হারিয়ে যাওয়া পারমাণবিক বোমা, আজও যেগুলোর সন্ধান মেলেনি
সময়টা ১৯৬৬ সাল। জানুয়ারি মাসের ১৭ তারিখ। স্নায়ুযুদ্ধ তখন তুঙ্গে। সেদিন সকালে চিংড়ি ধরতে গিয়ে জনৈক স্প্যানিশ জেলে হঠাৎ দেখলেন আকাশ থেকে অদ্ভুতদর্শন একটি বস্তু আলবোরান সাগরে পড়ছে। তার চোখের সামনে বস্তুটি সমুদ্রের ঢেউয়ের ভাঁজে হারিয়ে গেল।
একই সময়ে কাছাকাছি একটি গ্রামের মানুষ ভিন্ন এক ঘটনা প্রত্যক্ষ করলো। পালোমারিস নামের ওই জেলে গ্রামের বাসিন্দারা দেখলেন আকাশ থেকে দুটো দৈত্যাকৃতির অগ্নিগোলক তাদের দিকে ধেয়ে আসছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুরো গ্রাম লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল সেই অগ্নিগোলকের বিস্ফোরণে।
সে সময় সিসিলিতে অবস্থিত নেভাল এয়ার ফ্যাসিলিটিতে ছিলেন ফিলিপ মেয়ার্স। পালোমারিসের ওই দুর্ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পর তার জরুরি তলব পড়ল স্পেনে যাওয়ার।
যদিও ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তবে তার আগেই বিশ্বের গণমাধ্যমগুলো খবর প্রচার করছিল- মাঝ আকাশে দুটো মার্কিন বিমান মুখোমুখি সংঘর্ষে বিধ্বস্ত হয়েছে। একটি বিমানে থাকা চারটি বি২৮ থার্মোনিউক্লিয়ার বোমা পালোমারিস এলাকায় পড়ে গিয়েছে।
তিনটি বোমা দ্রুতই উদ্ধার করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু একটি বোমা হারিয়ে যায় ভূমধ্যসাগরে। ওই বোমাটির ওয়ারহেড ছিল ১.১ মেগাটনের। বোমার বিস্ফোরণ ক্ষমতা ছিল ১১ লাখ টিএনটির সমান।
কেউ জানে না কত হারিয়েছে
পালোমারিস কিন্তু পারমাণবিক বোমা স্থানচ্যুত হওয়ার প্রথম ঘটনা নয়। ১৯৫০ সালের পর প্রায় ৩২ বারের মতো পারমাণবিক বোমা দুর্ঘটনাক্রমে হাতছাড়া হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের।
এসব বোমা পরে আবার উদ্ধারও করেছে মার্কিন কর্তৃপক্ষ। তবে এখন পর্যন্ত তিনটি মার্কিন পারমাণবিক বোমা চিরতরে হারিয়ে গেছে।
কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই হারানো পারমাণবিক বোমা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশ এখন পর্যন্ত কতগুলো পারমাণবিক অস্ত্র হারিয়েছে, তার কোনো আনুষ্ঠানিক সংখ্যা জানা নেই।
পারমাণবিক বোমা হাতছাড়া হওয়ার ঘটনা বেশি ঘটেছে স্নায়ুযুদ্ধের সময়। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আকাশে সবসময় নিরবচ্ছিন্নভাবে পারমাণবিক বোমাসহ যুদ্ধবিমান পরিচালনা করত। এটি পরিচিত ছিল অপারেশন ক্রোম ডোম নামে।
১৯৮৬ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে ৪৫ হাজার পারমাণবিক বোমা ছিল। সে সময় সোভিয়েতরাও পারমাণবিক বোমা হারিয়েছিল। তবে তাদের ক্ষেত্রে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে সাবমেরিনের মাধ্যমে।
১৯৭০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক শক্তিচালিত কে-৮ সাবমেরিন চারটি নিউক্লিয়ার টর্পেডো নিয়ে বে অভ বিসকে-তে ডুবে যায়। খবর পেয়ে সেসব অস্ত্রের অনুসন্ধানে নেমেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও।
