সিভিল সার্ভিস আইনে একজনের দক্ষতা-যোগ্যতা পরিমাপের মানদণ্ড কি আনুগত্য?
দেশের রাজনৈতিক উত্তাপ বেড়েই চলেছে। নানাবিধ ঘটনা প্রবাহও এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘটে চলছে। তৃতীয়বারের মতন ক্ষমতায় থাকা সরকার, মেয়াদের শেষের দিকে এসে বেশ কিছু প্রশাসনের লোককে হঠাৎ করেই চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছে। কারণ, তাদের 'দেশপ্রেমের' ঘাটতি আছে (ভাগ্য ভালো, এখনও পর্যন্ত দেশপ্রেম মাপার কোন যন্ত্র আবিস্কৃত হয়নি। সেরকম যন্ত্র থাকলে মানুষজন ধরে এনে পরীক্ষা করা সহজ হতো)।
ব্রিটিশ ভারত যখন সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের অধীনস্থ হল, তার পরেই ১৮৬১ সালে প্রথম সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট নামে একটি আইন তৈরি করা হয়। যদিও তখনকার সিভিল সার্ভেন্টের নাম ছিল ইম্পেরিয়াল সিভিল সার্ভিস অর্থাৎ আইসিএস। তারই নানান পরিক্রমার ভেতর থেকে ১৯১৯ সালে প্রশাসনে কর্মরতদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার বিধান বিলুপ্ত করা হয়। এই আইন তৈরি হওয়ার আগে এমনিভাবেই বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হতো ব্রিটিশ অধীনস্থ সরকারের কর্মকর্তাদের।
১৯৪৭-এ ভারত বিভক্তির পর ভারত তার সংবিধানে কতগুলো অনুচ্ছেদ যুক্ত করে, যার দ্বারা সরকারি কর্মচারীদের চাকরি নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে ভারতের সংবিধান অনুযায়ী কাউকে চাকরিতে ২৫ বছর পূর্তির পর চাকরিচ্যুত করা যাবে অর্থাৎ স্বাভাবিক অবসরে যাওয়ার আগেই তার চাকরির অবসান করা যাবে এমন কোন বিধান নেই। বরং সেখানে বলা আছে, কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত করে অভিযোগ প্রমাণ হলেই কেবলমাত্র চাকরি থেকে তাকে অপসারণ করা যাবে।
সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট পাকিস্তানে ছিল না। পাকিস্তান জন্মের পর সংবিধান গ্রহণ করতেই সক্ষম হয়নি। দেশটির প্রথম সংবিধান ১৯৫৬ সালে অল্প কিছু সময়ের জন্য রচিত হয়েছিল। সেখানেও এই ধরনের কোন অ্যাক্ট এর ব্যবস্থা করা হয়নি কিংবা সংবিধানে কোনো অনুচ্ছেদ সংযোজিত ছিল না। এরপর আইয়ুব খানের দ্বিতীয় সংবিধান, যেটা ১৯৬২ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল। সেখানেও এধরনের কোন অনুচ্ছেদ ছিল না।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে সংবিধান তৈরি করা হলো সেখানেও সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ভারতের অনুরূপ কোনো অনুচ্ছেদ সংযোজন করা হয়নি। আমাদের সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদে বিভিন্ন রুল বিধি না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সকল কার্যক্রম পরিচালিত হবে বলে উল্লেখ আছে। আবার সংবিধানের ১৩৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কাউকে অপসারণ করতে হলে কারণ দর্শাতে হবে। আবার একই অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির কাছে যদি প্রতীয়মান হয় যে, তাকে কারণ দর্শানো রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি তাহলে কারণ দর্শানোর প্রয়োজন নাই। সেক্ষেত্রে তাকে কারণ দর্শানো ছাড়াই অপসারণ করা যেতে পারে। ভারতের সংবিধানে এই ধরনের কাজের কোন সুযোগ নাই। ভারতীয় সংবিধানে ৩১১ অনুচ্ছেদ অনুসারে ২৫ বছর চাকরির মেয়াদে অপসারণ করা কিংবা চাকরি থেকে বরখাস্ত করা কোনটাই সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৩৫ উপ অনুচ্ছেদ (২) (ই) অনুযায়ী, "রাষ্ট্রপতির নিকট সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান অনুরূপ কোনো ব্যক্তিকে এই অনুচ্ছেদ (২) এর দফায় বর্ণিত কারণ দর্শানোর সুযোগদান করা যুক্তিসঙ্গতভাবে সম্ভব কি না এরূপ প্রশ্ন উত্থাপিত হলে, সেই সম্পর্কে তাকে বরখাস্ত, অপসারিত বা পদাবনমিত করবার ক্ষমতাসম্পন্ন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হইবে।"
