হঠকারী বাইডেন ও পুতিন!
২১ সেপ্টেম্বর, বুধবার পুতিনের দেওয়া ভাষণ যারা শুনেছেন– তাদের বেশিরভাগই আঁতকে উঠতে বাধ্য হয়েছেন। প্রতিক্রিয়া এমন হওয়ারই কথা। কারণ পুতিনের ভাষায় চরম অস্থিরতা ও হুমকির সুর স্পষ্ট ছিল।
জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে দেওয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ভাষণ– পরিস্থিতি লঘু না করে আরও মন্দের দিকে নিয়ে গেছে। যেহেতু বাইডেন সব দোষের বোঝা নিঃসংকোচে চাপিয়েছেন পুতিনের মাথায়।
দুই বিশ্বনেতার এই মারমুখো ভাষণ- প্রতিভাষণের পালা দুনিয়ার জন্য সুখবর নয়। বরং আরও বড় যুদ্ধের ইঙ্গিত দেয়, যা ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
পুতিন ও বাইডেন দুজনেই মনে করছেন, তারা এভাবে অন্ধের মতো জুয়ো খেলতে পারেন। হয়তো তারা ভুলে যাচ্ছেন, এ খেলায় তাদের দুজনের হার নিশ্চিত। আর একইসাথে মহাবিপন্ন হবে বিশ্ব।
ইউক্রেন যুদ্ধে– হয় হার নয়তো বিজয়ই একমাত্র ফলাফল– এমন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা বিপজ্জনক। কারণ রাশিয়া যদি হারের মুখে ব্যাপক গণবিধ্বংসী অস্ত্রের ব্যবহার করে; অথবা যদি রুশ শাসকগোষ্ঠীর পতনই ঘটে–তাহলে তো বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পরমাণু অস্ত্র থাকা একটি দেশ অরাজকতার মধ্যে পড়বে। আরও উগ্র গোষ্ঠীর হাতে তখন যেতে পারে এসব অস্ত্র। এমন ঘটনায় পুতিনের শত্রুদেরও স্বার্থরক্ষা হবে না।
১৯৬০ এর দশকের কিউবার মিসাইল সংকটের কথা মনে আছে? স্নায়ুযুদ্ধের সে সময়ে পৃথিবী পরমাণু যুদ্ধের সবচেয়ে কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছিল; বিশ্বাস করুন আজ আমরা তার চেয়েও বিপজ্জনক সময়ে উপনীত হয়েছি।
দুঃখজনক হলেও বলতেই হয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার দায়িত্বের সাথে জড়িত বিপদের গভীরতা সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা রাখেন না। আর তা প্রমাণ করেছেন, উত্তেজক শব্দচয়নের মাধ্যমে, কোনোভাবেই যা শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখবে না।
দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্যের দায় বাইডেনের একার নয়, ইউরোপের নেতারাও তার চেয়ে ভালো কিছু করছেন না। ইউরোপ ও ন্যাটোর নানাবিধ ঘোষণা ক্রেমলিনকে যেভাবে রুষ্ট করছে, তার আক্রোশ যেকোনো সময় আগ্নেয়গিরি রূপে ফেটে পড়তে পারে। আর আমরা জানি, আগ্নেয়গিরি এখানে গণবিধ্বংসী অস্ত্র–যার ব্যবহার পৃথিবীকে অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নেবে।
অবশ্য পুতিনও খুব বাজে বিবৃতি দিচ্ছেন। কিন্তু, আমাদের আগুনে ঘি ঢালে এমন বাক্যবাণের দরকার নেই, বিশ্বশান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য চাই ইউক্রেন সংকটে বাস্তবিক ও কার্যকর সমাধান গ্রহণ। রাশিয়ার ক্ষেত্রেও তা করতে হবে পশ্চিমাদের।
পুতিনের বিকল্প আরও খারাপ হবে এমন সম্ভাবনাই বেশি। পুতিনের বদলে কোনো উন্মাদের হাতে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়া–পুরো পৃথিবীর জন্য হবে চরম দুর্ভাগ্যের। অথচ, এরমধ্যেই রাশিয়ায় অশান্তির হাওয়া বইছে, কেউ বলতে পারে না এরপর কী হবে?
