হৃদরোগে আক্রান্ত ৪০% শিশুই প্রতিবছর চিকিৎসার অভাবে মারা যায়
জন্মগত হৃদরোগে ভুগছে ৬ মাস বয়সী শিশু জুবায়ের। রোগ শনাক্তের পরপরই শিশুর পরিবারকে জরুরি ভিত্তিতে হার্টে অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দিয়েছেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ।
একমাত্র সন্তানকে বাঁচাতে জুবায়েরের কৃষক বাবা আকসার আলী গ্রামের কিছু জমি বিক্রি করে এবং আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ধার নিয়ে অপারেশন বা অস্ত্রোপচাররের ৩ লাখ টাকা জোগাড় করেছেন। তবে একমাস ধরে অপেক্ষায় থাকার পরও অপারেশনের জন্য সিরিয়াল পায়নি জুবায়ের।
হার্ট ফাউন্ডেশনে জুবায়েরের মত অস্ত্রোপচারের অপেক্ষায় থাকা কয়েকশো শিশু হৃদরোগীর বিপরীতে পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সার্জন বা শিশু হৃদরোগ চিকিৎসক আছেন মাত্র দুইজন।
শুধু ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনেই নয়, সারাদেশে শিশু হৃদরোগীর জন্য কার্ডিয়াক সার্জন আছেন মাত্র ১২ থেকে ১৫ জন, যেখানে প্রয়োজন প্রায় ৩০০ জন।
দেশে বড়দের হৃদরোগ চিকিৎসায় যুগান্তকারী উন্নতি ঘটলেও পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজি একেবারেই অবহেলিত।
২০০১ সালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ (এনআইসিভিডি) শিশুদের জন্য একটি কার্ডিওলজি বিভাগ চালু করে। ২০০২ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা নেওয়ার সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ হাজার ৬৭৬। গেলো বছর ২০২১ সালে এসে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০ হাজার।
প্রতিদিন গড়ে ৬০ থেকে ৭০ জন শিশু এনআইসিভিডি'র আউটডোর সেবা গ্রহণ করে। তবে এখানে শিশু ও নবজাতকের অস্ত্রোপচারের কোনো সুবিধা নেই।
জুবায়েরের পরিবার দেশের একমাত্র সরকারি হৃদরোগ বিশেষায়িত হাসপাতাল এনআইসিভিডিতেও যোগাযোগ করে। কিন্তু এই হাসপাতালে শিশুদের হৃদযন্ত্রে অস্ত্রোপচার করা হয় না।
আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, দেশে পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিস্টেরও সংকট রয়েছে। পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সোসাইটি অব বাংলাদেশ (পিসিএসবি) জানায়, দেশে পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিস্টের সংখ্যা ৩০ জনের বেশি নয় এবং তাদের প্রায় সকলেই কেবল ঢাকায় চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।
পিসিএসবির সভাপতি এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজেসের শিশু কার্ডিওলজি বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, দেশে শিশু হৃদরোগ চিকিৎসা এখনো তেমন উন্নত হয়নি, কারণ এটি লাভজনক নয়।
অধিকাংশ শিশু হৃদরোগীর পরিবার দরিদ্র। ডাক্তাররা এ লাইনে আসতে চান না, কারণ এখানে আয় কম বলে জানান তিনি।
"বড়দের হার্টের চিকিৎসায় উপার্জন বেশি। আরেকটি কারণ হলো, অবকাঠামোগত সমস্যা। ডাক্তারদের কাজ করতে গেলে কার্ডিয়াক ক্যাথল্যাব, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি প্রয়োজন হয়। কিন্তু এগুলো আমাদের দেশে অপ্রতুল। ইনভেস্টররা এদিকে আসতে চায়না, কারণ লাভ কম। ছোট বাচ্চাদের জন্য ডেডিকেটেড দক্ষ নার্স বা অন্যান্য স্টাফ নেই। শিশুদের জন্য ডেডিকেটেড আইসিইউও নেই," যোগ করেন তিনি।
চিকিৎসকরা বলছেন, শিশুদের হৃদরোগের কারণ হলো জেনেটিক। জন্মের সময় কোনো ত্রুটি, গর্ভবতী মায়ের সংক্রামক রোগ, যেমন-মা যদি রুবেলার মতো সংক্রামক ভাইরাসে আক্রান্ত হন, তেজস্ক্রিয়তা এবং পরিবেশ দূষণের মতো যেকোনো কারণে শিশুরা কনজেনিয়াল হার্ট ডিজিজ (সিএইচডি) বা জন্মগতভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হতে পারে।
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, শিশুদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার চিত্র বেশি দেখা যায় দরিদ্র পরিবারে। কারণ দরিদ্র পরিবারের মায়েরা গর্ভকালীন অপুষ্টিতে ভোগেন; সেইসঙ্গে, এ সময়ে যেই যত্নের প্রয়োজন হয় সেটি তারা পান না এবং নানান ধরনের সংক্রামক রোগে ভোগেন। এসব কারণে অনেক সময় গর্ভের শিশুও সিএইচডি নিয়েই জন্মগ্রহণ করে।
যদিও এ ধরনের সমস্যা দ্রুত শনাক্ত করা গেলে ভবিষ্যতে জটিলতা এড়ানো সম্ভব, কিন্তু বেশিভাগ দরিদ্র পরিবারের শিশুদের বাড়িতেই জন্ম হয়। ফলে এসব ক্ষেত্রে রোগ দ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। বেশিরভাগই ডাক্তারের কাছে তখন যান, যখন সমস্যা জটিল আকার ধারণ করে।
