মহামন্দা ও মন্দায় বিশ্ব ফুটবল
ম্যারাডোনার মৃত্যু ঘটেছে অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের করোনাকালে। মাঠ ছাড়লেও ম্যারাডোনা বিশ্বকাপ ছাড়েননি। তার নামেই উজ্জীবিত হতো পৃথিবীর অর্ধেক ফুটবলপ্রেমিক। তার মৃত্যু ল্যাটিন আমেরিকার অর্থনীতিতে অল্প হলেও ধাক্কা দিয়েছে। বিভিন্ন কারণে এই ধাক্কাটা বড় হলে এবং রেশটা দীর্ঘমেয়াদি হলেই শুরু হয় মন্দা।
বিশ্ব মহামন্দার শুরুটা ১৯২৯ সালে। আর এর সূচনা ঘটে ওয়াল স্ট্রিটে শেয়ার বাজারের বিভীষিকাময় পতনের মধ্য দিয়ে। ১৯৩২ থেকে ১৯৩৩ পর্যন্ত মহামন্দা ছিল শিখরে। ১৯৩২-এর সবচেয়ে হিট গান বিঙ্গ ক্রসবির 'ব্রাদার ক্যান ইউ স্পেয়ার অ্য ডাইম'-এর বাংলা হতে পারে 'একটি পয়সা দে রে ভাই'। ভয়ংকর কষ্টে ছিল মানুষ। ১৯২০-এর দশকে আমেরিকার ১ ভাগ মানুষের হাতে ছিল সারা দেশের ৩৩ ভাগ সম্পদ। শুরুতেই আমেরিকান
পরিবারের আয় ৪০ ভাগ কমে যায়। মহামন্দা-পূর্ববর্তী স্টক মার্কেটে ফিরে আসতে আমেরিকাকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
আমেরিকান ব্যাংকগুলোর এক-তৃতীয়াংশ দেউলিয়া হয়ে যায়। অর্থনীতির আকার ৫০ ভাগ সংকুচিত হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ খাদ্য ও কাজের সন্ধানে এক অঙ্গরাজ্য থেকে অন্য অঙ্গরাজ্যে ছুটে বেড়ায়। খরা দেখা দেয়।
১৯৩৩ নাগাদ বেকারত্ব ২৫ শতাংশে পৌঁছে। অভাব ও অনটন সকল খাতকে মারাত্মকভাবে পঙ্গু করে দেয়। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য অর্থনীতিবিদ জন ম্যানিয়ার্ড কিনস সরকারি খাতে খরচ বৃদ্ধির পরামর্শ দেন। তা অনুসরণ করা হয়। তাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায় এবং প্রান্তবর্তী মানুষের শ্রমের চাহিদা বাড়ে। তারা কমবেশি টাকা পেতে শুরু করেন। অর্থনীতির স্থবির চাকাটা আবার ঘুরতে থাকে।
এমনই অবস্থায় ফুটবল বিশেষ করে বিশ্বকাপ ফুটবলের কী হাল, তা অবশ্যই ফুটবল-অর্থনীতিতে যারা উৎসাহী, তাদের আগ্রহী করে তুলবে।
মহামন্দা যখন পৃথিবীকে আঘাত করে এবং ফুটবল উদ্যমী দেশগুলোর বাজেট নিয়ে যখন টানাটানি, এমনি সময়ে বিশে^র প্রথম ফুটবল ওয়ার্ল্ড কাপ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হলো উরুগুয়ের রাজধানী মন্টেভিডিওতে।
মহামন্দায় ফুটবল
বিশ্বকাপ ফুটবল অনুষ্ঠানের স্বত্ব ১৯০৪ সাল থেকে ফিফা দাবি করে আসছিল এবং ফুটবলের আর কোনো বিশ্ব সংস্থা না থাকায় এটা যে ফিফারই প্রাপ্য, এ নিয়েও তেমন দ্বিমত ছিল না। তবুও এমন একটি মেগা টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে লেগে গেল ২৬ বছর।
১৯৩০ বিশ্বকাপের ওপর মহামন্দার কালো ছায়া, বিভিন্ন দেশের সরকারের অনাগ্রহ এবং প্রথম বিশ্বকাপ ভেন্যু দক্ষিণ আমেরিকার উরুগুয়ে পর্যন্ত দূরত্ব ও দীর্ঘ ভ্রমণ সময় বাধা হয়ে দাঁড়াল। সেই প্রথম বিশ্বকাপে কোনো কোয়ালিফায়িং রাউন্ড ছিল না। আমন্ত্রণ পেলে এবং আসতে চাইলে গ্রহণ করা হবে—এই ছিল তখনকার পরিস্থিতি। সাড়া দেওয়া ১৩ দলের ৭টিই দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকার দেশ।
