আগাগোড়াই বেইজিংয়ের বিরোধিতা করে এসেছেন পেলোসি
চীনের হুমকি এবং হোয়াইট হাউজের উদ্বেগের মধ্যেই মঙ্গলবার (২রা আগস্ট) রাতে তাইওয়ানে পৌঁছেছেন মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ (কংগ্রেস)-এর স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। তবে চীন সরকারের সমালোচনাকারীদের তালিকায় ন্যান্সির নাম বহু পুরনো।
১৯৮৯ সালে চীন সরকার কর্তৃক ছাত্র বিক্ষোভে গণহত্যার দুই বছর পর, ১৯৯১ সালে ন্যান্সি পেলোসি বেইজিংয়ে তিয়েনআনমেন স্কয়ার পরিদর্শন করেন এবং নিহত বিক্ষোভকারীদের প্রতি সম্মান জানিয়ে ব্যানার প্রদর্শন করেন।
ন্যান্সি পেলোসিকে 'মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিতে পূর্ণ' হিসেবে আখ্যা দিয়ে চীনা সরকারও তার প্রতি প্রকাশ্য বিদ্বেষ প্রদর্শনে কমতি রাখেনি।
এবারও ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সিনিয়র সদস্য পেলোসির তাইওয়ান সফর নিয়ে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেয় চীন। বেইজিং বলে, (তিনি সফর করলে) চীনা সেনাবাহিনী নিশ্চুপ বসে থাকবে না।
তাইওয়ান একটি স্ব-শাসিত দ্বীপ হলেও চীন তাইওয়ানকে একটি বিচ্ছিন্ন প্রদেশ হিসেবে গণ্য করে।
এই মুহূর্তে ন্যান্সি পেলোসি যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় ক্ষমতাধর রাজনীতিক; প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্টের পরেই তার অবস্থান। আর চীনের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে এই রাজনীতিক সবসময়ই সোচ্চার।
পেলোসির তাইওয়ান সফরের গোটা পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়নি- তবু চীনা হুমকির মুখে অনেক কথাই বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। তার এশিয়ান অঞ্চল সফরের পরিকল্পনায় সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানও অন্তর্ভুক্ত।
উল্লেখ্য, পেলোসির তাইওয়ান সফরের ব্যাপারে তাকে সতর্ক করেছেন জো বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারাও; হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা তাকে এ সফর নিয়ে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করেছিলেন বলেও জানা গেছে।
"সেনাবাহিনীর মতে, এখন এ সফরে না গেলেই ভালো', গণমাধ্যমকে বলেন বাইডেন।
তিয়েনআনমেন স্কয়ার পরিদর্শন
তিয়েনআনমেন স্কয়ারে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পরিচালিত নির্মম হত্যাযজ্ঞের দুই বছর পর, ক্যালিফোর্নিয়ার তৎকালীন প্রতিনিধি ন্যান্সি পেলোসি বেইজিং পরিদর্শন করেন।
চীনা হোস্টদের অনুমতি ছাড়াই তার অফিসিয়াল এসকর্টের বাইরে কংগ্রেসের অন্য দুই সদস্যের সাথে পেলোসি স্কয়ার চত্বরে পৌঁছান।
সেখানে তারা একটি ছোট, হাতে বানানো ব্যানার মেলে ধরেন, যাতে লেখা ছিল- "তাদের জন্য, যারা চীনের গণতন্ত্রের জন্য জীবন দিয়েছে।"
পুলিশ দ্রুত সেখানে পৌঁছে এবং ঘটনাটিকে কাভার করা গণমাধ্যম কর্মী এবং আইনপ্রণেতাদের স্কয়ারের বাইরে তাড়া করে।
পরে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একে 'পূর্বপরিকল্পিত প্রহসন' হিসেবে নিন্দা করে।
অনেকেই সে সফরে পেলোসির এমন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছিলেন। সিএনএনের সাবেক বেইজিং ব্যুরো চিফ মাইক চিনয় ফরেন পলিসির জন্য একটি সম্পাদকীয় লেখেন যেখানে তিনি উল্লেখ করেন যে, পেলোসির জন্যই সেদিন তাকে গ্রেপ্তার হতে হয়।
ন্যান্সি পেলোসি স্কয়ারে কী করার পরিকল্পনা করেছিলেন সে সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন না। তাকে সেদিন পুলিশ কয়েক ঘণ্টা আটকে রাখে।
সম্প্রতি এ বিক্ষোভের ৩৩তম বার্ষিকী উপলক্ষে ন্যান্সি একটি বিবৃতি জারি করেছেন। সেখানে একে তিনি 'রাজনৈতিক সাহস প্রদর্শনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কর্ম' হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং একইসাথে কমিউনিস্ট পার্টির 'অত্যাচারী শাসনের' নিন্দা জানিয়েছেন।
হু-কে লেখা চিঠি
২০০২ সালে চীনের তৎকালীন ভাইস-প্রেসিডেন্ট হু জিনতাওয়ের সাথে এক বৈঠকে ন্যান্সি পেলোসি তাকে চারটি চিঠি দেওয়ার চেষ্টা করেন। চিঠিগুলোতে চীন এবং তিব্বতে অ্যাক্টিভিস্টদের আটক ও কারারুদ্ধের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তাদের মুক্তি দিতে আহবান জানানো হয়।
কিন্তু হু চিঠিগুলো গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান।
সাত বছর পর ন্যান্সি তাকে আরেকটি চিঠি দেন বলে জানা যায়। হু ততোদিনে চীনের রাষ্ট্রপতির পদে আসীন। সেই চিঠিতে ভিন্ন মতাদর্শী চীনা লেখক, সাহিত্য সমালোচক এবং মানবাধিকার কর্মী লিউ জিয়াওবো সহ রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দিতে বলেন তিনি।
২০১০ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী হিসাবে লিউয়ের নাম ঘোষণা করা হয় কিন্তু পুরস্কার গ্রহণের জন্য তাকে নরওয়ে ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হয়নি। চীনের হেফাজতে থাকাকালীন ২০১৭ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
অলিম্পিক ম্যানুভার
চীন অলিম্পিক গেমসের আয়োজক হিসেবে থাকতে চাইলে ১৯৯৩ সালের দিকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে পেলোসি সেখানেও বিরোধিতা করেন।
তাছাড়া তিনি সেই আইনপ্রণেতাদের একজন যারা ২০০৮ সালে চীনের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বয়কটের জন্য তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে অনুরোধ করেছিলেন। যদিও তার সে অনুরোধ ব্যর্থ হয়।
এবারও মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের এই স্পিকার চীনে উইঘুর মুসলিমদের প্রতি আচরণের প্রেক্ষিতে বেইজিংয়ের শীতকালীন অলিম্পিককে 'কূটনৈতিক বয়কট' করার আহ্বান জানিয়েছেন।
এছাড়াও বছরের পর বছর ন্যান্সি পেলোসি চীনের বাণিজ্যিক অবস্থা এবং দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতির মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের এবং বিশ্ববাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) চীনের প্রবেশে শর্ত সংযুক্ত করার জন্য চাপ দিয়েছেন।
- সূত্র- বিবিসি