিন একইভাবে ওয়াকিটকির বিস্ফোরিত হয়ে আরও শত শত লোক নিহত বা আহত হয়।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দুই মাস পরে স্বীকার করেন, হামলার জন্য ইসরায়েল দায়ী ছিল। ইসরায়েলি গণমাধ্যম সেই সময় এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
সিবিএসের সাক্ষাৎকারে দুই সাবেক কর্মকর্তার একজন মাইকেল (ছদ্মনাম) জানান, মোসাদ ওয়াকিটকির ব্যাটারির ভেতরে বিস্ফোরক যন্ত্র লুকিয়ে রেখেছিল। এটি সাধারণত ব্যক্তি নিজের পরা ভেস্টের ভেতরে (হৃৎপিণ্ডের কাছাকাছি) নিয়ে চলাচল করত।
তিনি বলেন, ১০ বছর আগে হিজবুল্লাহ না জেনে একটি ভুয়া কোম্পানি থেকে "ভাল দামে" ১৬ হাজারের বেশি ওয়াকিটকি কিনেছিল।
মাইকেল বলেন, "আমাদের কাছে বিদেশী কোম্পানি তৈরি করার অসাধারণ সব উপায় রয়েছে, যেগুলোর কোনোভাবেই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে পারে না। একটি কোম্পানি আরেকটি কোম্পানির মাধ্যমে সরবরাহ চেইনকে আমাদের পক্ষে আনার জন্য কাজ করি।"
তিনি বলেন, "আমরা একটি মিথ্যা দুনিয়া তৈরি করি। আমরা একটি গ্লোবাল প্রোডাকশন কোম্পানি। আমরা স্ক্রিপ্ট লিখি, আমরা পরিচালনা করি, আমরা প্রযোজক, আমরা প্রধান অভিনেতা আর দুনিয়া আমাদের মঞ্চ।"
এই অপারেশনে দুই বছর আগে পেজারও অন্তর্ভুক্ত করা শুরু হয় বলে সিবিএস জানিয়েছে।
মোসাদ বলেছে, হিজবুল্লাহর একটি তাইওয়ানি কোম্পানি গোল্ড অ্যাপোলো থেকে পেজার কেনার বিষয়টি তারা জানতে পেরেছিল। তারা একটি ভুয়া কোম্পানি তৈরি করেছিল। এটি গোল্ড অ্যাপোলো নাম ব্যবহার করে বিস্ফোরক রাখা পেজার বিক্রি করছিল এবং মূল কোম্পানি কিছুই জানত না।
সিবিএস জানায়, মোসাদ পেজারগুলোর মধ্যে এমন বিস্ফোরক রেখেছিল যা শুধু ব্যবহারকারীকে আঘাত করতে পারে।
দ্বিতীয় এজেন্ট গ্যাব্রিয়েল (ছদ্মনাম) বলেন, "আমরা সবকিছু তিন বার, দুই বার, বহুবার পরীক্ষা করি, যাতে ক্ষতি কম হয়।"
তিনি বলেন, মোসাদ হিজবুল্লাহকে পেজার কেনার জন্য ধোঁকা দিয়েছে, বিজ্ঞাপন তৈরি করেছিল এবং সেগুলো ইন্টারনেটে শেয়ার করেছিল।
তিনি বলেন, "তারা আমাদের থেকে কিনছে, তাদের কোনো ধারণাই নেই যে, তারা মোসাদ থেকে কিনছে। আমরা ট্রুম্যান শো'র মতো করি। সব কিছুই আমরা পর্দার আড়ালে থেকে নিয়ন্ত্রণ করি।"
সিবিএস জানিয়েছে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিজবুল্লাহ ৫ হাজার বিস্ফোরক পেজার কিনেছিল।
যখন মোসাদ ভেবেছিল, হিজবুল্লাহ সন্দেহ করতে শুরু করেছে, তখন পেজারগুলো ইসরায়েল থেকে ট্রিগার করা হয়েছিল।
বিস্ফোরণগুলো লেবাননজুড়ে শকওয়েভ তৈরি করেছিল। পেজারগুলো যেখানেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেখানেই বিস্ফোরণ ঘটেছিল। এর মধ্যে সুপারমার্কেটও ছিল। হাসপাতালগুলো আহতদের ঢল সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিল, অনেকেরই অঙ্গহানি হয়েছিল।
গ্যাব্রিয়েল বলেন, তখন এক "শক্তিশালী গুঞ্জন" ছিল, হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহর সামনে কয়েকজন মারা গেছে।
কয়েকদিন পর যখন হিজবুল্লাহ আক্রমণের ধাক্কা সামলাচ্ছিল, তখন ইসরায়েল হিজবুল্লাহর লক্ষ্যবস্তুতে ব্যাপক বিমান হামলা শুরু করে। তারপরে লেবাননে স্থল অভিযান চালায়। পরবর্তীতে, ২৬ নভেম্বর দুই পক্ষ যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে।
লেবানন পেজার ও ওয়াকিটকি হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। আর জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার তুর্ক বলেন, এটি তাকে "বিস্মিত" করেছে।
এই ধরনের হামলার পদ্ধতি নিয়ে তিনি বলেন, "এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এবং প্রযোজ্য হলে, আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘন করে।"