টুর্নামেন্ট শুরুর মাত্র দুই মাস আগে বেলজিয়াম, ফ্রান্স, রোমানিয়া এবং যুগোস্লাভিয়াকে খেলায় অংশ গ্রহণ করতে রাজি করানো হয়েছে। আক্ষরিক অর্থে মন্টেভিডিওতে আসার জন্য তাদের দড়িতে বাধা হয়েছে—চারটি দলই সমুদ্রপথে একই জাহাজে চড়ে মন্টেভিডিও এসে উপস্থিত হয়েছে। তবে আটলান্টিক মহাসাগর পেরোতে সময় বেশি লাগায় চারটি দলই বিশ্বকাপের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণকাল থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
মহামন্দায় নিষ্কৃতি পেতে খরচ কমাও, খরচ বাড়াও
খেলা শুরু হয়ে গেল। পরপর দুবারের অলিম্পিক ফুটবল স্বর্ণপদক বিজয়ী, অধিকন্তু বিশ্বকাপের হোস্ট কান্ট্রি উরুগুয়ে ১৯৩০-এ বিশ্বকাপের ১ নম্বর দাবিদার বলেই সবার ধারণা। সেই ধারণা সত্য প্রমাণিত হলো। আগাগোড়া অপরাজিত রয়ে গেল উরুগুয়ে। উত্তপ্ত ম্যাচ ফাইনালে। উরুগুয়ের বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনা। নৌকায় পাড়ি দিয়ে হাজার হাজার আর্জেন্টাইন নাগরিক উরুগুয়ের রাজধানীতে এসে পৌঁছেছে। হাফ টাইমে উরুগুয়ে ২-১ গোলে এগিয়ে। দ্বিতীয়ার্ধের শেষ বাঁশি যখন বাজল, আর্জেন্টিনা ২-৪ গোলে উরুগুয়ের কাছে পরাজিত। ১৯৩০-এ
ফিফার সবচেয়ে বড় সাফল্য অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার মধ্যেও ১৩টি দেশকে প্রতিযোগিতায় টেনে আনা। দেশগুলো হচ্ছে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে, চিলি, পেরু, যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, ফ্রান্স, বেলজিয়াম রোমানিয়া ও যুগোস্লাভিয়া।
খেলার মাঠে ও বাইরে আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ের সমর্থকদের মধ্যে মারপিট হয়েছে। উরুগুয়েতে আসা আর্জেন্টিনার ফুটবল প্রেমিকেরা হুমকির মুখোমুখি হলো। কেউ কেউ বাস্তবিকই লাঞ্ছিত হয়েছে আর তার খেসারত দিতে হয়েছে আর্জেন্টিনায় অবস্থিত উরুগুয়ে দূতাবাসকে।
দূতাবাস আক্রান্ত হলে তছনছ করে দেওয়া হয় সমস্ত কিছু। ফলে দুই দেশের সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটে।
প্রথম অলিম্পিক ফুটবল অনুষ্ঠিত হয় ১৯০০ সালে প্যারিসে, অংশগ্রহণ করে ৩টি দল। পূর্ব লন্ডনের আপটন পার্ক দল প্রতিনিধিত্ব করে ব্রিটেনকে, ক্লাব ফ্রাসাইস ফ্রান্সকে এবং ব্রাসেলস বিশ্ববিদ্যালয় বেলজিয়ামকে। ইংল্যান্ড-ফ্রান্স খেলায় দর্শক ছিল ৫০০ আর ফ্রান্স- বেলজিয়াম খেলায় ১৫০০; প্রদর্শনী ঘোষিত প্রথম অলিম্পিক আপটন পার্ক স্বর্ণপদক পায়, রৌপ্যপদক ফ্রান্স। ১৯০৮-এর লন্ডন অলিম্পিকে ৬টি দল ফুটবলে অংশগ্রহণ করে ব্রিটেন চ্যাম্পিয়ন এবং ডেনমার্ক রানার্সআপ হয়। অপর ৪টি হচ্ছে ডেনমার্ক, ফ্রান্স, বোহিমিয়া ও সুইডেন। নিয়মিতই প্রথম মহাযুদ্ধকালে একবার এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে দুবার অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু অলিম্পিক আয়োজন করা হলেও ১৯৩২-এর লস অ্যাঞ্জেলেস মাঠে ফুটবলের আসর বসেনি; কোনটা পেশাগত ফুটবল আর কোনটা সৌখিন—এ নিয়ে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি এবং ফিফার মধ্যে বিরোধের কারণে ফুটবল বাদ পড়লেও পেছনের গুরুত্বপূর্ণ কারণটি ছিল মহামন্দা বা গ্রেট ডিপ্রেসন। অনেক দেশেরই বড় ফুটবল দল পাঠানোর আর্থিক সংগতি ছিল না। হোস্ট কান্ট্রি যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু ফুটবলভক্ত দেশ নয়, তাদেরও আগ্রহ ছিল না।
