স্বাধীন দেশে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা প্রয়োজন যে কারণে
একটি স্বাধীন দেশে স্বাধীন বিচারব্যবস্থা কেন প্রয়োজন তা আবার প্রমাণ করল ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট। সর্বভারতীয় আঙ্গিকে যখন ক্ষমতাসীনরা হিন্দুবাদীত্ব ছড়িয়ে দিয়ে সংখ্যালঘু মুসলিমদের উপর নানা ধরনের নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে তেমন এক সময়ে, ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের দুজন বিচারপতি যে বলিষ্ঠ আদেশ প্রদান করলেন তা ভারতের সংবিধানের সার্বভৌমত্বই প্রমাণ করলো।
একজন মুসলিম সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন সর্বভারতীয় আঙ্গিকে। বিশেষ করে উত্তর প্রদেশে মুসলিমদের উপর যে ধরনের মানসিক নির্যাতন শুরু হয়েছে তার বিরুদ্ধে প্রতিকার চাওয়ার জন্য। সুপ্রিম কোর্টের যে দুজন বিচারকের বেঞ্চ এই মামলার শুনানি করলেন তারা ইতোপূর্বে ভারতের দুটি রাজ্যের হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। আদেশে তারা বলেন, যারা সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও সংঘাত সৃষ্টি করছে অনতিবিলম্বে তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে। যদি রাজ্যগুলো তা করতে ব্যর্থ হয় তবে রাজ্যের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হবে।
ভারতের উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগের প্রশ্নে সংবিধান অনুসারে প্রাথমিক মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো ভূমিকা থাকে না। প্রচলিত আইন অনুসারে সুপ্রিমকোর্টের তিন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি, (প্রধান বিচারপতি ও অন্য দুই জ্যেষ্ঠ বিচারপতি) নিয়ে কলেজিয়াম গঠিত হয়। এই কলেজিয়ামই উচ্চ আদালতের জন্য বিচারপতি মনোনয়নের জন্য প্রাথমিক তালিকা প্রস্তুত করেন। সরকারের পক্ষ থেকে সেই তালিকা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারক নিয়োগ দিয়ে থাকেন।
বর্তমান বিজেপি সরকারের আমলেই ভারতের সংবিধান সংশোধন করে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিনিধিত্ব সৃষ্টি করা হয়েছিল, কিন্তু সেই সংশোধনী বাস্তবায়িত হয়নি কারণ, সুপ্রিম কোর্ট সেই সংশোধনী গ্রহণ করেনি।
২০১৪ সালের ১৩ আগস্ট লোকসভায়, ২০১৪ সালের ১৪ আগস্ট রাজ্যসভায় এই জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিশন অ্যাক্ট গ্রহণ করা হয়। এরপরে পরবর্তী বছরে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি কর্তৃক স্বাক্ষর প্রদানের মাধ্যমে তা আইনে পরিণত হয়।
সংবিধানের ৯৯তম সংশোধনী মূলত প্রচলিত কলেজিয়েম সিস্টেম বাতিল করে নতুন জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিশন অ্যাক্ট পাস করা হয়। নতুন আইন অনুসারে ৬ সদস্যের কমিশন করা হয়। এখানে আগের কলেজিয়ামের তিন সদস্যের সাথে আইনমন্ত্রী ও অপর দুজন 'বিশিষ্ট' নাগরিককে কমিটিভুক্ত করার কথা বলা হয়। এই দুজন 'বিশেষ' নাগরিকের নাম প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদের বিরোধী দলের নেতা অথবা একক বৃহত্তম দলের প্রধান নির্ধারন করবেন। আবার এই দু'জন বিশিষ্ট নাগরিকের মধ্যে অন্তত একজন সিডিউল কাস্ট ওবিসি অথবা মাইনোরিটি অথবা নারীকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তারপরে বেশ কিছু রাজ্যে তা রেডিফাইড হয়ে যায় অর্থাৎ রাজ্য কর্তৃক গ্রহণ করা। রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করে আইনে পরিণত করা হলো ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে। ভারতের রাষ্ট্রপতি তখন প্রণব মুখার্জি।
সেই একই বছর সুপ্রিম কোর্টের ৫ বিচারপতির মধ্যে চারজন ৯৯তম সংশোধনীকে অসাংবিধানিক হিসেবে রায় প্রদান করেন। অপর একজন বিচারক ৯৯তম সংশোধনীর পক্ষে রায় প্রদান করেছিলেন। সেই সংশোধনীর বিষয়ে ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ঐকমত্য দেখা গিয়েছিল।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার জন্য সেই সংশোধনী বাতিল করে দেওয়ার পর বিজেপির সেই সময়ের আইনমন্ত্রী প্রয়াত অরুণ জেটলি বিচারপতিদের উদ্দেশে এক কঠোর মন্তব্য করেছিলেন। আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, 'এটা অনির্বাচিতদের কর্তৃত্ববাদিতা।' বিচারবিভাগ তথা ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট তার প্রতি কোন উত্তর দেয়নি। এমন কি ক্ষমতাসীনরা ৯৯ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে কোন রিভিউ চায়নি। এখানে আমাদের দেশের সাথে একটা স্পষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। আমাদের সংবিধানের ১৬ সংশোধনী বাতিলের পর সরকার পক্ষ রিভিউ চায় এবং প্রায় ৫ বছর পর তা শুনানীর জন্য গৃহীত হয়।
