শব্দ দূষণ: কানের সমস্যায় ভুগছেন সড়কে কর্মরত পেশাজীবীরা
"সারাক্ষণ শব্দের মধ্যে কাজ করতে হয়, এখন দুই কান সব সময় ভারী হয়ে থাকে, কানে শুনতে সমস্যা হয়", রাজধানীর বাংলামোটর সিগনালে দায়িত্ব পালনকালে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে এ কথা বলেন ট্রাফিক পুলিশ কাজী বিপ্লব (৪৫)। ১২ বছর ধরে ট্রাফিক পুলিশ ডিপার্টমেন্টে কাজ করছেন তিনি।
শব্দের মধ্যে আট থেকে দশ ঘণ্টা ডিউটি করার কারণে এখন কেউ আস্তে কথা বললে শুনতে পান না বলে জানিয়েছেন আরেক ট্রাফিক পুলিশ ফজলুল কবির। তিন বছর ধরে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
পাঁচ বছর ধরে ঢাকার রাস্তায় রিকশা চালান জাহাঙ্গীর আলম। গত কয়েক মাস ধরে ডান কানে শুনতে সমস্যা হয় তার। জাহাঙ্গীর আলম বলেন, "জ্যামে মোটরসাইকেলগুলো মিনিটে কয়েকবার হর্ন বাজায়। হর্নের শব্দে মাথাব্যথা হয়, এখন এক কানে ঠিকমত শুনতে সমস্যা হচ্ছে।"
ঢাকা দক্ষিণ, ঢাকা উত্তর, রাজশাহী, কুমিল্লা এবং সিলেট- এ পাঁচ সিটি কর্পোরেশনের আওতায় সড়কে কর্মরত পেশাজীবীদের প্রায় ২৫.৩% শ্রবণ প্রতিবন্ধকতায় ভুগছেন। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুনে পরিচালিত এক সমীক্ষায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
পাঁচ সিটি কর্পোরেশনের সড়কে কর্মরত ৬৪৭ জনের উপর পরিচালিত এ গবেষণায় দেখা গেছে, সড়কগুলোতে শব্দের মাত্রা ৮৪ থেকে ৯৯ ডিবি পর্যন্ত, যা রাস্তার জন্য অনুমোদিত শব্দসীমার চেয়ে অনেক বেশি।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সের সমীক্ষায় দেখা গেছে, রিকশাচালকদের মধ্যে শ্রবণশক্তি হারানোর প্রবণতা সবচেয়ে বেশি (৪১.৯%)। এরপরেই রয়েছেন ট্রাফিক পুলিশ ও সার্জেন্ট (৩০.৭%) এবং সিএনজি ও লেগুনা চালকেরা (২৩.৯%)।
'অকুপেশনাল নয়েজ এন্ড নয়েজ ইনডিউজড হেয়ারিং লস ইন রোডওয়েজ অফ বাংলাদেশ' শীর্ষক সমীক্ষাটির উদ্দেশ্য ছিল দেশের বিভিন্ন এলাকায় শব্দের মাত্রা ও সড়কে কর্মরত পেশাজীবীদের শ্রবণশক্তির ওপর প্রতিক্রিয়া নিরূপণ করা।
এখানে অংশগ্রহণকারীদের গড় বয়স ৩৮.২ বছর (পুরুষ) এবং এদের সবার দিনপ্রতি গড় কাজের সময় ১০.৭ ঘণ্টা।
পাঁচ সিটি করপোরেশনের ট্রাফিক পুলিশ, সার্জেন্ট, বাসের চালক ও হেলপার, পিকআপ ভ্যানের চালক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, লেগুনা, সেডান ও এসইউভি, বাইকার ও রিকশাচালকসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের এক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে যাদের কানে কম শোনার সমস্যা রয়েছে তাদের মধ্যে ১৩% এর ডান কানে শ্রবণশক্তি মৃদু হ্রাস পেয়েছে কিন্তু সাথে সাথেই হেয়ারিং এইড বা শ্রবণযন্ত্রের প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু ৭% এর মাঝারি থেকে অধিক মাত্রায় শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে বাম কানের ক্ষেত্রে ১২.৭% এর শ্রবণশক্তি মৃদু হ্রাস পেয়েছে এবং ৮.৭% এর মধ্যম থেকে অধিক মাত্রায় শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে, যাদের দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন।
সিটি করপোরেশনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি (৫৫%) কানের সমস্যা পাওয়া গেছে কুমিল্লায়; এছাড়াও সিলেটে ৩০.৭%, ঢাকায় ২২.৩% ও ১৩.৯% মহাসড়কে কর্মরত পেশাজীবী কানের সমস্যায় ভোগে।
সিটি কর্পোরেশনগুলোতে পরিমাপ করা শব্দের মাত্রা ছিল ৮৪ থেকে ৯৯ ডিবি যা সড়কে শব্দের মাত্রার অনুমোদিত সীমার (৬০ ডিবি) চেয়ে অনেক বেশি।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেসের অকুপেশনাল এন্ড এনভায়রনমেন্টাল হেলথ ডিপার্টমেন্টের সহকারী অধ্যাপক ড. সায়কা নিজাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ট্রাফিক পুলিশ এবং রিকশাচালকদের মধ্যে কানের সমস্যার হার উদ্বেগজনক। যারা দীর্ঘ সময় রাস্তায় থাকে, তাদের সুস্থতার জন্য শব্দের এক্সপোজার কমাতে হবে।"
তিনি বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরকে উদ্যোগ নিতে হবে এবং মানুষকে সচেতন হতে হবে।
এই সহকারী অধ্যাপকের সুপারিশ হলো, "শব্দ দূষণ কমাতে আইন প্রণয়ন এবং কঠোরভাবে প্রয়োগ করা উচিৎ।"
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মোঃ মুনিবুর রহমান জানিয়েছেন, ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের শ্রবণ প্রতিবন্ধকতার জন্য তারা এখনও কোনো সাইকোলজিক্যাল প্রগ্রাম বা কর্মসূচি গ্রহণ করেননি।
"যেকোন ট্রাফিক পুলিশ সদস্য সেন্ট্রাল পুলিশ হাসপাতালে (সিপিএইচ) বিনামূল্যে কানের সমস্যার জন্য চিকিৎসা পেতে পারেন। প্রয়োজনে আমরা তাদের অন্যান্য হাসপাতালে রেফার করতে পারি এবং পুলিশই খরচের একটি অংশ বহন করবে," যোগ করেন তিনি।
তবে মাত্রাতিরিক্ত হর্নের ব্যাপারে সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে বলে এই পুলিশ কর্মকর্তা মনে করেন।
"এসব ক্ষেত্রে শাস্তি প্রবর্তন করলেও সেভাবে আশানুরূপ কোনো ফল পাওয়া যায় না। বরং অপ্রয়োজনীয় হর্ন ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করার প্রচেষ্টা কার্যকর হতে পারে।"
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ও ন্যাশনাল সেন্টার ফর হিয়ারিং অ্যান্ড স্পিচ ফর চিলড্রেন (এসএএইচআইসি) এর সমন্বয়ে পরিচালিত গবেষণাটির অর্থায়নে ছিল অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (এনসিডিসি), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।