মন্টেভিডিওর পরের বিশ্বকাপটি ১৯৩৪-এর রোম বিশ্বকাপ। মহামন্দা তখনো চলছে। প্রথম বিশ্বকাপের সময় ব্রিটেনসহ ইউরোপের অনেক দেশ সাড়া না দিলেও মন্দার মধ্যেও প্রথম বিশ্বকাপের সাফল্য ইউরোপকে উৎসাহী করে তোলে। সে সময় ফিফার সদস্যদেশ ৫০টির মধ্যে ৩২টি দেশ অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করে। অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া কোয়ালিফায়িং রাউন্ড প্রবর্তন করতে হয়।
১৯৩০ মহামন্দার মতোই পড়েছে এবারের বিশ্বকাপ; ৯২ বছর পর ২০২২-এ পৃথিবীর আর্থিক আকার অনেক বেড়ে গেলেও একদিকে কোভিডের কারণে শ্লথ অর্থনীতি, অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকেন্দ্রিক আর্থিক দুরাবস্থায় পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই অর্থনীতি শ্লথ হয়ে গেছে, কয়েকটি দেশ দেউলিয়াও হয়েছে। এমন অবস্থায় ২০২২-এর কাতার বিশ্বকাপের সাড়া কেমন হবে, এ প্রশ্ন তো স্বাভাবিকই ছিল, কিন্তু ফুটবল বিশ্বকাপ চারবাক দর্শনধারীদের মতো আবার প্রমাণ করে দিল আর্থিক মন্দাবস্থার মধ্যে ঋণ করে হলেও ঘি খাবার মতো অংশগ্রহণ করতে হবে।
১৯৩০-এর প্রথম বিশ্বকাপে সবগুলো ম্যাচে মোট দর্শক টিকিট বিক্রির হিসেবে (কেউ কেউ একাধিকবার গোনায় এসেছে) ৫৯০৫৪৯, প্রতি ম্যাচে গড়ে ৩২৪১৪ জন। ২০২২-এর বিশ্বকাপ দেখতে বিভিন্ন দেশ থেকে কাতারে আসা দর্শকের সংখ্যাই ১২ লক্ষ। ১৯৩০-এ টেলিভিশন সম্প্রচার ছিল না; প্রথম বিশ্বকাপ ফুটবল সম্প্রচারিত হয় ১৯৫৪ সালে। এবার দর্শক হবে ৫ বিলিয়ন।
২০০৮ সাল থেকে বৈশ্বিক আর্থিক সংকট দীর্ঘস্থায়ী মন্দার সৃষ্টি করেছে। অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ মনে করেন, সেই রেশ এখনো কাটেনি। অর্থনীতির আকার যত বড়ই হোক পৃথিবী মন্দাবস্থার মধ্য দিয়েই যাচ্ছে। পরিস্থিতি সামলে নিতে কোনো কোনো দেশ সফল আর্থিক ও মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে। তারপরও বিশ্ব ফুটবলের অনেক বড় দল যথা সময়ে আর্থিক সংস্কারে হাত দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় ব্যয় বৃদ্ধি মন্দাবস্থাকে যেমন কাটায়, মুদ্রাস্ফীতির আকার তেমন বাড়ায়। ২০১৪-এর বিশ্বকাপ আয়োজনে ব্রাজিল যে বিপুল ব্যয় করেছে, অনেকে মনে করেন দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন এর একটি উল্লেখযোগ্য দেশের বাইরে পাচার করে আর্থিক সংকট সৃষ্টি করেছে।
মন্দা মূলত আর্থিক বিষয়। এর পেছনে বিশ্ব রাজনীতির টানাপোড়েন থাকতে পারে, না-ও পারে। তবে বিশ্বকাপ উপলক্ষে যে ব্যয়, তার ভালো-মন্দ দুই ধরনের প্রভাবই পড়তে পারে।
১৯৯০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত কয়েকটি বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনে হোস্ট দেশের ব্যয়ের একটি চিত্র তুলে ধরছি :
১৯৯০ ইতালি—৪ বিলিয়ন ডলার
১৯৯৫ যুক্তরাষ্ট্র—৫ বিলিয়ন ডলার
২০০৬ জার্মানি—৬ বিলিয়ন ডলার
২০১০ দক্ষিণ আফ্রিকা—৪ বিলিয়ন ডলার
২০১৪ ব্রাজিল—১৫ বিলিয়ন ডলার
২০১৮ রাশিয়া—১৪.২ বিলিয়ন ডলার
২০২২ কাতার—২২০ বিলিয়ন ডলার (প্রাক্কলিত)
কাতারের আর্থিক শক্তি এতটাই মজবুত যে এই ব্যয়িত অর্থ না উঠলেও অর্থনীতিতে তেমন প্রভাব ফেলতে পারবে না। কিন্তু অনেক সমালোচনার পরও এটি আর্থিকভাবে সফল একটি বিশ্বকাপ বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, এই মেগা ইভেন্টের বলি বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ফিলিপাইনসহ আরও কিছু দেশের গায়ে খাটা শ্রমিক।