২০১৮ সালে 'সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮' পাস হওয়ার পরও সরকারের কাছে এই বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রেখে দেওয়া হয়। একটি স্বাধীন দেশের আমলাতন্ত্রকে ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা অব্যাহত থাকলো। বিরোধী দলের যে কোন আন্দোলনের পরে পরেই সরকারের মধ্যে একধরনের বাড়তি চাঞ্চল্য দেখা যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। পুলিশের কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হলো। এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে সরকার তার আস্থাভাজন লোকদের দিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনা করতে চায়।
২০১২ সালের পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদকে সরকার দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে ঘোষণা করে। স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী ক্যাডার ও ননক্যাডার পদের মনোনয়নের দায়িত্ব পাবলিক সার্ভিস কমিশনের। আমাদের সংবিধানের ১৪০ অনুচ্ছেদ অনুসারে এই ধরনের মনোনয়নের দায়িত্ব পাবলিক সার্ভিস কমিশনের। কিন্তু পুলিশের এই সাব-ইন্সপেক্টর পদের নিয়োগ প্রক্রিয়ার সাথে পাবলিক সার্ভিস কমিশন যুক্ত নয়। এই পদের নিয়োগ আগের মতই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে। অভিযোগ রয়েছে, সরকার তার দলীয় লোকদের এই পদে আনার জন্যই নিয়োগ প্রক্রিয়া মন্ত্রণালয়ের কাছে রেখেছে।
ভারতের রাজ্য পুলিশ রাজ্য সরকারের অধীন, কিন্তু সেখানেও নিয়োগ কর্তৃপক্ষ হচ্ছে রাজ্যের পাবলিক সার্ভিস কমিশন। অর্থাৎ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনোনয়ন প্রদান করেন না ফলে পুলিশ রাজ্য সরকারের রাজনৈতিক দল দ্বারা পরিচালিত হয় না।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হওয়ার অল্পকাল আগে ২০১৮ সালে সিভিল সার্ভিস আইন কার্যকর করা হয়। এই সিভিল সার্ভিস আইন কার্যকর করার সময় নিশ্চয়ই ঊর্ধ্বতন আমলারা বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন। কারণ, এই আইনের গেজেট তাদের মাধ্যমে হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এখানেও সেই বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার বিধানটি চালু রাখা হলো। যেখানে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্য দুটি দেশের বিধি বিধান তারা পর্যালোচনা করে দেখেননি।
এই আইনের মধ্যে প্রমোশন নীতিমালায় 'দক্ষতা', 'যোগ্যতা' ইত্যাদি শব্দগুলো যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, বিপরীতে সেগুলো পরিমাপ করার কোন মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়নি। সুতরাং দক্ষতা বলতে কী বোঝাবে? কিভাবে তা পরিমাণ করা হবে তাও স্পষ্ট নয়। ফলে সবকিছুই হবে কর্তার ইচ্ছায়। চুড়ান্ত বিচারে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছাতেই সবকিছু পরিচালিত হবে। সুতরাং এই আইনেও প্রশাসনকে নিরপেক্ষ এবং রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধ হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করলো না।
