গ্যাংনাম স্টাইলের ১০ বছর: এক হিট গান যেভাবে কোরিয়ান সংস্কৃতিকে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দিয়েছে
২০১২ সালের ১৫ জুলাই।
এই দিনে কড়া নীল টাক্সেডো পরে বিশ্ব সংগীত জগতে নিজের আগমনী বার্তা ঘোষণা করেন দক্ষিণ কোরিয়ার এক গায়ক। নাম তার সাই।
তার সঙ্গীর ছিল হর্স-রাইডিং ড্যান্স, আর চমকপ্রদ এক গান—'ওপ্পা গ্যাংনাম স্টাইল'।
প্রকাশের পরপরই হাওয়ার বেগে ভাইরাল হয়ে যায় 'গ্যাংনাম স্টাইল'। ঝড় বইয়ে দেয় দুনিয়াজুড়ে। গানটির মিউজিক ভিডিওতে সয়লাব হয়ে যায় ফেসবুক টাইমলাইন। সর্বত্র যেকোনো সময়, যেকোনো উপলক্ষে বেজে ওঠে 'গ্যাংনাম স্টাইল'।
২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে বিলবোর্ড হট ১০০-এ উঠে আসে গানটি। দু-সপ্তাহ পর উঠে যায় ২ নম্বরে।
ইউটিউবে প্রথম ১০০ কোটি ভিউ পাওয়া ভিডিও-ও এই গান।
সাই আগে থেকেই নিজের দেশে জনপ্রিয় থাকলেও দেশের বাইরে তার পরিচিতি ছিলেন না। কিন্তু গ্যাংনাম স্টাইলের পর হুট করেই বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত গায়ক হয়ে ওঠেন।
এক বছরের মধ্যে তিন-তিনটি গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড ভাঙেন সাই। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে পারফর্ম করেন, ম্যাডোনার সঙ্গে। অকল্পনীয় সাফল্য ধরা দেয় সিউলের এই গায়কের হাতের মুঠোয়। ওই সময় তার বস ৩৫।
গানটির এক দশক পূর্তি হওয়ার আগে এক সাক্ষাৎকারে সাই তার জীবনের ওই সময়টাকে তুলনা করেন জন্মদিন উদযাপনের সঙ্গে।
গ্যাংনাম স্টাইল গানটির প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল সংগীত অঙ্গনের বাইরেও। সত্যি বলতে কী, গ্যাংনাম স্টাইলের সাফল্যকে বিবেচনা করা হয় 'কোরিয়ান ওয়েভ' বা হ্যালিউ'-এর অন্যতম প্রধান অনুঘটক হিসাবে। ১৯৯০-এর দশক থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার সংগীত ও মিডিয়ার মাধ্যমে যে কাজটি করার চেষ্টা করছিল, সেই কাজটিই গ্যাংনাম স্টাইল করে দেয়।
জর্জ মেসন ইউনিভার্সিটির দক্ষিণ কোরিয়ান ক্যাম্পাসের কালচারাল স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক গিউ ট্যাগ লির মতে, গ্যাংনাম স্টাইলই পূর্ব এশিয়ার বাইরে কোরিয়ান পপ সংস্কৃতিকে মূলধারার স্বীকৃতি এনে দিয়েছে।
'ইউটিউবের মতো মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে এ ধরনের গান ভাইর হওয়ার ফলেই কে-পপ এবং হ্যালিউকে সত্যিকার অর্থে জনপ্রিয় এবং বিদেশে বড় করে তুলেছে,' বলেন তিনি।
পথ দেখানো
গ্যাংনাম স্টাইল বের হওয়ার পরের এক দশকে দক্ষিণ কোরিয়ান প্রতিভা বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা ও মুগ্ধতার নতুন স্তরে পৌঁছে গেছে।
২০২১ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিক্রি মিউজিক্যাল অ্যাক্ট ছিল কে-পপ ব্যান্ড বিটিএস। এই দলটি গ্র্যামিতে পারফর্ম করেছে। এশিয়ান প্রতিনিধিত্ব ও এশীয়-বিরোধী হেইট ক্রাইম নিয়ে আলোচনা করার জন্য হোয়াইট হাউসে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ার মেয়েদের ব্যান্ড দল ব্ল্যাকপিঙ্ক ইতিমধ্যে কোচেল্লা মিউজিক ফেস্টিভ্যালে পারফর্ম করেছে। গান গেয়েছে লেডি গাগা ও সেলেনা গোমেজের সঙ্গে। এই ব্যান্ডটির চার সদস্যের প্রত্যেকেই বড় ব্র্যান্ড বা বিলাসবহুল ফ্যাশন হাউসে শুভেচ্ছাদূত হিসেবে যোগ দিয়েছেন।
