তারা ৬ জন ‘অল দ্য প্রেসিডেন্টস মেন’!
এক দশকের কিছুটা বেশি সময় পেরিয়ে তৃতীয়বারের মতো চীনের প্রেসিডেন্ট হলেন শি জিনপিং। বেইজিংয়ের গ্রেট হল অব দ্য পিপলের মঞ্চে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) নেতাদের নিয়ে লাল গালিচায় আরও একবার হাঁটার সুযোগ হলো বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর এই নেতার। এরই মাধ্যমে আজ রোববার (২৩ অক্টোবর) আগামী পাঁচ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের তৃতীয় মেয়াদ শুরু করলেন তিনি।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসার মাধ্যমে মাও সেতুংয়ের পর চীনের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নেতা হয়ে উঠেছেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
সিপিসি'র সপ্তাহব্যাপী ২০তম জাতীয় কংগ্রেস সম্মেলনে শনিবার (২২ অক্টোবর) শি জিনপিংকে আবারও দলের মূল নেতা হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হয়। ফলে দেশটির প্রেসিডেন্টের আসনে আরও একবার বসার সুযোগ পেলেন তিনি। রোববার চীনা পলিটব্যুরোর সর্বোচ্চ স্থায়ী কমিটির নবনিযুক্ত সদস্যরা প্রেসিডেন্ট শি'র সঙ্গে নিজেদের পদমর্যাদার ক্রম অনুযায়ী গ্রেট হল অব দ্য পিপলের মঞ্চে উঠেছিলেন। শি সহ পলিটব্যুরোর এই সাত সদস্য আগামী পাঁচ বছর চীনের নেতৃত্ব দেবেন।
মঞ্চে ওঠার ক্রম অনুসারে চীনের পলিটব্যুরোর সাত সদস্য:
শি জিনপিং
নিজের তৃতীয় মেয়াদ নিশ্চিত করার মাধ্যমে ৬৯ বছর বয়সী শি জিনপিং এটিই প্রমাণ করলেন, তিনি দলের অন্য সদস্যদের মতো নন, বরং দলের মধ্যে তিনি নিজেই সর্বোচ্চ শক্তি। ক্ষমতায় থাকার জন্য অবসরের ডি ফ্যাক্টো বয়স ৬৮ বছর বাতিল করেছিলেন তিনি। ফলে ৬৯ বছর বয়সে এসেও প্রেসিডেন্টের আসনে বসলেন শি। মাও সেতুংয়ের পর চীনের সবচেয়ে শক্তিশালী নেতার উঠেছেন তিনি।
২০১২ সালে প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্টের পদে বসে চীনকে সুপার পাওয়ার হিসেবে গড়ে তোলার উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনা হাতে নেন শি জিনপিং। সেই অনুযায়ী এক দশক ধরে এগিয়ে চলেছে চীনের অর্থনীতি। চীনকে আবারও সুপার পাওয়ারদের দলে ভেড়াতে দলের রাজনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনসহ নানান পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি। ধারণা করা হয়, তার শক্ত নেতৃত্ব তাকে আগামী দিনগুলোর জন্য চীনের রাষ্ট্রক্ষমতায় চূড়ান্তভাবেই স্থায়ী করবে।
লি কিয়াং
গ্রেট হল অফ পিপল মঞ্চে সাংহাই কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান লি কিয়াং (৬৩) প্রেসিডেন্ট শি'র একেবারে পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। এর অর্থ সম্ভবত আগামী মার্চে লি খোছিয়াং অবসরে যাওয়ার পর তিনিই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবেন।
চীনের বিশৃঙ্খল কোভিড লকডাউন পরিস্থিতি সামলে ওঠার পর তার পদোন্নতির বিষয়টি অনেকটাই নিশ্চিত ছিল। প্রেসিডেন্ট শি'র অনুগত নেতাদের মধ্যে লি কিয়াং অন্যতম।
চলতি বছরের জুনে তিনি কোভিডের বিরুদ্ধে চীনের আর্থিক হাব সাংহাই রক্ষায় বিজয় ঘোষণা করেন। তার ঘোষণাকৃত দুই মাসের সম্পূর্ণ লকডাউনে কিছুটা বিক্ষিপ্ত অস্থিরতা সৃষ্টি হলেও তার সিদ্ধান্তকে 'সম্পূর্ণ ঠিক' বলেই ঘোষণা করা হয়।
ঝাও লেজি
চীনের দুর্নীতিবিরোধী নেতা হিসেবে পরিচিত ৬৫ বছর বয়সী ঝাও লেজি। গত পাঁচ বছরে প্রেসিডেন্ট শি'র রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের হটিয়ে দুর্নীতি দমনের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।
