২২ বছরে দ্বিতীয়বারের মতো ভয়াবহ রূপ নিলো ডেঙ্গু
বাংলাদেশ ডিরেক্টোরেট জেনারেল অব হেলথ সার্ভিসেস এর প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত এর আগের ২৪ ঘণ্টায় ৯২৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এতে করে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৯২৩ জনে।
এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও দুজন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। মৃতের সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে ১২০ জনে।
সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ডেঙ্গু সংক্রান্ত রেকর্ড রাখতে শুরু করার পর দেখা গেছে, ২০০০ সালের পর এ বছরই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা এত বেড়েছে। সে বছর ৫৫৫১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়, মারা যায় ৯৩ জন।
এরপর ২০১৯ সালে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। মারা যান ১৭৯ জন।
সাধারণত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই এডিস মশাবাহিত ভাইরাল রোগটির প্রাদুর্ভাব থাকে। কিন্তু এ বছর অক্টোবরে কেবল ২৬ দিনেই আক্রান্ত হয়েছে ১৭ হাজার ৮৩১ জন। প্রাণ হারিয়েছেন ৬৫ জন- যা ডেঙ্গুর বেলায় খুবই বিরল।
সেপ্টেম্বরে আক্রান্ত হয়েছেন ৯ হাজার ৯১১ জন, মারা গেছেন ৩৪ জন।
তবে, বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এর কারণে আগামী সাতদিনে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমতে পারে। ঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং ভারী বৃষ্টিপাতে অনেক এলাকায়ই এডিস মশার আবাসস্থল ভেসে গেছে।
মেডিকেল এনটমোলজিস্ট এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "পরিবর্তিত আবহাওয়ার মধ্যে ঘন ঘন বৃষ্টিপাতের কারণে ঘরবাড়ির চারপাশে পানি জমে এডিস মশার বংশবৃদ্ধি বেশি হয়েছে। এর ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপ দীর্ঘায়িত হয়েছে। এছাড়া, আমরা ডেঙ্গুর হটস্পট ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থ হয়েছি।"
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং-এর সময় অতিবৃষ্টি ও ঝড়ে অনেক মশা মারা যাওয়ায় পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে বলে জানান তিনি।
"যেহেতু এডিস মশা কামড়ানোর চার থেকে সাত দিন পরে মানুষের দেহে জ্বরটা আসে, তাই আমাদের ডেঙ্গু পরিস্থিতির উন্নতি দেখতে জন্য এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে," বলেন তিনি।
তবে ১৫ দিনের মধ্যে বন্যার পানি না নামলে আবারও মশার উপদ্রব বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে জানিয়ে তিনি সতর্ক করে বলেন, জমে থাকা পানি দ্রুত অপসারণ করতে হবে যাতে সেখানে মশা বংশবিস্তার করতে না পারে।
কবিরুল বাশারও মশা নিধন অভিযানের ধারাবাহিকতার ওপর জোর দেন।
এদিকে ইনস্টিটিউট অফ এপিডেমিওলজি ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চের মতে, ডেঙ্গুর একাধিক সেরোটাইপ-ডেন ১, ৩ এবং ৪-এর কারণে এবার ডেঙ্গুর তীব্রতা বেশি। চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা কোমোরবিডিটি (একসঙ্গে দুই বা ততোধিক রোগের উপস্থিতি) এবং ডেঙ্গু রোগীদের দেরিতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়াকে মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অনুসারে, এ বছর গুরুতর অসুস্থ হওয়া ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে প্রায় ৬৪ শতাংশ হাসপাতালে ভর্তির তিন দিনের মধ্যে মারা গেছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল ইউনিটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কোভিড মহামারিজনিত লকডাউনের কারণে গত দুই বছরে ডেঙ্গুর প্রকোপ কম ছিল। আবার সব খুলে দেওয়ায় এ বছর তা বেড়েছে।"
আগামী মাসের শুরুতে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমবে বলে তিনি আশাবাদী।
তিনি আরো জানান, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এডিস মশা নিধনে তাদের অভিযান অব্যাহত রেখেছে এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর রাজধানীর ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবাইকে নিজ নিজ বাড়ির আঙ্গিনা পরিষ্কার রাখার আহ্বান জানান ডা. নাজমুল। কারো জ্বর হলে তাকে অবশ্যই ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হবে বলে যোগ করেন তিনি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ডেঙ্গু একটি ভাইরাল রোগ যাতে আক্রান্ত রোগীদের তীব্র জ্বর এবং গুরুতর ফ্লু-এর মতো সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়া, প্রচণ্ড মাথাব্যথা, চোখের পিছনে ব্যথা, বমি বমি ভাব, বমি, ফুলে যাওয়া গ্রন্থি, পেশী এবং জয়েন্টে ব্যথা, ফুসকুড়ির মতো লক্ষণও দেখা দিতে পারে ডেঙ্গু আক্রান্তদের।
ডেঙ্গুর প্রধান বাহক এডিস মশা। এ মশা মানুষকে কামড়ানোর পর মানুষের দেহে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে মানুষই ভাইরাসটির প্রধান বাহক হয়ে ওঠে।