কেন বাংলাদেশে তারা? স্পেন, আমেরিকা, ভারত থেকে আসা হলি ফ্যামিলির ১১১ শিক্ষার্থী…
বিদেশি শিক্ষার্থীদের কাছে বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজগুলো বরাবরই আকর্ষণীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। সরকারি মেডিকেল কলেজে বিদেশি শিক্ষার্থীর কোটা খুব সীমিত হলেও দেশের বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা বাড়ছে নিয়মিত। সম্প্রতি বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলোতে মোট আসন সংখ্যার ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। উন্নত অনেক দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার তুলনায় বাংলাদেশের মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থায় বেশি আস্থা রাখছেন বিদেশি শিক্ষার্থীরা।
বাংলাদেশি মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য সাধারণত নিজ দেশের কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আবেদন করেন বিদেশি শিক্ষার্থীরা। উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে মেডিকেল কলেজগুলোতে তাদের ভর্তি যোগ্যতা যাচাই করা হয়। কলেজভেদে পড়াশোনার খরচ আর সুযোগ-সুবিধাও ভিন্ন হয়।
দেশের অন্যতম পুরোনো বেসরকারি হাসপাতাল হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে মেডিকেল শিক্ষা চালু হয় ২০০০ সালে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে আছে হলি ফ্যামিলি। ঢাকায় মেডিকেল শিক্ষার জন্য বিদেশি শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকাতেও অন্যতম এই মেডিকেল কলেজ।
প্রতিষ্ঠানটির একাডেমিক অফিসার ফকির সাইফুল ইসলাম জানান, বর্তমানে ১১১ জন বিদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজে। যাদের মধ্যে স্পেন থেকে এসেছেন একজন আর আমেরিকা থেকে এসেছেন একজন। তাদের দুজনেই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। বাকি ১০৯ জন শিক্ষার্থী এসেছেন ভারত থেকে। এবছরও হলি ফ্যামিলিতে ভর্তি হয়েছেন ৪৭ জন ভারতীয় শিক্ষার্থী। করোনা ভাইরাসের বৈশ্বিক অতিমারীর সময় বাদে প্রতিবছরই বেড়েছে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা। ভারতীয় শিক্ষার্থীদের কাছে এই মেডিকেল কলেজের গ্রহণযোগ্যতার কারণ ও বাংলাদেশে তাদের জীবনযাপন নিয়ে কথা হয় দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সাথে এক আলাপচারিতায়।
কম খরচে মানসম্মত শিক্ষা
হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী শাদাব শাফি শোরা এসেছেন ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর অঞ্চল থেকে। ভারতের বিশাল জনসংখ্যার তুলনায় মেডিকেল কলেজের অপ্রতুলতা আর বেসরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষার আকাশ ছোঁয়া ব্যয়ের কথা জানান তিনি।
শাদাব বলেন, "ভারতের কোনো প্রাইভেট মেডিকেলের ৫ বছর মেডিকেলে পড়ার খরচ মিনিমাম খরচ এক থেকে দেড় কোটি রুপি। সব মিলিয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুই-তিন কোটি রুপি খরচ পড়ে যায়। মাল্টি মিলিয়নিয়ার শিল্পপতি, মন্ত্রী বা বড় রাজনীতিবিদের মতো পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়া এত টাকা খরচ করে মেডিকেলে পড়াশোনা করার চিন্তা খুব কম মানুষই করে সেখানে। তারচেয়ে এই এমাউন্টের টাকা দিয়ে কোনো ব্যবসা শুরু করা বেশি লাভজনক। সে তুলনায় বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজে শিক্ষার খরচ খুবই কম।"
"হলি ফ্যামিলিতে বিদেশি শিক্ষার্থীদের পাঁচ বছরে শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যয় হয় সর্বোচ্চ ৪০-৫০ লাখ টাকা। এখানে জীবনযাপনের খরচও খুব বেশি না। পাশাপাশি মেডিকেল শিক্ষার কারিকুলামও ভারতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই ভারতীয়দের পছন্দ তালিকার শীর্ষে থাকে বাংলাদেশের প্রাইভেট মেডিকেল কলেজগুলো।"
