অচ্ছুৎ: যৌন বৈচিত্র্যের মানুষদের নিয়ে কুইয়্যার শিল্প প্রদর্শনী
'আমি বারবার মাকে বুঝাতে চেয়েছি, ওরিয়েন্টেশন বদলানো যায় না। তারপরও সে বলে, আমি নিজেকে না বদলালে আমার ভবিষ্যতের প্রতিটা দিন ভয়াবহ হবে…আম্মু শুধু ওষুধ খেতে বলে। ওষুধ যে ওরিয়েন্টেশন বদলে দিতে পারে না, এটা তাকে বিশ্বাস করানো গেল না' —
দেয়ালঘেষা তাকে রাখা এক নোটপ্যাডে কথাগুলো লেখা। কারও নাম বা স্বাক্ষর নেই তাতে। কিন্তু গল্পটা খুব চেনা। বাংলাদেশের যৌন বৈচিত্র্যের প্রায় প্রতিটি মানুষের গল্পই যে এমন।
লিঙ্গ ও যৌন বৈচিত্র্যের মানুষদের চেপে যাওয়া এমনই সব গল্প উঠে এসেছে এপিফেনিয়া ভিজুয়্যালস আর্ট গ্যালারিতে আয়োজিত 'অচ্ছুৎ-২০২২' প্রদর্শনীতে। রাজধানীর মিরপুরে অবস্থিত এপিফেনিয়া ভিজুয়্যালস বিশ্বের প্রথম অ্যাসেক্সুয়াল কুইয়্যার আর্ট গ্যালারি হিসেবে পরিচিত। বিশ্বব্যাপী যৌন বৈচিত্র্যময় অ্যাসেক্সুয়াল বা অযৌনচিত্ত মানুষের জীবন যুদ্ধ নিয়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যুক্ত তারা। চলতি এ প্রদর্শনী দর্শকের চিন্তার জগতে ধাক্কা দিবে, ভাবতে বাধ্য করাবে নতুন করে। তিন মাসব্যাপী আয়োজনটি শেষ হচ্ছে চলতি সপ্তাহে।
কিন্তু প্রদর্শনীর নাম 'অচ্ছুৎ' কেন? উত্তর দিলেন প্রদর্শনীর আয়োজক ও কিউরেটর দীপা মাহবুবা ইয়াসমীন।
দীপা বাংলাদেশি অ্যাসেক্সুয়াল অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা। এশিয়ার অ্যাসেক্সুয়াল আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা তিনি। তবে তাঁর কাজ শুধু অ্যাসেক্সুয়ালদের নিয়েই থেমে নেই। বাংলাদেশের অন্যান্য লৈঙ্গিক ও যৌন সংখ্যালঘু মানুষের বিকাশ এবং সেক্স ও জেন্ডার বিষয়ক বিভিন্ন ট্যাবু ভাঙার কাজও করেন তিনি।
দীপা বলেন, 'সমাজ যাদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে তারাই তো 'অচ্ছুৎ'। কিন্তু এখানে অচ্ছুৎ হিসেবে শুধু অ্যাসেক্সুয়াল বা অন্যান্য যৌন বৈচিত্র্যের মানুষদের না, লিঙ্গ ও যৌনতা বিষয়ক যত ট্যাবু বাংলাদেশে রয়েছে সবকিছুকেই অন্তর্ভুক্ত করেছি। এরমধ্যে যেমন যৌনকর্মীদের বিষয় আছে, তেমনই আছে কিশোরীদের মাসিকের মতো চেপে যাওয়া বিভিন্ন বিষয়াদি। সবকিছু যেন এই একটি শব্দের মধ্য দিয়েই প্রকাশ করা যায়, সেটা মাথায় রেখেই এই অচ্ছুৎ নামকরণ'।
অযৌনচিত্ত মানুষদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'এমন অনেক মানুষই আছে যারা যৌন সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী না। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ বিষয়টা বুঝে না। অসংখ্য বিবাহিত নারী আছেন যারা সম্পর্ক স্থাপনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না বলে বৈবাহিক ধর্ষণের মতো নির্যাতনের শিকার হন। আবার অনেক পুরুষও আছেন যারা অযৌনচিত্তের। এই পুরুষদেরও সমাজ শারীরিকভাবে অক্ষম বিবেচনা করে। অথচ তারা কিন্তু অসুস্থ নন। তারা সুস্থ-স্বাভাবিক এবং এটাই তাদের প্রকৃতি।'
দীপা জানান, বিভিন্নতার আঙ্গিকে অ্যাসেক্সুয়ালদের পরিসর অনেক বড়। অনেকে ভাবেন তারা যৌন সম্পর্কের বিরোধী। আসলে তা না। অনেকে আছেন যারা কারও স্পর্শও সহ্য করতে পারেন না। তাদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ও অধিকার আদায়ের চিন্তা থেকেই আমাদের আয়োজন শুরু হলেও এখন এতে অন্যান্য ট্যাবু বিষয়গুলোও যুক্ত করা হয়েছে। তাঁর আরও একটি সংগঠন অ্যাসেক্সুয়াল প্রাইড এশিয়া এখন আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপ্রাইডের সদস্যপদ প্রাপ্ত সংগঠন।