এই যুদ্ধের প্রধান পক্ষ যুক্তরাষ্ট্র (মতান্তরে এমন বলাই হয়), বা ন্যাটো-ও রাশিয়ার সাথে কোনো যুদ্ধবিরতি কার্যকরে ভূমিকা রাখতে পারবে না। যেহেতু দ্বিপাক্ষিক আস্থা শুধু শূন্য নয়, বরং ঋণাত্মকের কোঠায়। অথচ এই মুহূর্তে একটি আপোষ-সমঝোতা হওয়া অতি-জরুরি।
ইউক্রেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র– প্রায় সব দেশ (রাশিয়া ছাড়া) তা নিয়ে একমত এবং তারা মনে করে ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড কারো বিকিয়ে দেওয়ার সম্পত্তি নয়। এমনকী রাশিয়ার ভূকৌশলগত অংশীদার চীনও তাই বলে।
তবে সবাইকে আরেকটি বিষয়ে একমত হতে হবে। আর তা হলো আলোচনার মাধ্যমে ইউক্রেনের উচ্চাভিলাষ কতদূর যাবে– তার সীমা নির্ধারণ। নাহলে রাশিয়া চিরদিনই কিয়েভকে হুমকি হিসেবে দেখবে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা রয়ে যাবে সুদূরপরাহত।
কিয়েভের কর্তারা উল্টো যদি যুদ্ধকে আরও তীব্র করে তোলেন, তাহলে রাশিয়া হয়তো পরমাণু অস্ত্রের ট্রিগার চাপবে। অথবা ন্যাটো সদস্য কোনো দেশে হামলার মাধ্যমে ইউরোপে শুরু করবে আরও বৃহত্তর যুদ্ধ।
তাই কে জিতবে– এটা কোনো প্রশ্ন হতে পারে না এখানে। মূল প্রশ্ন হলো– আখেরে ফলাফল কী হবে? আর সে পর্যন্ত আসতে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হবে বা কত সাধারণ মানুষকে নিষ্প্রয়োজনে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে হবে?
তাই সমাধানের দিকে নজর দেওয়াই আজ একান্ত জরুরি। এ সংকটের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কিছু সমাধান কেমন হতে পারে তার একটি রূপরেখা তুলে ধরা হলো এখানে–
১. যেকোনো সমঝোতার মূল ভিত্তি নিহিত দুটি বিষয়ের ওপর (ক) রুশভাষী ইউক্রেনীয় জনসংখ্যার সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ এবং (খ) এজন্য উভয় পক্ষকে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। অর্থাৎ, ইউক্রেনে ন্যাটো জোটের উপস্থিতি যেমন থাকবে না, তেমনি রাশিয়ার কোনো সৈন্যও ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডে থাকবে না।
২. ২০১৫ সালের মিনস্ক-২ সমঝোতা অনুসারে, লুহানস্ক ও দনেয়স্ক অঞ্চলের ইউক্রেনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছিল। ইউক্রেনের সর্বোচ্চ পরিষদ বা রাদা এবিষয়ে একটি আইন পাস করবে বলে সেখানে সুপারিশ করা হয়। তবে ইউক্রেনের অংশ রয়ে গেলেও, প্রদেশ দুটি ইউক্রেনের সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমের বাইরে থাকবে– এমন প্রস্তাব দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের মিনস্ক চুক্তি কখনই বাস্তবায়িত হয়নি। এবার সেটিকে হিমঘর থেকে তুলে এনে প্রাণ সঞ্চার করতে হবে।
৩. এক্ষেত্রে দুইটি বিষয় আরও গুরুত্বপূর্ণ (ক) স্বায়ত্তশাসনের সংজ্ঞা নির্ধারণ এবং (খ) আন্তর্জাতিক গ্যারান্টির মাধ্যমে রুশভাষী ইউক্রেনীয় জনসংখ্যাকে নিরাপত্তা দান। বিপরীতে, অঞ্চলগুলির কর্তৃপক্ষ এবং রাশিয়াকে অরুশভাষী জনসংখ্যার নিরাপত্তা নিশ্চিতে সম্মতি দিতে হবে।