মার্কিন বিলিয়নিয়ার হাওয়ার্ড হিউও কে-৮ উদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেন। প্রজেক্ট অ্যাজোরিয়ান নামক একটি মিশন পরিচালনা করেছিলেন তিনি। তার উদ্দেশ্য ছিল দানবাকৃতির একটি আঁকড়ে ধরার যন্ত্র (ক্ল) তৈরি করে তা দিয়ে সমুদ্রগর্ভ থেকে সোভিয়েত সাবটি টেনে তোলা। কিন্তু সে মিশন সাফল্যের মুখ দেখেনি। আজ পর্যন্ত ওই পারমাণবিক টর্পেডোগুলো গভীর সমুদ্রে কে-৮'র পেটের ভেতর আটকে আছে।
উদ্ধার অভিযান
ফিলিপ মেয়ার্সের দায়িত্ব পড়লো পালোমারিসের হারানো অবশিষ্ট বোমাটি উদ্ধার করার। গণিতের সাহায্য নিয়ে তারা হিসেব কষে বের করলেন কোন জায়গাটিতে খুঁজলে বোমাটি পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
আলভিন নামক একটি অত্যাধুনিক সাবমেরিন ব্যবহার করা হলো উদ্ধার অভিযানে। এ সাবমেরিনটি অন্য যেকোনো সাবমেরিনের চেয়ে সমুদ্রের অনেক গভীর পর্যন্ত যেতে পারত। আলভিনে চড়ে ভূমধ্যসাগরের নীল জলরাশির গভীরে অনুসন্ধানে নামলেন একদল মানুষ।
মিশনের প্রথম অংশ বোমাটি চিহ্নিত করা। কপাল খুললো ১৯৬৬ সালের মার্চের এক তারিখে। সেদিন আলভিনের ক্রুরা সমুদ্রের বুকে বোমাটি পতনের প্রথম আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেলেন। পরে তারা প্যারাসুটে জড়ানো বোমার গোলাকার শীর্ষভাগ খুঁজে পান।
২৮৫০ ফুট গভীর থেকে পারমাণবিক ওই দানবকে উদ্ধার করতে হবে। সে আরেক চ্যালেঞ্জ। মেয়ার্স একটি বুদ্ধি বের করলেন। অতি শক্ত নাইলনের দড়ি আর লোহার হুক ব্যবহার করে বোমাটি সমুদ্রের বুক থেকে ওপরে টেনে আনার ব্যবস্থা করলেন।
পরিকল্পনামাফিক কাজ শুরু হলো। কিন্তু আবারও বিধি বাম। কিছুটা টেনে তোলার পর লেগে থাকা প্যারাসুট খুলতে শুরু করল। পানির গভীরে খুলে যাওয়া ওই প্যারাসুট বোমাটিকে নিচের দিকে টেনে নিতে শুরু করল।
প্যারাসুটের টানে নাইলনের দড়ি ছিঁড়ে গেল। বোমাটি এবার সমুদ্রের আরও গভীরে গিয়ে আশ্রয় নিল। অল্পের জন্য আলভিন বোমার সঙ্গে সমুদ্রের অতলে হারিয়ে যাওয়া থেকে রেহাই পেয়েছিল। পরে আরেকটি উদ্ধারকারী দল রোবট সাবমেরিন ব্যবহার করে বোমাটি উদ্ধার করেছিল।
বোমা ভয়ংকর
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিনিরা জাপানে যে দুটো পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করেছিল সেগুলো ছিল প্রাথমিক প্রযুক্তির পারমাণবিক অস্ত্র। এরপর এসব অস্ত্র আরও শক্তিশালী হয়েছে, এগুলোর কারিগরি প্রযুক্তিতেও পরিবর্তন এসেছে।
হিরোশিমা ও নাগাসাকির বোমাগুলো নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে কাজ করেছিল। এ ধরনের প্রযুক্তিতে বোমার ভেতরে থাকা তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম-২৩৫ এর মধ্যে ইউরেনিয়াম-২৩৫'র ফাঁপা 'বুলেট' নিক্ষেপ করা হতো। অন্যদিকে প্লুটোনিয়াম-২৩৯'র ক্ষেত্রে গতানুগতিক বিস্ফোরক ব্যবহার করা হতো। এভাবে তেজস্ক্রিয় পদার্থকে উত্তেজিত করার মাধ্যমে মূল পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটানো হতো।