এবার থেকে প্রতিবছরই প্রদর্শনীটির আয়োজন হবে বলে জানান দীপা। জুন মাস লিঙ্গ ও যৌন বৈচিত্র্যের মানুষদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। এসময় বিশ্বব্যাপীই বৈচিত্র্যের উদযাপন করেন সাধারণ মানুষ। তাদের সঙ্গেই সংহতি প্রকাশ করতে প্রান্তিক মানুষদের সমানাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে উদযাপিত হবে 'অচ্ছুৎ'।
চলতি বছর ১৭ মে আয়োজিত আইডাহবিটে এশিয়ার অ্যাসেক্সুয়াল কুইয়্যার কমিউনিটির সদস্যদের নিয়ে পিটিশনের আয়োজন করে এশিয়ান নেটওয়ার্ক অব অ্যা-স্পেক কুইয়্যার আর্কাইভস (অ্যানোয়াকা)। এশিয়ার ১২টি দেশের অযৌনচিত্তের মানুষরা এই পিটিশনে তাদের অভিজ্ঞতার কথা জানান। অ্যাসেক্সুয়ালদের নিতে ভীতি বা বিদ্বেষমূলক ফোবিয়ার বিরুদ্ধে কথা বলেন তারা। পিটিশনে ওঠে আসা গল্প ও অভিজ্ঞতাগুলোও জানা যাবে এই আয়োজনে।
ভাষা ও ক্ষমতার রাজনীতি সম্পর্কেও ভাবতে শেখাবে এই প্রদর্শনী। 'অচ্ছুৎ' শব্দটি কি কুইয়্যার শব্দটির বাংলা পারিভাষিক রূপ হতে পারে কি না এমন প্রশ্নও দীপা রাখেন দর্শকদের উদ্দেশ্যে।
অচ্ছুৎ-এ নজর কেড়েছে চারুকলার শিক্ষার্থী আহসানার একটি শিল্পকর্ম। আহসানা অঙ্গনা ছোট থেকেই একজন জেন্ডার ফ্লুইড বা লিঙ্গ তারল্যের মানুষ। নিজের সত্ত্বা নিয়ে দ্বন্দ্ব আর বহুস্তরের সম্মিলনই ফুটে উঠেছে তার শিল্পকর্মে।
ছয় পরতের কাপড়ে ছয়টি রঙ ব্যবহার করে নির্মিত শিল্পকর্মটির নাম ইনসাইড-আউট, অর্থাৎ ভেতর-বাহির। এই ছয়টি রঙই নির্দেশ করে বৈচিত্র্যের উদযাপন। আর তাই সেটা ব্যবহার করেই নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশের চেষ্টা করেছেন আহসানা।
আরেকটি দেয়ালে দেখা গেল হাতভর্তি ডিম নিয়ে মুখ ঢাকা এক প্রতিকৃতি। নারী ও পুরুষের বাইনারি পরিচয় ও চিরাচরিত প্রজনন ধারণাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে এই ছবি। সামাজিক স্বীকৃতি পেতে প্রচলিত নিয়ম মেনে সন্তান জন্মদান কি বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত? এমন অনেক মানুষই তো আছেন যারা নারী-পুরুষ বা কারও প্রতিই যৌন আকর্ষণ বোধ করেন না। অ্যাসেক্সুয়াল বা অযৌনচিত্তের এই মানুষদের কথা কি অন্যরা বুঝতে পারে? সমাজ ও পরিবারে তারা কতটুকু চাপের মধ্যে থাকেন? শিল্পী নিজেই এখানে অ্যাসেক্সুয়াল ও অ্যাজেন্ডার হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছেন; আর্টের মাধ্যমে চেষ্টা করেছেন নিজেকে মেলে ধরতে, মনের কথাগুলো বলতে।
প্রদর্শনীতে নাইমী নাফসিন ও আহমেদ সাকি নিজেদের পারফরম্যান্স আর্ট উপস্থাপন করেন।
'বারডেন অ্যান্ড জেন্ডার' পারফরম্যান্স আর্টে নাইমী দেখান সমাজের জেন্ডার ধারণার বেড়াজালে কীভাবে একজন মেয়ে ক্রমাগত নিষ্পেষিত হতে থাকে।
মেয়ে মানেই পুতুল খেলা, ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি, পাউডার আর লিপস্টিক দিয়ে সাজা, নিয়ম করে শেভ করা, বউ সাজা, সন্তান পালন এমন আরও কত ধারণাই তো আছে।
কিন্তু কে কী ব্যবহার করছে, কীভাবে সাজছে সেটা দিয়েই কেন সমাজ জেন্ডার নির্ধারণ করতে চাইবে? শুধু নির্ধারণই না কখনো তো এটা পুরোপুরি চাপিয়ে দেওয়া এক বিষয়। কিন্তু কে কী চায়, কারও মনের সেই খবর কি কখনো সমাজ রেখেছে?
