একাই ভুগছেন দুগ্ধ খামারিরা
পাবনার ভাংগুরা থানার দুগ্ধ খামাড়ি খোকন বিশ্বাসের ১০টা গাভীর মধ্যে ৩টা প্রতিদিন ৬০ লিটার পর্যন্ত দুধ দেয়। যে দুগ্ধ কোম্পানি তার কাছ থেকে দুধ কেনে তারা সম্প্রতি খুচরা মূল্য এবং দুধ সংগ্রহের দাম দুটোই বাড়িয়েছে।
নতুন দাম অনুযায়ী, খোকন এখন প্রতি লিটার দুধ বিক্রিতে ৪৬ টাকা করে পাচ্ছেন যা আগের রেট থেকে ২.৭০ টাকা বেশি। কিন্তু পাবনায় এক লিটার দুধের উৎপাদন খরচ এখন ৫০ টাকার বেশি বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশন।
খোকন বলেন, "একজন শ্রমিক আগে দৈনিক ৪০০-৪৫০ টাকায় পাওয়া যেত, কিন্তু এখন ৭০০ টাকার নিচে পাওয়া যায়না। খৈলের দাম পাঁচ বছরের ব্যবধানে ৩৫ টাকা থেকে বেড়ে ৫০-৫৫ টাকা হয়েছে, প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে ভুসির দাম।"
"এই অবস্থায় দুধ বেচে লাভ করার সুযোগ নেই। যে টাকা দুধ বিক্রি করি, তা খাবার কিনতেই চলে যায়," বলেন তিনি।
দুধ ও দুদ্ধজাত পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো দুধের দাম বাড়ালেও তা দিয়ে উৎপাদন খরচ তুলতে পারছেন না দুগ্ধ খামারিরা। এসব খামারিরা বরাবরই এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেলেও এই সেক্টরকে ঘিরে গড়ে উঠা প্রসেসিং ইন্ডাষ্ট্রি, ফিড ইন্ডাষ্ট্রি ও ভেটেরিনারি মেডিসিন উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো পণ্যের দাম বাড়িয়ে তাদের মুনাফা ধরে রেখেছে।
পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, ময়মনসিংহ সহ বিভিন্ন জেলার খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রসেসিং কোম্পানিগুলো (৪.০-৫.০ ফ্যাট সমৃদ্ধ দুধ) কিনছে প্রতি লিটার ৪৬ টাকায়, যা পাঁচ বছর আগে ছিল ৩৩ টাকা। অর্থাৎ এই সময়ে দুধের দাম বেড়েছে ৩৯.৪০ শতাংশ।
এছাড়া, প্রতি লিটার পাস্তুরিত দুধ বর্তমানে বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকায়, যা ২০১৮ সালে ছিল ৬৫ টাকা। বছর দুয়েক আগেও ৫০০ গ্রামের একেকটি দইয়ের দাম ছিল ৮০ টাকা, যা এখন বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা পর্যন্ত দামে।
খামারিরা বলছেন, আগে কোম্পানিগুলোর চাহিদা কমলে দুধের দামও কমিয়ে দিত কোম্পানিগুলো। ২০১৮ সালেই দুই দফায় দাম কমানোর ঘটনা ঘটেছিল। তবে এখন খুব বেশি দাম না বাড়ালেও অন্তত কমাচ্ছে না।
এই বছর ২.৭০ টাকা এবং গত বছর কিছু কোম্পানি ১.৫-১.৭৫ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়িয়েছিল।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের মতে, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া এবং ময়মনসিংহ বাংলাদেশে দুগ্ধের প্রধান কেন্দ্রস্থল।
প্রাণিসম্পদ পরিষেবা বিভাগের তথ্য অনুসারে, দেশে দুগ্ধ খামারির সংখ্যা প্রায় ২০ লক্ষ। ২০২২ অর্থবছরে তারা ১.৩০ কোটি টন তরল দুধ সরবরাহ করেছেন।
বিভাগের তথ্য বলছে, নেতৃস্থানীয় দুগ্ধ প্রসেসর যেমন মিল্ক ভিটা, আড়ং, প্রাণ এবং আকিজ ২০২২ অর্থবছরে প্রায় ৮ লক্ষ টন দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্য বিক্রি করেছে।