প্রমোশন নীতিমালার অন্যতম শর্ত হওয়া উচিত 'শূন্যপদের বিপরীতে'। অর্থাৎ কতজন কোন পদের জন্য বিবেচিত হবেন তা নির্ধারিত হবে ঐ পদে কতগুলো পদ খালি আছে তার ভিত্তিতে। আমাদের পাশের দেশ ভারতেও এই নীতি অনুসরণ করা হয়। আমাদের এখানকার চিত্র ভিন্ন। পদ নেই অথচ ব্যাপক হারে প্রমোশন দেওয়া হয়েছে। যেহেতু পদ নেই সেকারণে প্রমোশনপ্রাপ্তরা সবাই আগের পদের দায়িত্বই পালন করছেন। কাজ আগের পদের কিন্তু এখন দায়িত্বপালন করছেন উচ্চপদধারী কেউ। এর ফলে একই কাজের জন্য রাষ্ট্রের খরচ বাড়লো বহুগুণ।
অনেকে বলে থাকেন, এটা সরকারের আমলা তোষণ নীতি। প্রফেশনাল ক্যাডারের চিত্রটাও একই রকম। শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা প্রকৌশল ক্যাডারে; প্রশাসন ক্যাডারের মত প্রমোশন তারা না পেলেও "সংযুক্তির" নামে এক পদে বহুজন যুক্ত থাকছেন। এই বাড়তি জনবলের যদি সত্যিই প্রয়োজন থেকে থাকে তা হলে 'পদ সৃজন' না করে সংযুক্ত'র নামে প্রশাসনিক শৃঙ্খলার ক্ষেত্র ভারসাম্যহীন করে তোলা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, প্রশাসনের কাঠামো হবে 'পিরামিড' আকৃতির। প্রশাসনের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত এক ধরনের সামঞ্জস্য থাকবে। কিন্তু এখন পদ না সত্ত্বেও ব্যাপক প্রমোশন, ওএসডি ও সংযুক্তর নামে কাঠামোটি 'পেট মোটা' আকৃতির কাঠামোতে পরিণত করা হয়েছে। সরকারের আগের মেয়াদে এক খামার বাড়িতেই এক হাজারের অধিক কর্মকর্তাকে সংযুক্তির নামে পদায়ন করা হয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে এরা সকলেই দলীয় বিবেচনায় ঢাকাতে নিয়োগ পেয়েছিলেন।
শিক্ষা ক্যাডারের ক্ষেত্রেও অবস্থা অনেকটা সেরকমই। ঢাকা শহরেই প্রায় তিন শতাধিক অধ্যাপক কর্মরত রয়েছেন যার অধিকংশেরই নিয়মিত পদ নেই। সংযুক্ত হয়ে আছেন। তবে দেশের বড় কলেজগুলোতে এখন মাস্টার্স খোলার কারণে অভিজ্ঞ শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে, কিন্ত পদ সৃষ্টি করা হয়নি। সেকারণে সংযুক্তির প্রয়োজনা রয়েছে বলে অনেকে মত দিয়ে থাকেন। তবে এটাও সত্য, সামরিক- বেসামরিক, ক্ষমতাসীন দল বা ব্যক্তির নিকট আত্মীয়কে কখনোই ঢাকার বাইরে চাকরি করতে হয়নি। তারা ঘুরে ফিরে ঢাকাতেই আছেন চাকরির শেষ দিন পর্যন্ত।
সরকারি আমলাদের পদোন্নতি ও পদায়ন ক্ষেত্রেও কোন নিয়মনীতি অনুসরণ করা হয় না। পদায়ন হচ্ছে কর্তার ইচ্ছায়! কর্তার কাছে প্রিয় হলে বা কর্তার কাছের মানুষ হলে সবচেয়ে ভালো পোস্টিংটা তার জন্য বরাদ্দ। প্রতিটি আমলাও কর্তার মন জুগিয়ে চলেন, কারণ তারাও ক্ষমতার কাছেই থাকতে চান। যেন তারাও চাকরির মেয়াদ পরবর্তী চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেতে পারেন।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের এই বিধান ১৯৭৪ সালে করা হয়েছিল রাষ্ট্রের প্রয়োজনে। তখন দেশে উপযুক্ত লোকের ঘাটতি ছিল। কিন্তু আজও সেই ব্যবস্থা অব্যাহত আছে। প্রায় সকল পদেই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এই ধরনের আনুগত্যের সুদুর প্রসারী প্রভাব মারাত্মক। খুব দ্রুতই এরা ক্ষমতার অপব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেন। সরকারি কেনা কাটা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় যেকোন কার্যক্রম বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে অবৈধ অর্থ উপার্জনে লিপ্ত হয়ে পড়েন। ফলে প্রশাসনে ঘুষ ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। আমলাতন্ত্র তার নিজস্ব স্বকীয়তা হারিয়ে কেবল উপরওয়ালার ইচ্ছার দাসে পরিণত হয় এবং জনগনের সেবক না হয়ে প্রভু হয়ে উঠে।