চার বছর পর সিনেমা হলে ফিরছে দর্শক, দেশী গল্পের জয়জয়কার!
স্টার সিনেপ্লেক্স এর পাঁচটি শাখায় প্রতিদিন ২১ টি শো চলছে 'পরাণ' সিনেমার। গত কয়েক বছরে দর্শকদের এমন উত্তেজনা চোখে পড়েনি চলচ্চিত্রের সাথে সংশ্লিষ্টদের। বাংলা সিনেমা দেখার জন্য দর্শকদের এমন ভিড় অনেকদিন পরে দেখলো সিনেমা হল কর্তৃপক্ষ।
শুধু স্টার সিনেপ্লেক্সই নয়, দেশের বিভিন্ন সিনেমা হলে দেখা গেছে দর্শকদের উপচেপড়া ভিড়। ইতোমধ্যেই বিক্রি হয়ে গেছে সিনেমার প্রথম কয়েকদিনের শো এর সব টিকিট। দর্শক জনপ্রিয়তায় এই মুহূর্তে সবার শীর্ষে আছে 'পরাণ'। তবে এই সিনেমার পাশাপাশি গেল ঈদ-উল-আজহায় মু্ক্তি পেয়েছে আরও দুটি ছবি। প্রযোজক ও আলোচিত অভিনেতা অনন্ত জলিলের দিন: দ্য ডে, এবং অনন্য মামুন পরিচালিত সাইকো।
পরাণ- সিনেমার পরিচালক রায়হান রাফি দাবি করছেন, 'পোড়ামন ২' এর পর আরও একটি প্রেমের ছবি এটি। মাঝে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেও সেগুলো প্রেমের ছবি নয় বলেই মন্তব্য তার। পোড়ামন ২ মুক্তি পেয়েছিল ২০১৮ সালে। এদিকে প্রায় আট বছর পর নতুন ছবি নিয়ে এসেছেন অনন্ত জলিল ও বর্ষা দম্পতি। তাদের দাবি, এই ছবির শুটিয়ে হয়েছে চারটি দেশে এবং বাজেট ছিল ১০০ কোটি টাকা।
চার বছর পরে দর্শকদের আনাগোনায় মুখরিত সিনেমা হল
২০১৮ সালের আগে আয়নাবাজি, ঢাকা অ্যাটাক এর মতো ছবিগুলো দর্শকেরা পছন্দ করেছিলেন। তারও আগে জমজমাট ব্যবসাসফল ছিলো 'মনপুরা'। ২০১৮ সালে মুক্তি পাওয়া 'দেবী' ও 'পোড়ামন ২' নিয়ে দর্শকের ছিল মাতামাতি। দেবী'র প্রযোজনায় ছিলেন জয়া আহসান এবং পরিচালনায় অনম বিশ্বাস।
ঠিক চার বছর পর আবারও যেন বাংলা সিনেমায় সুদিন ফিরেছে। মাঝে ২০২০ ও ২০২১ সালে ছিল করোনার দাপট। এসময় সিনেমা হলগুলো ছিল বন্ধ। নানা বিধিনিষেধ দিয়ে বছরের বিভিন্ন সময়ে সিনেমা হল চালু হলেও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলো বড় বাজেটের ছবি মুক্তি দেয়নি। গুটিকয়েক ছবি মুক্তি পেলেও সেগুলো পেয়েছে ফ্লপ ছবির তকমা।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক পরিবেশক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে দেশে মুক্তি পেয়েছিল ৪৭ টি ছবি। ২০১৯ সালে ৪৫ টি দেশী ও ২ টি যৌথ প্রযোজনার ছবি, ২০২০ সালে ১৫ টি এবং ২০২১ সালে ৩০টি ছবি মুক্তি পেয়েছিল।
এদিকে ২০২২ সালের দুই ঈদেই মুক্তি পেয়েছে সাতটি ছবি। এরমধ্যে ঈদুল ফিতরে মুক্তি পেয়েছিল চারটি ছবি। মূলত ওই সময় থেকেই দর্শকেরা ধীরে ধীরে হলমুখী হওয়া শুরু করেন। ঈদুল ফিতরে মুক্তি পাওয়া 'শান' ও 'গলুই' দর্শকদের মধ্যে সাড়া ফেলে। তবে এবারের ঈদের মতো এরকম উপচে পড়া ভিড় ছিল না।
এবারের দর্শকদের সাড়া প্রসঙ্গে স্টার সিনেপ্লেক্সের সিনিয়র ম্যানেজার মেজবাহ উদ্দিন বলেন, সবশেষ আয়নাবাজি, দেবী এবং ঢাকা অ্যাটাকের বেলায় এমন ঘটনা ঘটেছিল। তারপর অনেকদিন বাংলা সিনেমা দেখতে দর্শকদের এমন ভিড় লক্ষ্য করা যায়নি। এটা আমাদের জন্য খুব আনন্দের ব্যাপার। বিদেশী ছবি চালিয়ে দর্শক পেলেও বাংলা ছবিতে দর্শকদের ভিড় বাড়তি আনন্দ।'
সবসময় বিদেশী ছবি আমদানির ব্যাপারে সরব রাজধানীর মধুমিতা সিনেমা হলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নওশাদ উদ্দিন এবার বাংলা ছবি নিয়ে সরব হয়েছেন। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "পরাণ, দিন দ্য ডে-এর মতো ছবি যদি নিয়মিত মুক্তি পায় তাহলে আমাদের আর বিদেশী ছবি লাগবে না। খুব বেশি না বছরে মাত্র ১০-১২ টা ছবি হলেই হবে। তাহলে সিনেমা হল ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াবে। তখন আর কাউকে আর হল বন্ধ করার মতো সিদ্ধান্ত নিতে হবে না।"
একই মতামত দিয়েছেন রাজধানীর শ্যামলী সিনেপ্লেক্সের ম্যানেজার আহসান উল্লাহ। তিনি বলেন, "ঈদের পর থেকে আমরা 'দিন: দ্য ডে' চালিয়েছি। এখন পরাণ চলছে। দুটি সিনেমাতেই হাউসফুল দর্শক পাচ্ছি।"
হল মালিক সমিতি সূত্রে জানা যায়, সবসময় শ খানেক সিনেমা হল চালু থাকলেও ঈদ উপলক্ষে চালু হয়েছে প্রায় দেড়শ সিনেমা হল। এরমধ্যে অর্ধশতাধিক সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছিল 'দিন: দ্য ডে'। মাত্র ১১ টি সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছিল পরান। তবে সপ্তাহ শেষে পাল্টে যায় দৃশ্যপট। হল বৃদ্ধি পায় পরানের। ৫৫ টি সিনেমা হলে মুক্তি দেয়া হয় ছবিটি।
কোন ছবিতে কত লাভ?