গবাদি পশু পালনকে কেন্দ্র করে, প্রায় ২৫০টি নিবন্ধিত ফিড উৎপাদনকারী এখন বাজারে রয়েছে। বাংলাদেশের ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের মতে, স্থানীয় বাজারের জন্য নির্মাতারা প্রতি বছর ৫.৩ লাখ টন ফিড উৎপাদন করে।
বেসরকারি তথ্য অনুসারে, স্থানীয় ভেটেরিনারি ওষুধের বাজারের আকার প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা, যা চাহিদার প্রায় ৭০ শতাংশ পূরণ করে।
খামারিরা বলছেন, খামারের খরচের ৭০ শতাংশই গবাদি পশুর খাদ্য। গত পাঁচ বছরে সব ধরনের ফিডের দাম অন্তত ৫০ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়াও, ভেটেরিনারি ওষুধের খরচ ২৫ শতাংশের বেশি, শ্রম খরচ ১০০ শতাংশ এবং ইউটিলিটি বিল কমপক্ষে ২০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
কিন্তু কৃষক পর্যায়ে দুধ সংগ্রহের হার সে গতিতে বাড়েনি।
বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার খামাড়ি মো জাহিদুল ইসলাম বর্তমানে 8টি গাভী পালন করছেন। শ্রমিকের খরচ বেশি বলে তিনি ও তার স্কুল পড়ুয়া ছেলে মিলে সেসব গাভীর পরিচর্যা করেন।
তিনি বলেন, "আমার ঘর ও এই খামার মিলিয়ে ৫ বছর আগে বিদ্যুৎ বিল আসতো ১৫০-২০০ টাকা। এখন এই বিল আসে ৭০০ টাকার বেশি। একই পরিমাণ গরুর ডাক্তার দেখিয়ে মেডিসিন নিলে আগে যেটা ৮০০-১০০০ টাকায় হতো এখন সেটার জন্য ২০০০-২২০০ টাকা খরচ হয়। খাবারের খরচ তো বাড়ছেই।"
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহ এমরান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কৃষকরা যে হারে কোম্পানির কাছে দুধ বিক্রি করেন তা সবসময় উৎপাদন খরচের চেয়ে কমই থাকে।"
বড় বড় কোম্পানি ছাড়াও স্থানীয় রেস্তোরাঁ এবং মিষ্টি প্রস্তুতকারকরা দুধের নিয়মিত দুই গ্রাহক। যদি মিষ্টির জন্য দুধের চাহিদা কমে যায় তাহলে কৃষকদেরকে কম দাম দেওয়া হয়।
এ ধরনের তথ্য উল্লেখ করে শাহ এমরান বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে দুধ ও ডেইরি উৎপাদন ক্রমান্বয়ে না বাড়ানো পর্যন্ত ন্যায্য দাম পাওয়া যাবে না।
ছোট ডেইরিগুলো বিশৃঙ্খল অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও বড় প্রক্রিয়াকরণ সংস্থাগুলোর দাবি, তারা সর্বদা কৃষকদের ন্যায্যমূল্য দেয়।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ডিরেক্টর কামরুজ্জামান কামাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "খামারিদের জন্য আমরা দুধ সংগ্রহের হার বাড়িয়েছি কারণ তারা ফিডের দাম বাড়ার কারণে সমস্যায় পড়েছে।"
কৃষক এবং প্রসেসরের মধ্যে দামের ব্যবধান ব্যাখ্যা করার সময়, প্রাণিসম্পদ পরিষেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (উৎপাদন) মো. রিয়াজুল হক বলেন, "অনেক বড় বড় কৃষক দুধ এবং দুগ্ধজাত সামগ্রীতে কিছু অতিরিক্ত মান যোগ করে লাভ করতে পারে, কিন্তু ছোট এবং মাঝারি কৃষকরা তা করতে পারে না। তারা আগেও তা করতে পারেনি, এখনো পারে না।"
"খামারিদের লাভটা অন্য জায়গায়। দুধ বিক্রি করে তারা শুধু এক ধরনের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল পায়। গরু থেকে বাছুরই তাদের আয়ের প্রধান উৎস। এ কারণে দুধের ন্যায্য দাম না পেলেও তারা খামারের ব্যবসা থেকে দূরে সরে যায় না," যোগ করেন তিনি।