দুর্ঘটনাক্রমে হারানো নগরী আবিষ্কার, মাছির মস্তিষ্ক ম্যাপিং: ২০২৪ সালে বিজ্ঞানজগতের আলোচিত ঘটনা
কোটি কোটি মানুষের প্রত্যক্ষ করা একটি পূর্ণ সূর্যগ্রহণ, দুর্ঘটনাক্রমে আবিষ্কৃত একটি হারানো জঙ্গল নগরী, আর প্রায় বিলুপ্ত উত্তুরে সাদা গন্ডারের টিকে থাকার নতুন আশার আলো—২০২৪ সালে বিজ্ঞানজগত রোমাঞ্চকর অনেক উপহার দিয়েছে আমাদের।
বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল মহাকাশ ভ্রমণকে সাশ্রয়ী ও সহজ করার পথে অগ্রগতি। ইলন মাস্কের স্টারশিপ পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট তৈরির পথে আরও অনেকটা এগিয়ে গেছে।
সব খবরই যে ইতিবাচক ছিল, তা নয়। পৃথিবীর জন্য এমনই একটা খারাপ খবর হলো, ২০২৪ সাল প্রায় নিশ্চিতভাবে ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণ বছর হয়ে থাকবে।
তবে উদযাপনের মতো অনেক ঘটনাও ঘটেছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক বিজ্ঞানজগরের এ বছরের সাতটি আশাজাগানিয়া গল্প।
পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট
অক্টোবরে ইলন মাস্কের কোম্পানি স্পেসএক্সের তৈরি রকেট স্টারশিপ সফলভাবে উৎক্ষেপণের পর সেটির নিম্নাংশ সফলভাবে লঞ্চপ্যাডে ফিরে আসে। বিশ্বের ইতিহাসে প্রথমবার এই ঘটনা ঘটল।
স্পেসএক্সের এই রকেটের নিম্নাংশের বুস্টারটি সমুদ্রে না পড়ে লঞ্চ টাওয়ারে ফিরে এসে ধরা পড়ে দৈত্যাকার যান্ত্রিক বাহুতে, যাকে মজার ছলে বলা হচ্ছে 'চপস্টিক্স'।
এ ঘটনা চাঁদ এবং হয়তো মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার জন্য দ্রুত পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট তৈরির স্বপ্নকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দিল।
এ ঘটনাটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ, এখন পর্যন্ত বিশ্বে যত রকেট প্রস্তুত হয়েছে, সবগুলোই একবার ব্যবহারযোগ্য।
মাছির মস্তিষ্কের রহস্য উন্মোচন
হাঁটা, বাতাসে ভেসে থাকা, সঙ্গিনীকে প্রেমের গান শোনানো—মাছি (ফ্রুটফ্লাই) এসব কিছুই করে সূচের ডগার চেয়েও ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক দিয়ে।
চলতি বছরের অক্টোবরে বিজ্ঞানীরা এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষের অবস্থান, গড়ন এবং ১ লাখ ৩০ হাজার কোষ ও তাদের মধ্যে ৫০ মিলিয়ন নিউরাল সংযোগের পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র তৈরি করেছেন।
এটিই কোনো পূর্ণবয়স্ক প্রাণীর মস্তিষ্কের সবচেয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ। একজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, মানবমস্তিষ্ক বোঝার পথে এটি 'বিশাল অগ্রগতি'।
একজন মুখ্য গবেষক বলেছেন, চিন্তার প্রক্রিয়া কীভাবে কাজ করে, এ নিয়ে নতুন আলোকপাত করবে এই গবেষণা।
'দুর্ঘটনাক্রমে' আবিষ্কার করা হারিয়ে যাওয়া মায়া নগরী