দেশে হৃদরোগের চিকিৎসা দেয় এমন বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে ল্যাবএইড অন্যতম। এখানে হৃদরোগে আক্রান্ত বড়দের ক্ষেত্রে সব ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হলেও শিশুদের ক্ষেত্রে চিকিৎসার সুযোগ কম। শিশুদের চিকিৎসার জন্য মাত্র ৬টি শয্যা রয়েছে এই হাসপাতালে। এমনকি, অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রেও রয়েছে প্রতিবন্ধকতা।
ল্যাবএইড গ্রুপের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক ডা. এ এম শামীম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, মূলত অর্থনৈতিক কারণেই দেশে শিশুদের হৃদরোগের চিকিৎসার তেমন উন্নতি হচ্ছে না।
"হৃদরোগে আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগীর পরিবার দরিদ্র। আমরা এমন পরিবার থেকেও রোগী পাই, যারা শিশুর হৃদরোগ চিকিৎসায় ৯০ হাজার টাকা দিয়ে ডিভাইস কেনার সামর্থ্য রাখে না", বলেন শামীম।
"এছাড়া, শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরও ঘাটতি রয়েছে। চিকিত্সা বা অস্ত্রোপচারের সময় কোনো শিশুর মৃত্যু হলে, পিতামাতার কাছ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া আসে। এসব ঝামেলা এড়াতে এক্ষেত্রে বিনিয়োগের পরিমাণও কম," যোগ করেন তিনি।
তবে তিনি আরও জানান, ল্যাবেইড সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাসহ আগামী বছর ৪০ শয্যা বিশিষ্ট একটি পূর্ণাঙ্গ পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক ইউনিট চালু করতে যাচ্ছে।
ডা. এ এম শামীম বলেন, শিশু-হৃদরোগের চিকিৎসায় বেসরকারি-সরকারি অংশীদারিত্ব অপরিহার্য। এ বিষয়ে সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকির আহ্বান জানিয়ে, ভারতের মহারাষ্ট্রের উদাহরণ তুলে ধরেন তিনি। যেখানে সরকারি ভর্তুকিতে শিশুদের হৃদরোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে।
বর্তমানে দেশে প্রায় ৪ লাখ শিশু বিভিন্ন ধরনের হৃদরোগে ভুগছে। প্রতি বছর প্রায় ৫০ হাজার শিশু জন্মগতভাবে হৃদরোগ নিয়েই জন্ম নেয়।
পিসিএসবি-এর মতে, প্রতি বছর হৃদরোগে আক্রান্ত প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু চিকিৎসার অভাবে মারা যায়।
এখনও প্রাথমিক ধাপেই আটকে আছে শিশুদের হৃদরোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা
বাংলাদেশে মাত্র সাতটি মেডিকেল ইনস্টিটিউট শিশুদের বিভিন্ন ধরনের হৃদরোগের চিকিৎসা দেয়। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- এনআইসিভিডি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ঢাকা শিশু হাসপাতালে শিশুদের জন্য কার্ডিওলজি বিভাগ, ইবনে সিনা হাসপাতাল, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) ঢাকা, এবং ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট।
এরমধ্যে শুধু হার্ট ফাউন্ডেশন ও সিএমএইচেই নবজাতকদের অস্ত্রোপচার হয়। এই দুটি হাসপাতালেই কেবল শিশু রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত পরিকাঠামো ও যন্ত্রপাতি রয়েছে।
পিসিএসবি বর্তমানে শিশু হৃদরোগীদের চিকিৎসায় জনবল উন্নয়নের কাজ করছে। পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিতে এমডি এবং এফসিপিএস কোর্স চালু করা হয়েছে।
ডা. আবদুস সালাম অবশ্য আরও বলেন, সরকারি সেটআপে শিশু সার্জনের আলাদা কোনো পদ না থাকায় সার্জনরা এ বিষয়ে আগ্রহী নন।
তিনি বলেন, দেশে শিশুমৃত্যুর হার কমাতে সরকারের উচিত শিশু হৃদরোগের চিকিৎসায় গুরুত্ব দেওয়া।
গতবছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) একটি পূর্ণাঙ্গ পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজি অ্যান্ড পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সার্জারি ইউনিট নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০২১ সালের জুলাই থেকে সেখানে সীমিত পরিসরে চিকিৎসা কার্যক্রমও শুরু হয়েছে।
ভারতের বিশেষজ্ঞ সার্জনরা বিএসএমএমইউ-তে জটিল পেডিয়াট্রিক হৃদরোগীদের অস্ত্রোপচারও করছেন। সেইসঙ্গে, এই প্রতিষ্ঠান দক্ষ নার্স আনারও উদ্যোগ নিয়েছে। বিএসএমএমইউ'র পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজি ও পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সার্জারি ইউনিট পুরোপুরি চালু হলে শিশু হৃদরোগীদের দুর্ভোগ কিছুটা কমবে বলে মনে করছেন শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা।
আজ ২৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ব হার্ট দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য হলো, 'ইউজ হার্ট ফর এভ্রি হার্ট'।