চারিত্রিক সনদ: ঔপনিবেশিক যে বোঝা এখনো নামেনি
স্কুলে ভর্তি হওয়া, চাকরি, ট্রেড লাইসেন্স, বা পাসপোর্ট; সবকিছুর আবেদনের জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের থেকে একটি চারিত্রিক সনদের দরকার হয়।
এ কাগজটির সূচনা সেই ব্রিটিশ আমলে। তখন কাউকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জড়িত না থাকার হলফনামা দিতে এটি ব্যবহার করা হতো। কিন্তু ব্রিটিশরা বাংলার ক্ষমতা ছাড়ার বয়স ৭০ বছরের বেশি হয়ে গেলেও চারিত্রিক সনদের 'ক্ষমতা' এখনো বহাল তবিয়তে টিকে আছে। বিষয়টিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন 'সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়' ও 'উদ্ভট'।
আমলাতান্ত্রিক এ জটিলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাধারণ মানুষও। পুলিশ ক্লিয়ারেন্স থাকার পরও কেন চারিত্রিক সনদের দরকার হবে? আর যারা এ কাগজ দেন, তাদের সততা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। চারিত্রিক সনদ তোলার জন্য ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ তো অহরহ পাওয়া যায়।
হয়রানি ও ঘুষ দেওয়া এড়াতে নকল সিল ও সিগনেচার ব্যবহার করে নিজেরাই জাল চারিত্রিক সনদ বানিয়ে নিয়েছেন বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর কাছে অনেকেই স্বীকার করেছেন।
১৭৭২ সালে ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য চারিত্রিক সনদের সূচনা করেন। সেসময় প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তারা এ সনদটি প্রদান করতেন। সনদে লেখা থাকত, সনদধারী ব্যক্তি 'সচ্চরিত্র এবং রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজে যুক্ত নন'।
হেস্টিংসের পর ২৫০ বছর পার হয়ে গেলেও বাংলাদেশ, ভারত, ও পাকিস্তানে এখনো চারিত্রিক সনদের প্রচলন রয়ে গেছে। বর্তমানে এ সনদগুলো ইস্যু করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
প্রখ্যাত স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ টিবিএসকে বলেন, ঔপনিবেশিক নিয়মকানুন মানা এখন সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়।
'ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তারা চারিত্রিক সনদ দিয়ে থাকেন। অথচ যাদেরকে দিচ্ছেন সে ব্যক্তিদের নিয়ে তাদের কোনো ধারণাই থাকে না,' বলেন তিনি।
তোফায়েল আহমেদ জানান, 'বিশ্বে উপমহাদেশ ছাড়া আর কোথাও এ ধরনের সনদের অস্তিত্ব এখন আর নেই। সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় এ প্রক্রিয়াটি চালু থাকার ফলে কেবল জনগণের জন্যই ভোগান্তি হচ্ছে।'
'চেয়ারম্যান অফিসে নেই, পরে আসুন'
সম্প্রতি বরিশাল বিভাগে একটি সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে যোগ দিয়েছেন আরিফুজ্জামান বাবু (ছদ্মনাম)। পুলিশ এখন তার ঠিকানা ও অন্যান্য তথ্য যাচাই করছে, তাদের তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করবে বাবু'র চাকরিটি স্থায়ী হবে কিনা।
ভেরিফিকেশনের জন্য চারিত্রিক সনদ সংগ্রহ করতে নিজের পৈতৃক গ্রামে ছুটে যান তিনি। কিন্তু পরিষদ চেয়ারম্যান তার দপ্তরে ছিলেন না বলে সনদ পাননি তিনি। বারবার গিয়েও খালি হাতে ফিরতে হয় তাকে।
প্রায় এক সপ্তাহের বেশি পরে চারিত্রিক সনদ হাতে পান এ তরুণ। 'ওই কাগজের জন্য আমার নয় দিন নষ্ট হলো, কিন্তু পরিহাসের বিষয় হলো এটা কেবল একটা আনুষ্ঠানিকতা,' হতাশ বাবু বলেন।
ঢাকার বাসিন্দা নাজিম উদ্দীনের (ছদ্মনাম) স্থায়ী ঠিকানা ভোলা। মাস দুয়েক আগে পাসপোর্টের আবেদন করেছিলেন তিনি। কর্মব্যস্ত সপ্তাহের মাঝখানে তাকে ভোলা যেতে হয়েছিল চারিত্রিক সনদ তোলার জন্য।
'আমি বুঝি না মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলা এমন অপ্রয়োজনীয় সিস্টেম কেন সরকার বন্ধ করে না,' মন্তব্য করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করে কামরুল হাসান এখন চাকরির সন্ধান করছেন। তিনি টিবিএসকে জানান, ঘনঘন সরকারি চাকরির আবেদন করতে হয় বলে তিনি নীলক্ষেতের বইয়ের বাজার থেকে চারিত্রিক সনদ বানিয়ে নিয়েছেন।
'প্রথমে কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়েছিলাম আসল সনদের জন্য। কিন্তু তাদের গড়িমসি দেখে নকল সিল আর সিগনেচারের পথ বেছে নিতে হলো,' বলেন তিনি।
কেবল আনুষ্ঠানিকতা?
বাবুর ক্ষেত্রে পুলিশের স্পেশাল ব্র্যাঞ্চের (এসবি) চোখে চারিত্রিক সনদ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে না।
এসবি'র ডেপুটি ইনস্পেকটর জেনারেল মো. হুমায়ূন কবির টিবিএসকে বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এসব সনদে তাদের পর্যবেক্ষণ জানান, কিন্তু পুলিশের ভেরিফিকেশনে তা এড়িয়ে যাওয়া যায়।
'আমরা প্রার্থীর কাছ থেকে চারিত্রিক সনদ গ্রহণ করি কিন্তু আমাদের নিজস্ব মূল্যায়ন পদ্ধতি রয়েছে,' তিনি জানান।
মন্ত্রীসভার সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদারের মতে, চারিত্রিক সনদের প্রয়োজনীয়তা রদ করার বিষয়টি সরকারের এখন বিবেচনা করা উচিত।
কোনো একটা সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আবু হাসানাত হুমায়ূন কবির।
দেশজুড়ে প্রায় ৫৫০০ স্থানীয় সরকার কর্মকর্তা এ সনদগুলো প্রদান করেন। গড়ে একটি ইউনিয়ন পরিষদ মাসে ৫০০ থেকে ৬০০টি চারিত্রিক সনদ প্রদান করে। অন্যদিকে বড় সিটি কর্পোরেশনগুলো মাসে বিনামূল্যে গড়ে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার চারিত্রিক সনদপত্র সরবরাহ করে।