ইন্টারনেটে ডেটা ব্রাউজ করার সময় 'দুর্ঘটনাক্রমে' মেক্সিকোর জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন মায়া সভ্যতার শহর আবিষ্কার করেছেন লুক অল্ড-থমাস নামে একজন প্রত্নতাত্ত্বিক।
মেক্সিকোর দক্ষিণ-পূর্ব রাজ্য ক্যাম্পেচেতে অবস্থিত প্রাচীন এই নগরীতে পাওয়া গেছে পিরামিড, খেলার মাঠ, জেলা সংযোগকারী সড়ক ও অ্যাম্ফিথিয়েটার। শহরটির নাম রাখা হয়েছে ভ্যালেরিয়ানা।
প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধারণা করছেন, প্রাচীন লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে বড় মায়া শহর ক্যালাকমুলের পরেই এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম মায়া শহর।
শহরটি ৭৫০ থেকে ৮৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার মানুষের আবাসস্থল ছিল বলে ধারণা করা হয়।
শহরটি আবিষ্কার করা হয়েছে লিডার প্রযুক্তির সাহায্যে। এটি এক ধরনে লেজার জরিপ, যা গাছপালার নিচে লুকিয়ে থাকা কাঠামোর মানচিত্র ফুটিয়ে তোলে।
শহরটির আয়তন ছিল প্রায় ১৬.৬ বর্গ কিলোমিটার এবং এর দুটি প্রধান কেন্দ্র ছিল। কেন্দ্রের ২ কিলোমিটার এর মধ্যে বড় বড় ভবন ছিল। ভবনগুলো ঘন বসতি এবং সড়কের মাধ্যমে সংযুক্ত ছিল। শহরটিতে দুটি প্লাজা ছিল। এছাড়াও সেখানে একটি আদালত ছিল। গবেষণায় একটি জলাধারের প্রমাণও মিলেছে।
প্রথমবারের আইভিএফের মাধ্যমে গন্ডারের গর্ভধারণ
বিশ্বে মাত্র দুটি উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডার বেঁচে আছে। তবে সম্প্রতি এক বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি এই বিপন্ন প্রজাতিটিকে রক্ষার নতুন আশার আলো দেখিয়েছে।
বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো গবেষণাগারে তৈরি একটি গন্ডার ভ্রূণ সফলভাবে একটি সারোগেট মা গন্ডারের গর্ভে প্রতিস্থাপন করেছেন।
১৩ বারের প্রচেষ্টায় প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হয়। পরীক্ষাটি করা হয়েছিল দক্ষিণাঞ্চলীয় সাদা গন্ডারদের ওপর, যারা উত্তরাঞ্চলী গন্ডারের নিকটাত্মীয় এবং এখনও কয়েক হাজার টিকে আছে।
ভ্রূণ প্রতিস্থাপন করা মা গন্ডারটি সংক্রমণে মারা যায়। তবে ময়নাতদন্তে দেখা যায়, তার গর্ভে প্রতিস্থাপন করা ৬.৫ সেন্টিমিটার আকারের পুরুষ ভ্রূণটি সুস্থভাবেই বেড়ে উঠছিল এবং জীবিত জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা ছিল ৯৫ শতাংশ।
এই পরীক্ষা প্রমাণ করে যে আইভিএফের মাধ্যমে গন্ডারের সফল গর্ভধারণ সম্ভব।
বর্তমানে ৩০টি উত্তরাঞ্চলীয় সাদা গন্ডারের ভ্রূণ সংরক্ষণ করা আছে। পরের ধাপে সেগুলো ব্যবহার করে আইভিএফের মাধ্যমে গর্ভধারণ করানোর চেষ্টা চালানো হবে।
সংরক্ষণের প্রচেষ্টায় প্রকৃতি ধ্বংস কমেছে