গিউ ট্যাগ লির মতে, কে-পপের এই সাফল্যের জোয়ার এসেছে সাইয়ের দেখানো পথেই—শেয়ারযোগ্য ভিডিও কনটেন্ট ব্যবহার করে বিশ্ব দরবারে পৌঁছার মাধ্যমে।
লি বলেন, গ্যাংনাম স্টাইল বিশাল হিট না হলে বিটিএস, ব্ল্যাকপিঙ্কের জন্ম না-ও হতে পারত।
কে-পপকে বিশ্বায়নে সাহায্য করার জন্য বিটিএস অনেকবার সাইয়ের নাম নিয়েছে, তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। ব্যান্ডটির সদস্য সুগা তো সাইয়ের নতুন অ্যালবাম 'সাই নাইন্থ'-এর মূল একক গান 'দ্যাট দ্যাট' সহ-প্রযোজনা ও ফিচারও করেছেন।
এই গানটিও গ্যাংনাম স্টাইলের মতোই আকর্ষণীয়। এছাড়া মিউজিক ভিডিওটিতে সাইয়ের কিছু সিগনেচার হিউমার রয়েছে। নতুন এই মিউজিক ভিডিও ইতিমধ্যেই ইউটিউবে ২৭৩ মিলিয়নের বেশি ভিউ পেয়ে গেছে।
সাইয়ের ইউটিউব অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা একটি বিহান্ড-দ্য-সিন ভিডিও সাক্ষাৎকারে সুগা গ্যাংনাম স্টাইল গায়কের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
সুগা বলেন, 'তিনি যুক্তরাষ্ট্রে কে-পপের প্রবেশের পথ করে দেন। এই পথ ধরে (বিটিএস) অনেক সহজে হাঁটতে পারে।'
সাইও বিটিএসকে প্রশংসায় ভাসান। ব্যান্ডটির সাফল্য নিয়ে তিনি বলেন, 'আমি মনে করি এটি একটি অবিশ্বাস্য কীর্তি।
'২০১২ সালে যে ভারী বোঝা যা আমি বইছিলাম, ছয়-সাত বছর ধরে বিটিএস এখন সেই বোঝা বইছে।'
রেকর্ড ভাঙার চেয়েও বেশি কিছু
সাইয়ের কাছে তার বৈশ্বিক সাফল্যের বরাবরই আরেকটি দিক আছে। গ্যাংনাম স্টাইলের সেই দিনগুলোতে তিনি একদিকে যেমন উত্তেজিত ও খুশি ছিলেন, অন্যদিকে বলছিলেন ওই দিনগুলো তাকে 'অভিভূত' ও 'ভেতরে শূন্যতার' অনুভূতিও দিয়েছে।
খ্যাতির পিছু পিছু এসেছে নতুন সব প্রত্যাশা—আর আরও হিট গান দেওয়ার চাপ।
'একটা গান যখন হিট হয়, তখন আপনার বাকি গানগুলোও হিট হতে হয়,' সাই বলেন। 'আর যখন ব্যক্তি হিট হয়, তখন সাফল্য আরও টেকসই হয়। এ ক্ষেত্রে আমি প্রথমটা আর বিটিএস পরেরটা।
গ্যাংনাম স্টাইলের মতো সাফল্য এরপর আর পাননি সাই। তবে গত এক দশক ধরে নিজেকে তিনি সংগীতশিল্পী ও নৃত্যশিল্পী হিসেবে প্রমাণ করার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিনি তিনটি পূর্ণদৈর্ঘ্য অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন। প্রতিটি অ্যালবামই বৈচিত্র্যে ভরপুর।
তবে নিজ দেশে সাইয়ের কনসার্টে হাজার হাজার মানুষ হয়। তার বার্ষিক কনসার্ট সিরিজ 'সামার সোয়াগ' এখন চলমান আছে।
'শ্রোতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করা (এবং) সেই অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়া এমন এক জিনিস যা আমি ভাষায় বোঝাতে পারব না,' সাই বলেন। 'এসব মুহূর্তে আমি অবিশ্বাস্যভাবে গর্বিত ও সন্তুষ্ট বোধ করি।'
সাইয়ের লক্ষ্য বরাবরই একটা—মজার সংগীত ও নাচ বানিয়ে ভক্তদের খুশিতে ভাসানো।
- সূত্র: সিএনএন