ভারতের সুপ্রিমকোর্টে একটি স্থায়ী বেঞ্চ আছে কনস্টিটিউশনাল বেঞ্চ নামে। যে বেঞ্চটি মূলত সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিষয়গুলোকে পর্যবেক্ষণ এবং রায় প্রদান করে থাকেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের কিংবা হাইকোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের চূড়ান্ত ক্ষমতা পার্লামেন্টের উপর ন্যস্ত করা আছে। কিন্তু কোন বিচারকের বিরুদ্ধে যদি কোন অসদাচরণের অভিযোগ আসে তাহলে প্রথমে সুপ্রিমকোর্ট কলেজিয়াম স্বাধীনভাবে তার তদন্ত করবে এবং তদন্তের পর যার বিরুদ্ধে অভিযোগ সেই বিচারপতির পার্লামেন্টের সদস্যদের কাছে তার পক্ষে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ আছে।
বিচারক নিয়োগ ও অপসারণের এই অনন্যসাধারণ আইন আছে বলেই ভারতে সরকারের আনুগত্যহীন একটি স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পেরেছে। যা বহুভাবে আমরা দেখেছি। নির্বাহী বিভাগের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এলাহাবাদ হাইকোর্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে সংসদ সদস্যপদ বাতিল করে রায় দিয়েছিল। একই আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল। ১৯৭৫ সালে জরুরী আইন জারি করে ইন্দিরা গান্ধী সেই সময় আত্মরক্ষা করেছিলেন, ফলে সংবিধানের নিয়ম অনুসারে দু'বছর পরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় ইন্দিরা গান্ধীর ব্যাপক পরাজয় ঘটেছিল। সেই প্রথম ভারতে ১৯৭৭ সালে অকংগ্রেসীয় সরকার গঠিত হয়েছিল। ধন্যবাদ, ভারতের বিচার ব্যবস্থার।
বিভিন্ন হাইকোর্ট ও সুপ্রিমকোর্টের রায় প্রমাণ করে, একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থার দিকেই হাঁটছে ভারত।
সম্প্রতি একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি আইনমন্ত্রীসহ জ্যেষ্ঠ অনেক মন্ত্রীর উপস্থিতিতেই বলেছেন, ভারত বর্তমানে একটি পুলিশী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হচ্ছে। বিচারিক আদালতে হস্তক্ষেপ হচ্ছে বেশি। এছাড়াও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ সিবিআই ইডি (এনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্ট) নিয়ে নানান অভিযোগ আছে। বিরোধী দল প্রায়শই এই দপ্তরগুলো 'কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ অনুসারে' কাজ করছেন, বলে অভিযোগ করে। তারপরেও ১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে নির্বাচিত সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছে।
একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ গণতন্ত্রের শক্তি অর্জনের অন্যতম সহায়ক শক্তি। ভারতের সংবিধান অনুসারে কোন আমলাকে সরাসরি চাকরি থেকে অবসরে পাঠানোর কোন বিধান নেই। উচ্চতর দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেই কেবলমাত্র ওএসডি করা হয়। ফলে আনুগত্য কেবলমাত্র মাপকাঠি নয়, ভারতের আমলাতন্ত্রে।
আমাদের দেশেও সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট হয়েছে কিন্তু সেই অ্যাক্টে এখনো অবসরে পাঠানো (ফোর্স রিটায়ারমেন্ট) এবং ওএসডি দুটি বিধানই চালু রাখা হয়েছে।
পরিশেষে গতকাল পাকিস্তানের বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতা ইমরান খান পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হয়েছেন। পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশনের সম্মিলিত মতের ভিত্তিতে এই আদেশ প্রদান করা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত মনে করা হলেও অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে সিদ্ধান্ত যথার্থ অর্থাৎ পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন যা আমরা কখনোই পর্যবেক্ষণ করি নাই।