একই মত কাশ্মীর থেকে আসা শিক্ষার্থী আবরার হোসেন তারফারোশ, রওনাক আরশ, চেন্নাইয়ের মিনাজ খান এবং কলকাতার জাসমিন খানেরও। পাশাপাশি দুই দেশের একই ধরনের শিক্ষা কারিকুলামে খরচের বিশাল ব্যবধান তাদের শিক্ষাক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজকে বেছে নিতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
ভারতের নানা অঞ্চল থেকে বাংলাদেশের মেডিকেলে পড়তে আসাদের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন কাশ্মীরিরা। পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার এর কারণ হিসেবে জানান কাশ্মীরে কোনো বেসরকারি মেডিকেল কলেজ না থাকাটাই এর একটি বড় কারণ।
শাদাবের মতে, গত ১০-১৫ বছর ধরে নানা কাজে কাশ্মীর থেকে বাংলাদেশে মানুষ আসছেন অনেক বেশি। ব্যবসা, মেডিকেল শিক্ষা, কাশ্মীরি হস্তশিল্পের কারণে এই যাতায়াত বেড়েছে। সে কারণেও বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি কাশ্মীরিদের আগ্রহ বাড়ছে ক্রমেই।
সাংস্কৃতিক নৈকট্য
পাশাপাশি দেশ হওয়ায় ভারত-বাংলাদেশের সংস্কৃতিগত মিলও অনেক। ভাষাগত পার্থক্য থাকলেও হিন্দির সাথে বাংলার সামঞ্জস্যতা আছে বেশ। তাই নতুন ভাষা বোঝার ক্ষেত্রেও খুব বেশি বেগ পেতে হয় না ভারতীয় শিক্ষার্থীদের। বছরখানেকের মধ্যে চলনসই বাংলা বলতেও শিখে যান বলে জানান এই শিক্ষার্থীরা। মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থায় রোগীদের সাথে কথা বলে রোগের বিস্তারিত জানার বিকল্প নেই। স্থানীয় রোগীদের সাথে স্থানীয় ভাষাতেই কথা বলতে হয়। ভাষা শিক্ষার জটিলতার কারণে রাশিয়া, ইউক্রেনের মতো দেশের মেডিকেল কলেজের চেয়ে বাংলাদেশি মেডিকেল কলেজগুলোই বেশি পছন্দ ভারতীয়দের।
ধর্মীয় দিক দিয়ে মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ হওয়ায় ভারতীয় মুসলিম অভিভাবকেরা বাংলাদেশে তাদের ছেলে-মেয়েকে পড়তে পাঠাতে ভরসা করেন বেশি। খাবারের ক্ষেত্রে বেশ কিছু পার্থ্যক্য থাকলেও দুই দেশের প্রধান খাবারগুলোয় মিল আছে। যে কারণে সহজেই মানিয়ে নিতে পারেন শিক্ষার্থীরা।
নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর অভিজ্ঞতা
নৈকট্য যতই হোক, নতুন দেশে এসে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে সাধারণভাবেই নানা প্রতিকূল অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে বিদেশি এই শিক্ষার্থীদের। যার মধ্যে দুই দেশের আবহাওয়াগত পার্থক্যের সাথে মানিয়ে নেওয়া ছিল অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
কাশ্মীরের শিক্ষার্থী আবরার হোসেন তারফারোশ বলেন, "কাশ্মীরে আবহাওয়া বাংলাদেশের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন ছিল। শীতকালে প্রচণ্ড শীত আর গ্রীষ্মকালেও বাতাসের আর্দ্রতা কম থাকায় গরম ছিল খুবই কম। সেখানে এসি ব্যবহার করার কোনো দরকার পড়তো না। কিন্তু বাংলাদেশে সারাবছরই কাশ্মীরের তুলনায় বেশ গরম আবহাওয়া থাকে। এখানে বছরের ৩৬৫ দিন, ২৪ ঘণ্টাই এসির উপর নির্ভরশীল থাকতে হয় আমাদের। দুই দেশের তাপমাত্রার সাথে এডজাস্ট করা আমাদের জন্য বেশ কঠিন ছিল।"
বাংলাদেশে তীব্র গরমের সাথে মানিয়ে নিতে গিয়ে কাশ্মীরের রওনাক আরশকে নিয়মিতই সমঝোতা করতে হয় প্রচন্ড মাইগ্রেনের ব্যথার সাথে। এদেশের আবহাওয়া আর দূষণের কারণে প্রায়ই অসুস্থও হয়ে যান তিনি।
অন্যদিকে চেন্নাইয়ের মিনাজ খানের কাছে বাংলাদেশের আবহাওয়া বেশিই শীতল। তিনি বলেন, "চেন্নাইয়ে কখনো এত শীত পড়ে না, বাংলাদেশে শীতকালে যেরকম হয়। প্রথমবার এদেশে এসেই তীব্র শীতে অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম আমি। এদেশে থাকছি প্রায় তিন বছর হয়ে যাচ্ছে। তবুও প্রতি মাসেই আমি ঠান্ডাজনিত সমস্যায় অসুস্থ হয়ে যাই। সর্দি-কাশি লেগেই থাকে।"