১৯৫০ ও '৬০-এর দশকে যে পারমাণবিক বোমাগুলো বানানো হয়েছিল, এগুলো ছিল পরের প্রজন্মের। এগুলোর ধ্বংসক্ষমতা প্রাথমিক বোমাগুলোর চেয়ে বহুলাংশে বেশি ছিল। আর এগুলোই সবচেয়ে বেশি হাতছাড়া হয়েছে বা হারিয়ে গেছে।
এ বোমাগুলো ছিল হাইড্রোজেন বোমা। এগুলোতে প্রাথমিক পারমাণবিক বিস্ফোরণের পর দ্বিতীয়বার হাইড্রোজেনের আইসোটোপের বিস্ফোরণ ঘটতো।
তবে এ বোমাগুলোতে কিছু সেফটি ডিভাইসের ব্যবস্থা ছিল। অনেক সময় সংঘর্ষের ফলে বা উঁচু থেকে মাটিতে পড়ার কারণে এ বোমাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতো। কিন্তু সেফটি মেকানিজম থাকায় এগুলো কখনো বিস্ফোরিত হয়নি। তবে দুটি বোমা থেকে পরিবেশে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছিল।
এ বোমাগুলোতে কখনো কখনো একেবারে প্রয়োজনীয় মুহূর্তের আগে পারমাণবিক ওয়ারহেড সংযুক্ত করা যেত। ফলে মূল বোমা থেকে এটি আলাদা রাখা যেত। এর ফলে বোমার ভেতর থাকা কনভেনশনাল উপাদানের বিস্ফোরণ ঘটলেও পারমাণবিক অংশটুকু অক্ষত থাকত।
আধুনিক পারমাণবিক বোমাগুলোতে এ ধরনের একাধিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে। এ বোমাগুলোর বিস্ফোরণ ঘটানোর আগে এগুলোকে 'অ্যাক্টিভেট' বা চালু করতে হয়। তা না হলে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটে না। তবে অনেক সময়ই এরকম দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা যায়, একাধিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা কাজ করেনি, কিন্তু একটি সফলভাবে কাজ করেছে। আর ওই একটি সেফটি সিস্টেমের কারণে বোমাটি বিস্ফোরিত হয়নি।
বিস্ফোরণের ঝুঁকিতে যে বোমাটি
১৯৫৮ সালে টাইবি দ্বীপের কাছে হারিয়ে যাওয়া বোমাটি ১০ সপ্তাহ ধরে খোঁজার পর উদ্ধারকাজ পরিত্যক্ত ঘোষণা করে মার্কিন কর্তৃপক্ষ।
বোমাটি পরিবহনকারী বিমানটির পাইলট বিমানকে জরুরি অবতরণ করাতে সফল হন। তার আগে তিনি বোমাটি পানিতে ফেলে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন।
ওই পাইলটের দাবি অনুযায়ী, ফেলার আগে বোমায় পারমাণবিক ক্যাপসুলটি যুক্ত করা ছিলনা। তবে অনেকে বিশ্বাস করেন এটা সত্যি নয়।
১৯৬৬ সালে তৎকালীন মার্কিন সেক্রেটারি অভ ডিফেন্সের সহকারী এক চিঠিতে জানিয়েছিলেন বোমাটিতে প্লুটোনিয়ামের কোর লাগানো ছিল। এ তথ্য যদি সত্যি হয় তাহলে মার্ক ১৫ নামক ওই বোমাটি আজকের দিনেও পুরোদস্তুর পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম।
