জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার আহ্বান ৩৯ বিশিষ্ট নাগরিকের
আগামী জাতীয় নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের জন্য নির্বাচন কমিশনের নেওয়া সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক হিসেবে আখ্যা দিয়ে এর ব্যবহার না করার আহ্বান জানিয়েছেন দেশের ৩৯ জন বিশিষ্ট নাগরিক।
মঙ্গলবার (৬ সেপ্টেম্বর) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তারা এই আহ্বান জানান। এছাড়া বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে ইভিএম কেনায় বিপুল ব্যয় করার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান ও আকবর আলি খান, বিচারপতি মো. আবদুল মতিন, আহসান এইচ মনসুর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত এই গ্রুপটি মঙ্গলবার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ আহ্বান জানায়।
ইভিএম ব্যবহারে কমিশনের পদক্ষেপকে অযৌক্তিক বলে অভিহিত করে তারা। তাছাড়া, চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে এই ইলেকট্রনিক ডিভাইস আমদানি করতে বৈদেশিক মুদ্রায় প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করার বিষয়টিও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, "রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়াই নির্বাচন কমিশন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ভোট গ্রহণে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা মনে করি, কমিশনের এ সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক। এটি রাজনৈতিক বিতর্ককে আরও উসকে দেবে এবং কমিশনের বর্তমান আস্থার সংকটকে আরও প্রকট করে তুলবে। আমরা আবারও একটি ব্যর্থ নির্বাচনের কবলে পড়ব, যা জাতি হিসেবে আমাদের চরম সংকটের দিকে ধাবিত করবে।"
অযৌক্তিকতার কারণ সম্পর্কে বিবৃতিতে বলা হয়, প্রযুক্তিগতভাবে ইভিএম একটি 'দুর্বল' যন্ত্র।
"এতে 'ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইল' (ভিভিপিএটি) নেই। যার ফলে কমিশন ভোটের যে ফলাফল ঘোষণা করবে, তা-ই চূড়ান্ত হিসেবে গ্রহণ করতে হবে এবং এটি পুনর্গণনা বা নিরীক্ষা করার সুযোগ থাকবে না। এ কারণেই কমিশনের গঠন করা কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান প্রয়াত জামিলুর রেজা চৌধুরী ২০১৮ সালে ইভিএম কেনার সুপারিশে সই করেননি।"
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, প্রযুক্তির কারণে ইভিএম ব্যবহার করে ডিজিটাল জালিয়াতিও করা সম্ভব। বায়োমেট্রিকভিত্তিক ইভিএম অনেক ভোটারকেই শনাক্ত করতে পারে না। ফলে কমিশন প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের তাদের আঙুলের ছাপ দিয়ে যন্ত্রটি খুলে দেওয়ার তথা ইভিএমকে ওভাররাইড করার ক্ষমতা দিয়ে থাকে।
প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা ও ভোটারদের আস্থাহীনতার কারণে পৃথিবীর অনেক দেশই এখন ইভিএম ব্যবহার থেকে সরে আসছে। প্রযুক্তির দিক থেকে অনেক উন্নত জার্মানি, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসও ইভিএম ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে উল্লেখ করে তারা বলেন, "যেকোনো ইলেকট্রনিক যন্ত্রের মতো প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে ইভিএমের ফলাফল নিয়েও কারসাজি করা যায়।"
পৃথিবীর ১৭৮টির মধ্যে বর্তমানে শুধু ১৩টি দেশ তাদের সব নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করছে।
"এ ছাড়া নির্বাচনের সময়ে মাঠপর্যায়ে নিয়োজিত কারিগরি টিমও নির্বাচনী ফলাফল বদলে দিতে পারেন। গত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অন্তত দুবার ফলাফল প্রকাশের অভিযোগ উঠেছে, যা কেবল ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমেই সম্ভব। এ ছাড়া অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে যে ইভিএম ব্যবহার করার কারণে ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন," বলা হয় বিবৃতিতে।
সম্প্রতি কমিশনের ডাকা সংলাপে যে ২২টি দল ইভিএম নিয়ে মতামত ব্যক্ত করেছে, তার মধ্যে ১৪টি দল এটি নিয়ে তাদের সংশয় ও সন্দেহের কথা উল্লেখ করেছে। এরমধ্যে ৯টি দল সরাসরি ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দিয়েছে। আওয়ামী লীগসহ চারটি দল ইভিএমের পক্ষে ভোট চেয়েছে।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, "প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজেও সংলাপের সময়ে বলেছিলেন, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমে বিশ্বাস করছে না। তাই অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের এ অবিশ্বাস আগামী নির্বাচনকে প্রতিযোগিতামূলক করার পথে একটি বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়াবে।"
"ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্তসংক্রান্ত এক সংবাদ সম্মেলনে সিইসি উল্লেখ করেছেন যে তাদের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত আমলে নেওয়া হয়নি। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ যে গুরুত্বহীন ছিল, তা সুস্পষ্ট হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যতে কমিশনের সঙ্গে নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলের সংলাপও অর্থহীন হয়ে পড়েছে।"
ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার অনুরোধ করে বিবৃতিতে বলা হয়, ইভিএম ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি জনগণের যে আস্থাহীনতা, তা দূর না করেই ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত আগামী নির্বাচন নিয়ে জনমনে সন্দেহ তৈরি হবে ও আরেকটি অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্কের ক্ষেত্র তৈরি করবে।
যে ৩৯ জন বিশিষ্ট নাগরিক বিবৃতি দিয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান ও আকবর আলি খান, বিচারপতি মো. আবদুল মতিন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার।
আরো আছেন- বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির উপাচার্য পারভীন হাসান, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ, আইনজীবী শাহদীন মালিক, অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, আলোকচিত্রশিল্পী শহিদুল আলম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অর্থনীতিবিদ আহসান মনসুর, সাবেক সচিব আবদুল লতিফ মণ্ডল, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, প্রকৌশলী বিডি রহমতুল্লাহ, আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ, সাধনার আর্টিস্টিক ডিরেক্টর লুবনা মরিয়ম, অধ্যাপক স্বপন আদনান, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ, অধ্যাপক ফিরদৌস আজিম, সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, সাংবাদিক কামাল আহমেদ।
এছাড়া নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন, নারীপক্ষের সদস্য শিরিন হক, সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সাইফুর রহমান, আর্টিকেল নাইন্টিনের আঞ্চলিক পরিচালক ফারুক ফয়সাল, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী, মোনাশ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ ও সিনিয়র সফটওয়্যার সল্যুশন আর্কিটেক্ট ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবও আছেন এই তালিকায়।