প্রকৃতি সংরক্ষণ সংগঠন ডব্লিউডব্লিউএফ মানুষের কার্যক্রমের কারণে জীববৈচিত্র্যের 'বিপর্যয়কর ক্ষতি' নিয়ে বারবার সতর্ক করে আসছে। মাঝে মাঝে মনে হতো, তাদের এসব সতর্কবাণী কোনো কাজেই আসছে না।
কিন্তু ১০ বছরব্যাপী এক গবেষণায় উঠে এসেছে ইতিবাচক খবর। এতে দেখা গেছে, সংরক্ষণমূলক পদক্ষেপগুলো বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি কমাতে কার্যকর হয়েছে।
বিভিন্ন দেশ ও মহাসাগরে পরিচালিত ৬৬৫টি সংরক্ষণ প্রকল্প পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দুই-তৃতীয়াংশ উদ্যোগই ইতিবাচক ফল দিয়েছে।
এসব উদ্যোগের মধ্যে ছিল চিনুক স্যামনের ডিম ফুটিয়ে ছাড়ার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে আক্রমণাত্মক শৈবাল নির্মূলের উদ্যোগ।
গবেষকরা এই ফলাফলকে "প্রকৃতি রক্ষাকারীদের জন্য এক আশার আলো" বলে বর্ণনা করেছেন।
কোটি কোটি মানুষকে মুগ্ধ করেছে যে সূর্যগ্রহণ
মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাজুড়ে কোটি কোটি তাকিয়ে ছিল আকাশ পানে, দেখেছিল এক অবিশ্বাস্য পূর্ণ সূর্যগ্রহণ।
চাঁদ যখন পৃথিবী আর সূর্যের মাঝে এসে সূর্যের আলো ঢেকে দেয়, তখন এই বিরল ঘটনাটি ঘটে।
প্রতি ১৮ মাস পরপর পৃথিবীর কোথাও না কোথাও পূর্ণ সূর্যগ্রহণ ঘটে, তবে বেশিরভাগ সময় তা হয় জনবিরল এলাকায়। তবে এবার যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসসহ বড় শহরগুলো পড়েছিল সূর্যগ্রহণের পথে।
এ বছরের সূর্যগ্রহণ ছিল আগের চেয়ে, বিশেষ করে ২০১৭ সালের অসাধারণ সূর্যগ্রহণের তুলনায় অনেক বিস্তৃত।
প্রিয় 'সিকামোর গ্যাপ' থেকে নতুন জীবন
ব্রিটেনের প্রাচীন হ্যাড্রিয়ানের প্রাচীরে জায়গা করে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা 'সিকামোর গ্যাপ' নামের বিখ্যাত গাছটি দেখতে একসময় লাখ লাখ মানুষ আসত। এই জমির আগের মালিক জন ক্লেটন ১৮০০-র দশকে গাছটি রোপণ করেছিলেন।
ভ্রমণার্থী ও ফটোগ্রাফারদের কাছে নিঃসঙ্গ গাছটির বিশেষ জনপ্রিয় ছিল। ১৯৯১ সালে 'রবিনহুড: প্রিন্স অভ থিভস' সিনেমায় দেখানোর পর 'সিকামোর গ্যাপে'র খ্যাতি বিশেষ বেড়ে যায়। বহু মানুষ প্রেয়সীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন এই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে; এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অসংখ্য মানুষের আবেগের স্মৃতি।
তাই ২০২৩ সালে যখন সিকামোর গাছটি কেটে ফেলা হয়, তখন গোটা ব্রিটেনে হতাশা আর দুঃখের ঢেউ বয়ে যায়। গাছটি কে বা কারা, কেন কেটেছে, তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তবে চলতি বছরের মার্চে আইকনিক গাছটির সংরক্ষিত বীজ ও ডালপালা থেকে নতুন চারা গজানোর খবর আশা জাগিয়েছে।
ন্যাশনাল ট্রাস্ট গাছটির ডাল ও বীজ সংগ্রহ করে দেখভাল করেছে।
এই নতুন চারা গাছগুলো এখন বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা, সংগঠন ও ব্যক্তিদের দেওয়া হচ্ছে 'আশার বৃক্ষ' হিসেবে।