৪. মিনস্ক সমঝোতার আওতা বাড়িয়ে অধিকৃত ক্রিমিয়াকেও তার আওতায় আনতে হবে। বিনিময়ে সেভেস্তোপল বন্দরের দাবি ছেড়ে দেবে ইউক্রেন। ইতঃপূর্বে রাশিয়ার সাথে বন্দরটি যৌথভাবে ব্যবহার করলেও, এখন সে সুযোগ নেই। রাশিয়া এত ক্ষয়ক্ষতির পর উষ্ণ পানির এ বন্দর ছাড়বে না। তবে ক্রিমিয়া মিনস্ক এগ্রিমেন্টের আওতায় এলে তাতে ইউক্রেনও লাভবান হবে।
৫. ইউক্রেনে অস্ত্র ও সেনা মোতায়েন না করার অঙ্গীকার দিতে হবে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোকে। ইউক্রেনকে ন্যাটোর প্রত্যক্ষ সদস্যপদ তো নয়ই এমনকী বা প্রক্সি বা পরোক্ষ সহযোগীও করা যাবে না।
৬. ন্যাটো, যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়াকে ইউক্রেনের সীমানার বিষয়ে একমত হতে হবে এবং সেটির অখণ্ডতা রক্ষার সুষ্পষ্ট নিশ্চয়তা দিতে হবে।
৭. রুশ সংস্কৃতি ও ভাষার পাশাপাশি রুশভাষী জনগোষ্ঠীর ধর্মাচার ও শিক্ষাগত চাহিদাকে সম্মান করার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে ইউক্রেনকে।
৮. বাইডেন প্রশাসন ও ন্যাটো জোট ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কি এবং পুতিনের সাথে সম্মেলনে অংশ নিতে পারে। তবে সেখানে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, সংবিধান সংশোধন এবং জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী (অইউরোপীয়) মোতায়েনের নিজস্ব ধ্যানধারণা নিয়ে হাজির হওয়া উচিত হবে না তাদের।
৯. এই যুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে হবে।
১০. উভয়পক্ষের সকল বন্দী বিনিময় করতে হবে। কোনো বন্দীকে হত্যা বা নির্যাতন করা যাবে না।
১১. উপরের প্রস্তাবগুলি সফলভাবে বাস্তবায়ন হওয়ার পর, রাশিয়াকে তাদের সমস্ত সেনা প্রত্যাহার করতে হবে। পাশাপাশি ডনবাসের দুটি নবীন প্রজাতন্ত্রের নিজস্ব বাহিনীর সংখ্যা হ্রাস করতে হবে।
১২. বাইডেনের রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা ও ন্যাটো জোটের চরম বৈরী অবস্থান নেওয়ার কারণে সমঝোতার ভারটি দেওয়া হোক জাতিসংঘের মহামান্য মহাসচিবের ওপর। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সকল তৎপরতা তার নির্দেশিত পথেই করা হোক।
সর্বোপরি আমেরিকাকে একটি আপোষে সম্মতি দিতে হবে। আমেরিকা কোনোদিন মিনস্ক সমঝোতাকে সমর্থন করেনি, যা ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। বর্তমানের চরম সংকটকালে বাইডেন প্রশাসনকে তাই দায়িত্বশীল কাজ করতে হবে।
আর এসব কিছু করতে সময় মিলবে আর মাত্র দুই থেকে তিন মাস। মানতেই হয়, পরিস্থিতি অনেক উত্তেজক এবং অস্থিতিশীল। কিন্তু, কোনো ধরনের সমঝোতার চেষ্টা না করলে, মেরামতের আগেই মাথার ওপর পুরো দালান ভেঙ্গে পড়বে।
- সূত্র: এশিয়া টাইমস