গত ১০ জুলাই ঈদের দিন থেকে এখনো চলছে ঈদের ছবিগুলো। প্রায় দুই সপ্তাহ পার হয়েছে, কিন্তু এখনো লাভ ক্ষতির হিসাব টানতে পারেননি প্রযোজকেরা। যদিও বিশাল বাজেটের ছবি বলে শুরু থেকেই আলোচনায় এসেছিল অনন্ত জলিলের দিন: দ্য ডে ছবিটি।
অনন্ত জলিল অনেক আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন ১০০ কোটি টাকার সিনেমা দিন দ্য ডে। সিনেমা হল থেকে কত টাকা উঠে এসেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এটা এখনই বলতে পারছি না। আরও কয়েক সপ্তাহ লাগবে, এখনো হলে হলে প্রচুর দর্শক যাচ্ছেন। ছবিটি দেখছেন। আমার কাছে এখন শুধু সিনেপ্লেক্সের হিসাব আছে।'
এদিকে দর্শক নন্দিত ছবি 'পরান' এর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান লাইভ টেকনোলজিস-এর ডিরেক্টর ও প্রযোজক তামজীদ অতুল জানান, তাদের ছবিটি বাজেট ৭৫ লাখ। তবে ডিস্ট্রিবিউশনসহ সেটা ৮৩ লাখ টাকা হয়েছে। তবে এই অর্থ শুধু সিনেমা হল থেকেই উঠে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, 'আমরা দর্শকদের চাহিদা অনুযায়ী কনটেন্ট নির্মাণ করি। পরাণ'র জয়জয়কার এই জন্যই। সামনে আমাদের সব কনটেন্ট হবে প্রোপার দেশি গল্পের। দেশকে রিপ্রেজেন্ট করব। দেশের সাংস্কৃতিকে আন্তজার্তিক অঙ্গনে মেলে ধরতে চাই। আমাদের শক্তি অনেক বেশি, আমাদের কাছে টেকনোলজি, প্ল্যাটফর্ম এবং কনটেন্ট যা দেশের কারো কাছে নেই। বাংলাদেশের প্রথম ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আমরাই বানিয়েছি। আমরাই পারবো আমাদের কনটেন্ট আন্তজার্তিক ভাবে তুলে ধরতে।'
এদিকে ঈদের সাইকোর বাজেট নিয়ে এখনই কথা বলতে রাজি নন পরিচালক অনন্য মামুন।
অপেক্ষা 'হাওয়া'র
আগামী ২৯ জুলাই মুক্তি পেতে যাচ্ছে বহুল প্রতীক্ষিত চলচ্চিত্র 'হাওয়া'। মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত এই সিনেমায় অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী, শরীফুল রাজ, সুমন আনোয়ার, নাসির উদ্দিন, নাজিফা তুষি, সোহেল মন্ডলসহ অনেকেই।
এরই মধ্যে সিনেমাটির 'সাদা সাদা কালা কালা' গানটি ভাইরাল হয়েছে। ছবিটির প্রচারণা চলছে ব্যাপক পরিসরে। ঈদের সিনেমার পরপরই 'হাওয়া' মুক্তি দর্শকের জন্য বাড়তি পাওনা। সিনেমাট নিয়ে পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমন বলেন, আমার সিনেমাটি পুরা শুটিং করেছি সমুদ্রে। কঠোর পরিশ্রম করেছি। দর্শকেরা দেখলে আমাদের ভালা লাগবে। আমাদের কাছে মনে হয়েছে সিনেমাটি মুক্তি দেয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। '
দিন শেষে সকল হল মালিকদের চাওয়া ভালো সিনেমা। তবেই বাংলা সিনেমার সুদিন ও হল ব্যবসা ফিরবে বলে মনে করেন তারা। আর তার জন্য দরকার দেশী গল্পের দেশী সিনেমা।