বর্তমানে বিশ্বাস করা হয়, বোমাটি সমুদ্রের বুকে ৫ থেকে ১৫ ফিট গভীরে কোথাও আটকে আছে। ২০০১ সালে এ বোমাটির বিষয়ে মার্কিন কর্তৃপক্ষ চূড়ান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে জানানো হয়, যদি বোমার ভেতরে থাকা গতানুগতিক বিস্ফোরক পদার্থ ও ব্যবস্থাটি এখনো অক্ষত থাকে, তাহলে মার্ক ১৫ পরিবেশ ও মানুষের জন্য মারাত্মক দুর্যোগ বয়ে আনতে পারে। সেজন্য কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় বোমাটি নিয়ে আর বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করা যাবে না, এমনকি উদ্ধারের চেষ্টাও না। কারণ তা করতে গেলে এটি ফেটে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে।
খুঁজে পাওয়া কেন অসম্ভব
হারিয়ে যাওয়া পারমাণবিক বোমাগুলো খুঁজে পাওয়ার প্রাথমিক উপায় হলো চোখ দিয়ে খুঁজে বের করা।
দুর্ঘটনায় পড়া বিমান পানিতে বিধ্বস্ত হলে কয়েকদিনের মধ্যে ব্ল্যাকবক্স উদ্ধার করা যায়। তাই অনেকে ভাবতে পারেন, হারানো বোমাগুলোকে কেন এভাবে খুঁজে বের করা হচ্ছে না।
এর কারণ বিমানের ব্ল্যাকবক্স থেকে একটানা একধরনের ইলেকট্রনিক পালস বের হয়, যেটাকে 'আন্ডারওয়াটার লোকেশন বিকন' বলা হয়। উদ্ধারকারীরা ওই পালসের সূত্র ধরেই ব্ল্যাকবক্সের কাছে পৌঁছান।
কিন্তু পারমাণবিক বোমায় ওরকম কোনো প্রযুক্তি থাকে না। ফলে এগুলো উদ্ধার করা কঠিন হয়ে যায়। আর যে তিনটি বোমা অতীতে হারিয়েছিল, সে সময়ে এখনকার মতো উদ্ধারের আধুনিক প্রযুক্তি ছিল না।
উদ্ধারের আরেকটি বিকল্প পদ্ধতি হতে পারে, রেডিয়েশন স্পাইক ধরে বোমা খুঁজে বের করা। কিন্তু পারমাণবিক বোমাগুলো বানানোই হয় এমনভাবে যাতে এগুলো থেকে কোনো প্রকার রেডিয়েশন বের না হয়। কারণ এভাবে তেজস্ক্রিয়তা বের হলে তা এসব বোমার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষদের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে।
১৯৬৮ সালে অপারেশন ক্রোম ডোম শেষ হয়। কারণ, কর্তৃপক্ষ মেনে নিয়েছিল, এভাবে সর্বদা আকাশে পারমাণবিক বোমা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো একটু বেশিই বিপজ্জনক। কিন্তু একই ধরনের ঝুঁকি বর্তমান সময়েও আছে। আর সেগুলো হচ্ছে সাবমেরিন।
বর্তমানে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর অনেক সাবমেরিন পারমাণবিক শক্তিতে চলে। সাবমেরিনের টর্পেডোও পারমাণবিক হয়। এ সাবমেরিনগুলোকে গভীর সমুদ্রে নিশ্চুপ হয়ে চলাচল করতে হয় যাতে 'শত্রু'র রেডারে ধরা না পড়ে।
এ কারণে সাবমেরিনগুলো পানির ওপরে থাকা অন্য কোনো স্টেশনে সিগন্যালও পাঠাতে পারে না। ফলে ভূপৃষ্ঠ থেকে এগুলোর সঠিক অবস্থানও সবসময় জানা যায় না। সাবমেরিনের ক্রুরা কিছু যন্ত্রপাতির ওপর নির্ভর করে তাদের ডুবোজাহাজের অবস্থান, গতিপথ, গতিবেগ ইত্যাদি হিসেব করেন।
এর ফলে এ সাবমেরিনগুলো অন্য কোনো জলযান বা পানির নিচের কোনো বস্তুর সঙ্গে সংঘর্ষের ঝুঁকিতে থাকে। ২০১৮ সালে একটি ব্রিটিশ ব্যালিস্টিক মিসাইল সাবমেরিন অল্পের জন্য একটি ফেরির সঙ্গে সংঘর্ষ থেকে বেঁচে যায়।
অর্থাৎ, পারমাণবিক অস্ত্র হারানোর ঝুঁকি স্নায়ুযুদ্ধের সাথে সাথে শেষ হয়ে যায়নি, এখনো মহাসমুদ্রের গভীরে চিরতরে বিলীন হয়ে যেতে পারে ভয়ংকর বিধ্বংসী ক্ষমতার পারমাণবিক অস্ত্র।
- সূত্র: বিবিসি
- অনুবাদ: সুজন সেন গুপ্ত