খাদ্য সংকট প্রতিরোধের যুদ্ধে চাই ‘হারিয়ে যাওয়া’ ফসলের নতুন করে চাষ
সরবরাহে চক্রে বিশৃঙ্খলা, করোনাভাইরাস মহামারি, প্রতিকূল আবহাওয়া; এবং এখন ইউক্রেনে যুদ্ধ- এই পরিস্থিতিগুলো আমাদের বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থার ত্রুটিগুলোকে বারবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
এ সংকট মোকাবিলায় আমাদের প্রয়োজন কৃষিপণ্যের আমূল একটি পরিবর্তন। এ পরিবর্তনের অংশ হিসেবে থাকতে হবে ফসল, ফসল উৎপাদন পদ্ধতি, ও ফসল পরিবহনের বৈচিত্র্যকরণ।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের খাদ্যশস্য ঝুঁকির মুখে রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমতল ভূমিতে চাষ করা গমের ৪০ শতাংশের বেশি বর্তমানে খরায় ভুগছে। চীনে বন্যার কারণে এ বছর গমের উৎপাদন সবচেয়ে কম হবে। গত মে মাসে ভারতে তাপমাত্রা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল রেকর্ড ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এই গ্রীষ্মে ইউরোপের বেশিরভাগ অংশ মারাত্মক তাপপ্রবাহের শিকার।
এসব সমস্যায় গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো দেখা দিয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই দুই দেশ একত্রে বিশ্ববাজারে গমের ২৮ শতাংশ, যবের ২৯ শতাংশ, ভুট্টার ১৫ শতাংশ, ও সূর্যমুখীর বীজের ৭৫ শতাংশ সরবরাহ করে।
রাশিয়া সার রপ্তানিকারক বড় একটি দেশ। দেশটি নাইট্রোজেন, পটাশ, ফসফরাস ইত্যাদি রপ্তানি করে। আর রাশিয়া থেকে বিশ্বের জ্বালানির একটি বড় অংশ আসে। এ জ্বালানির প্রয়োজন হয় ফসল উৎপাদনে।
কার্যত আমাদের এখন একটি 'জীবাশ্ম খাদ্য' ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় কয়েকটি রপ্তানিকারক দেশ কিছু মৌলিক খাদ্যশস্য উৎপাদন করে। সেগুলো আবার জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়। আদতে এ ফসলগুলোর জমিতে লাঙল দেওয়া থেকে শুরু করে- খাবার থালায় ওঠা পর্যন্ত প্রতিটি পদেই রয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার।
তাহলে আমার কী করা উচিত? এ মুহূর্তে আমদানিকারক দেশগুলো রাশিয়া-ইউক্রেনের বিকল্প খাদ্য-উৎস খুঁজছে। আবার ভারতসহ কয়েকটি দেশ নিজেদের খাদ্য-নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গম ও অন্যান্য খাদ্যশস্য রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে। আরও অনেক দেশই সামনে এ পথ অনুসরণ করতে পারে।
মূলধারার খাদ্যশস্যগুলো উৎপাদন দ্বিগুণ বাড়ানো ক্রমেই একটি নেতিবাচক বিনিয়োগ হিসেবে প্রতীয়মান হবে। আমরা যখন এ মুহূর্তেই ৭৮০ কোটি মানুষকে খাওয়াতে হিমশিম খাচ্ছি; তাহলে ২০৫০ সালে আরও উষ্ণ একটি পৃথিবীতে ১,০০০ কোটি মানুষের ক্ষুধা মেটানো হবে কী করে?
সোজা কথায় বলতে গেলে, আমাদেরকে জীবাশ্ম খাদ্য থেকে বেরিয়ে ভবিষ্যতের জন্য নতুন একটি খাদ্য ব্যবস্থা আঁকড়ে ধরতে হবে। আর এ প্রক্রিয়ায় অবশ্যই জলবায়ু-প্রতিরোধক্ষম ও পুষ্টিকর 'হারিয়ে যাওয়া' ফসলগুলোকে রাখতে হবে।
খাদ্য হিসেবে মানুষ প্রায় ৭,০০০ ধরনের উদ্ভিদ চাষ করেছে। এগুলোর মধ্যে কেবল তিনটি ফসল- গম, ধান, ও ভুট্টা- এখন মানুষের খাবারের ৬০ শতাংশ সরবরাহ করে। আমরা এ ফসলগুলোর ১০ শতাংশ ও ভেজিটেবল তেলের ১৮ শতাংশ জৈবজ্বালানির জন্য ব্যবহার করি। আর এ পরিমাণটি ১৯০ কোটি মানুষের প্রয়োজনীয় খাবারের সমান।
২০২১ সালে চীন ২৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন ভুট্টা আমদানি করে শূকরের খাবার হিসেবে। একই সময়ে ইউরোপে উৎপাদিত গমের ৪০ শতাংশ ও আমেরিকার ৩৩ শতাংশ গম ব্যবহার করা হয়েছিল গোখাদ্য হিসেবে। আমাদের এভাবে খাদ্যশস্যকে প্রাণী ও ইঞ্জিনের পেছনে খরচ করা বন্ধ করতে হবে।
এসবের পাশাপাশি আমাদের চাষ ব্যবস্থায় ভিন্নতা আনা ভীষণ দরকারি। চাষের জন্য শহুরে এলাকা, সাধারণ জমি এমনকি বাগানও ব্যবহার করতে হবে। এ ধরনের বহুমুখী চাষ ব্যবস্থায় প্রতিকূল জলবায়ুতে ফসলকে প্রতিরোধক্ষম করে তুলবে।
সবশেষে আমাদের উচিত খাদ্যকে কেবল বেঁচে থাকার উপাদান বা লাভের উৎস হিসেবে না দেখে, বরং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ- পুষ্টি ও এমনকী আনন্দের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা। ২০২১ সালে প্রকাশ করা হয়েছে ফরগটেন ফুডস-এর বৈশ্বিক ম্যানিফেস্টো। এ ইশতেহারে আহ্বান করা হয়েছে, ফোনিও ও বামবারা গ্রাউন্ডনাটের মতো ভুলে যাওয়া খাবারগুলোকে পরিবর্তনের বাহক হিসেবে ব্যবহার করতে। আমাদেরকে অবশ্যই বৈশ্বিক একই ধরনের 'আল্ট্রাপ্রসেসড' খাবারের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার বদলে স্থানীয়, পুষ্টিকর ও বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবারগুলোকে পুনরায় আবিষ্কার করতে হবে।
এর জন্য প্রয়োজন ভিশন, বিনিয়োগ ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞান। সঙ্গে থাকতে হবে কৃষকদেরও সরাসরি অংশগ্রহণ। কারণ 'বিস্মৃত শস্যগুলো' জন্মানোর ক্ষেত্রে তারা আমাদের চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ।
- সূত্র: ফিন্যান্সিয়াল টাইমস