এমনকি রঙেরও লিঙ্গ নির্ধারণ করে রেখেছে সমাজ। সোনালি মেয়েদের রঙ, রূপালি ছেলেদের এমনটাই শুনে এসেছেন আহমদ সাকি। কিন্তু এই দুটো রঙের দুটি সত্ত্বাই যে মানুষ ধারণ করে তাই দেখানোর চেষ্টা করেন তিনি।
প্রদর্শনীতে দেখা মিলবে জবা ফুলের ইন্সটলেশন। কিন্তু এই জবার তাৎপর্য কী? উত্তর দিলেন শিল্পী অয়োময় অরণ্য। জবা একটি উভলিঙ্গ ফুল। পুরুষ ও প্রকৃতির দ্বৈত এই সত্ত্বা মিলে তৈরি হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক সত্ত্বা, যুগ যুগ ধরে যা তৃতীয় প্রকৃতি হিসেবে পরিচিত।
প্রদর্শনীতে দীপা মাহবুবা ইয়াসমীনের পরিচালিত তিনটি ডকুমেন্টারি ও শর্ট ফিল্ম প্রদর্শিত হয়। এর একটি একটি বাংলাদেশের লোকনাট্যাভিনয়ে ক্রসড্রেসিং বা বিপরীত সজ্জা ধারণ নিয়ে। বাংলা যাত্রায় নারীবেশে পুরুষের অভিনয় করার রীতি বহু পুরোনো।
কিন্তু নারী সাজেন বলেই যে তারা ট্রান্সজেন্ডার বা হিজড়া হন এমন কিন্তু নয়। বরং কাজের প্রতি ভালোবাসা থেকেই এর সঙ্গে যুক্ত থাকেন এই অভিনয়শিল্পীরা। বাংলাদেশের অঞ্চলভিত্তিক মাদারিপীরের পালার এমনই এক ছুকরি অভিনয়শিল্পীর জীবন ও অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে ডকুমেন্টারিতে।
মাহবুব তনয়কে লেখা এক খোলা চিঠির ওপর ভিত্তি করে দীপার 'প্ল্যানচেট অন ২৫ এপ্রিল' শর্টফিল্মটি এর আগেও দেশের বাইরে বহু আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভালে প্রদর্শিত হয়। সবচেয়ে বেশিবার এর প্রদর্শনী হয় যুক্তরাজ্যে।
তাঁর তৃতীয় শর্টফিল্ম 'লংগেস্ট নাইট অব দ্য ইয়ার নিয়ে যাবে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের সেই চিরচেনা গল্পে। কিন্তু এই রাধা আমাদের পুরাকথার রাধার চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন। রাধা এখানে আবির্ভূত হবেন দর্পোদ্ধত প্রতাপ নিয়ে। আর কৃষ্ণকে দেখা যাবে নৈবেদ্য হাতে অপেক্ষা করতে।
গত ২০ মে জার্মানির বার্লিনের শোভোজ মিউজিয়ামে ফিল্ম তিনটি প্রদর্শিত হয়।
অচ্ছুৎ- এর প্রদর্শনীর উদ্বোধনী আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন ব্রিটিশ কাউন্সিল বাংলাদেশের ডিরেক্টর টম মিসিওসিয়া, আর্টিস্ট টেরেসা আলবর, প্রফেসর সামিনা লুৎফাসহ আরও অনেকে। এছাড়াও নন্দিত কিউরেটর ডিয়ানা ক্যাম্পবেল বেটনকোর্টর এই প্রদর্শনী পরিদর্শনে আসেন।