খাবার-দাবারের ক্ষেত্রেও শুরুতে বেশ সমস্যা পোহাতে হয়েছে ভারতীয় এই শিক্ষার্থীদের। আবরার বলেন, "কাশ্মীরে আমরা লবণ চা খেতাম, যেটা বাংলাদেশে কখনো পাওয়া যায় না। আবার কাশ্মীরে চায়ে সবসময় গরুর দুধ ব্যবহার করা হয়, বাংলাদেশের টঙ দোকানে বেশিরভাগ কনডেন্স মিল্কের চা। কাশ্মীরিরা বেশি মশলাদার খাবার পছন্দ করে, কিন্তু এই দেশে মশলার ব্যবহার তুলনামূলক কম। মুরগি বা গরুর মাংসের তুলনায় কাশ্মীরে খাসির মাংস বেশি খাওয়া হয়। খাবারের এই অভ্যাসগুলো অনেকটাই বদলে ফেলতে হয়েছে আমাদের।"
চেন্নাইয়ের মিনাজ খানকেও তার দক্ষিণ ভারতীয় খাদ্যাভাসের ইডলি-দোসার বদলে ভাত-পরোটায় অভ্যস্ত হতে হয়েছে। কলকাতা থেকে আসা জাসমিন খানকেও নিয়মিত আটার রুটির বদলে ময়দার রুটি খাওয়ার অভ্যাস করতে হয়েছে। তবে কলকাতার সাথে ঢাকার ভাষা আর আবহাওয়ায় মিল থাকায় অন্যদের চেয়ে সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছেন জাসমিন।
প্রথমবার বাংলাদেশে আসার পর রওনাকের এক সপ্তাহ কোনো ধারণাই ছিল না আশেপাশে সবাই কী কথা বলছে। ধীরে ধীরে বাংলাদেশি বন্ধু আর সিনিয়রদের সহযোগীতায় বাংলা ভাষা বুঝতে শিখেছেন তিনি। এক্ষেত্রে তার শিক্ষকেরাও খুব সহযোগী বলে জানান রওনাক।
দেশে চলমান ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াবহতাও বিচলিত করছে বিদেশি শিক্ষার্থীদের। অনেকেই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন বলে জানান তারা।
প্রিয় খাবার কাচ্চি, পছন্দের তালিকায় আছে মাওয়া ঘাটের ইলিশও
পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে খাপ খাওয়ানোর পাশাপাশি অল্প সময়েই বাংলাদেশকে আপন করে নিয়েছেন এই ভিনদেশি শিক্ষার্থীরা। খাবার-দাবারের সাথে অভ্যস্ত হওয়ার পর তাদের প্রায় সবারই সাধারণ প্রিয় খাবার হিসেবে মনে জায়গা করে নিয়েছে এ দেশের কাচ্চি বিরিয়ানি। এছাড়া দেশীয় খাবার মাছ-ভাতেও অভ্যস্ত হচ্ছেন এই শিক্ষার্থীরা।
মেডিকেলে পড়াশোনার চাপে ফুরসত খুব একটা মেলে না তাদের। সারাদিনের ক্লাস-পরীক্ষার ব্যস্ততার মাঝেই আড্ডা জমান এলাকার চায়ের টঙে। সপ্তাহান্তে ছুটির দিনে গুলশান, বনানী বা ধানমন্ডির রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয় প্রিয় খাবারের খোঁজে। ঢাকার আশেপাশের দর্শনীয় নানা স্থানেও যান সময় পেলে। পদ্মার তাজা ইলিশের স্বাদ নিতে মাওয়া ঘাট তাদের পছন্দের জায়গা বলে জানান মিনাজ খান।
বাংলাদেশি বন্ধুদের সাথে ট্যুরে বা কলেজ থেকে শিক্ষাসফরে সিলেট, কক্সবাজারের মতো জায়গায় বেড়াতে যান এই বিদেশি শিক্ষার্থীরা।
রয়েছে নানান সংকট
চিকিৎসা শাস্ত্রে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট হলেও নানান গুরুতর সমস্যায় প্রায়ই জর্জরিত হতে হয় এদেশে পড়তে আসা বিদেশি শিক্ষার্থীদের।
এ প্রসঙ্গে আবরার বলেন, "বাংলাদেশে পড়তে আসা বিদেশি শিক্ষার্থীদের পাঁচ বছর মেয়াদী ভিসা দেয় না এদেশের সরকার। প্রতিবছর নতুন করে ভিসার মেয়াদ বাড়াতে হয়। যা আমাদের জন্য বেশ সমস্যাজনক। করোনায় আমরা সবাই যখন ভারতে আটকে ছিলাম তখন সবার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। ক্লাস শুরু হয়ে গেলেও ভিসা সংক্রান্ত জটিলতায় আমাদের এই দেশে আসতে সমস্যা হয়েছিল। বাংলাদেশ থেকে সরাসরি কাশ্মীর যাতায়াত করার কোনো ফ্লাইটের ব্যবস্থা নেই।"
"আমাদের প্রত্যেকবার কলকাতা বা দিল্লী হয়ে যাতায়াত করতে হয়। যা বেশ সময় সাপেক্ষ ও ঝামেলার। ফ্লাইটের টিকেটও অনেক ব্যয়বহুল। টিকেটের নির্দিষ্ট কোনো দাম নির্ধারিত নেই। নানান সময়ে নানান দামে টিকেট কিনতে হয় আমাদের।"
নিয়মিত এই সমস্যাগুলোর প্রতিকার হলে আরো অনেক বিদেশি শিক্ষার্থী বাংলাদেশি মেডিকেল কলেজে পড়তে আগ্রহী হত বলে মত হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজের এই ভারতীয় শিক্ষার্থীদের।