ঝাও প্রায় তিন দশক কাটিয়েছেন চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ কিংহাইতে। সেখানে দেশটির কয়েকটি বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠীর সংযোগ রয়েছে। কংগ্রেসে স্থায়ী কমিটিতে যোগদানের আগে তিনি কিংহাইয়ের অর্থনীতি দ্বিগুণ করতে কাজ করেছিলেন। তার সেই সফল্যের কারণে তাকে দেশের সর্বকনিষ্ঠ প্রাদেশিক নেতা হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
ওয়াং হুনিং
কয়েক দশকের ক্ষমতার লড়াইয়ে এবং চীনের অভিজাতদের মধ্যে পরিবর্তনের মাঝেও ওয়াং হুনিং (৬৭) নেতৃত্বদানকারী দলের ভিতরে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই থাকতে পেরেছেন। ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের ল স্কুলের সাবেক এই ডিন দলের সবচেয়ে প্রভাবশালী মতাদর্শীদের মধ্যে একজন। তিনি চীনের তিনজন রাষ্ট্রপতির জন্য স্লোগান তৈরি করেছেন। ১৯৯১ সালে তার বই 'আমেরিকা এগেইনস্ট আমেরিকা' বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। বইটিতে তিনি 'ব্যক্তিবাদ, হেডোনিজম এবং গণতন্ত্র' এর দ্বন্দ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতাগুলো সুক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছিলেন।
বর্তমানে তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় সেক্রেটারিয়েটের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
চাই কিউ
পলিটব্যুরো স্ট্যান্ডিং কমিটির নবাগত সদস্য চাই কিউ। একজন প্রতিভাবান রাজনীতিবিদ হিসেবে শির সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক রয়েছে তার। প্রেসিডেন্ট শি'র মতো চাইও উপকূলীয় প্রদেশ ফুজিয়ান এবং ঝেজিয়াং-এ কাজ করেছেন। দলীয় সচিবের শীর্ষপদে উন্নীত হওয়ার আগে ২০২৬ সালে মেয়র হিসেবে প্রথম বেইজিংয়ে আসেন তিনি।
প্রেসিডেন্ট শি'র জিরো-কোভিড নীতির মধ্যেও ২০২২ সালে শীতকালীন অলিম্পিক বেইজিংয়ে যথাসময়ে অনুষ্ঠিত করার জন্য আলোচনায় এসেছিলেন তিনি।
ডিং জুয়েজিয়াং
২০১৭ সাল থেকে জেনারেল অফিসের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ডিং জুয়েজিং (৬০)। তার এই পদটি দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমলাতান্ত্রিক পদগুলোর মধ্যে একটি। পদাধিকার বলে সমস্ত কর্মকর্তা ও যেকোনো তথ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে তার। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, প্রেসিডেন্ট শি'র খুবই আস্থাভাজন ব্যক্তি জুয়েজিং।
তিনি প্রায়শই সিপিসি'র সাধারণ সম্পাদক শি'র সঙ্গে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল বৈঠকে যোগদানকারী কয়েকজন কর্মকর্তাদের মধ্যে থাকেন। তাই তাকে 'শি'স অল্টার ইগো' এবং 'শি'স চিফ অফ স্টাফ' বা শি'র প্রধান সেনাপতি বলা হয়।
লি শি
পলিটব্যুরো স্ট্যান্ডিং কমিটিতে লি শি'র পদোন্নতি কারণ হলো, চীনের প্রযুক্তি কেন্দ্র শেনজেন এবং অর্থনৈতিক হাব হংকং-এর মধ্যে সমন্বয় সাধনে সাফল্য অর্জন। এর স্বীকৃতি হিসেবে তাকে স্থায়ী কমিটিতে জায়গা দেওয়া হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
৬৬ বছর বয়সী লি সেন্ট্রাল কমিশন ফর ডিসিপ্লিন ইন্সপেকশনের প্রধান হিসেবে ঝাও লেজির স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। লি-এর বাবা ছিলেন শেনজেনের একজন সফল রূপকার। ধারণা করা হয়, এই বিষয়টিতেও গুরুত্ব দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট শি।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