মহামারির সময়ে বন্ধ হওয়া ১০৫টি ট্রেন চালু হয়নি এখনও
কিশোরগঞ্জের ভৈরব থেকে ময়মনসিংহ শহরে গিয়ে ফলের ব্যবসা করতেন জহির উদ্দিন। চলাচলের স্বাচ্ছন্দ্যে আগে এই পথে লোকাল ট্রেনে করে যাতায়াত করতেন তিনি। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালের মার্চ থেকে সারাদেশের রেল চলাচল বন্ধের সময় এই রুটের চারটি লোকাল ট্রেনও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর সবকিছু স্বাভাবিক হলেও লোকাল ট্রেনগুলো আর চালু হয়নি। ফলে তাকে প্রতিদিন অন্য বাহনে ভোগান্তি মাথায় নিয়ে যাতায়াত করতে হয়।
জহির দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ট্রেনে চলাচল করা সহজ। সময়ও কম লাগতো। এখন অনেক ভোগান্তি হয়। আমাদের গরিবের ট্রেনগুলো আর চালু হয়নি।"
সকাল সাড়ে ৬টা থেকে শুরু করে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত ময়মনসিংহ-ভৈরব রুটের লোকাল ট্রেনটি দিনে চারবার যাতায়াত করতো। এই ট্রেনে চড়ে বিভাগীয় শহর ময়মনসিংহে কর্মজীবী, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যাতায়াত করতেন। প্রতিবার এক হাজারের বেশি যাত্রী নিয়ে ট্রেনটি ১০টিরও বেশি স্টেশনে থামতো। দুই জেলার নিম্ন আয়ের মানুষের অন্যতম যাতায়াত মাধ্যম ছিল এটি। ট্রেনটি বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন হাজারো মানুষ।
ময়মনসিংহ থেকে পাশের জেলা জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলায় সকাল-বিকাল চলাচল করতো দুটি ট্রেন। এ দুটি ট্রেনের ওপর একইভাবে কর্মজীবী, বিভাগীয় শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ নিম্ন আয়ের মানুষ নির্ভরশীল ছিলেন। আর সিলেট থেকে সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলা রুটের চারটি ট্রেনের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। তারা হালকা মালামাল নিয়ে এই ট্রেনে যাতায়াত করতেন।
এই দুই রুটের ট্রেনের মতো ঈশ্বরদী-পার্বতীপুর-ঈশ্বরদী, রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহী, আখাউড়া-সিলেট-আখাউড়া, লাকসাম-চাঁদপুর-লাকসাম, লাকসাম-নোয়াখালী-লাকসাম, চট্টগ্রাম-নাজিরহাট, চট্টগ্রাম-দোহাজারী-চট্টগ্রাম, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের সহ সারা দেশের ১০৫টি লোকাল ট্রেন বন্ধ রেখেছে রেলওয়ে।
নিম্ন আয়ের মানুষের চলাচলের মাধ্যম এসব ট্রেন করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে গত আড়াই বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। ফলে বিপাকে পড়েছেন লাখ লাখ মানুষ।
ইঞ্জিন, কোচ, জনবলসহ নানা সংকটের অজুহাতে দরিদ্রদের যাতায়াতের মাধ্যম ট্রেনগুলো দিন দিন সংকুচিত করছে রেলওয়ে। অথচ যানজট নিরসন এবং সড়কের ওপর চাপ কমাতে বিকল্প হিসেবে রেল ও নৌপথের প্রতি জোর দিতে বলে আসছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত এক যুগে রেলওয়ের উন্নয়নে প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এরমধ্যে রেললাইন, সেতু, ভবন নির্মাণ এবং ইঞ্জিন-কোচ ক্রয়ে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকা। তবুও রেলখাতে বছরে দুই হাজার কোটি টাকা বেশি লোকসান দিতে হয় সরকারকে। রেলের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের পরও ফলাফল না আসার কারণ হিসেবে অপরিকল্পনাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেও জনগণ বঞ্চিত হলে দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে রেলওয়ে প্রায়োরিটি (অগ্রাধিকার) ঠিক করতে পারছে না। দূরপাল্লায় গুরুত্ব দিতে গিয়ে স্বল্প দূরত্বের ট্রেন বন্ধ রাখা দেশ বা রেলওয়ে কোন দর্শনের সঙ্গেই মিলে না। এখন পুরো পৃথিবীতে ট্রেনসেবা বেঁচে আছে কমিউটার সার্ভিস (ছোট ছোট দূরত্বে ট্রিপ) দিয়ে। সকাল-বিকাল এই সার্ভিসের চাহিদা থাকে। লাভজনক প্রতিষ্ঠান হতে হলে রেলকে কৌশলী হতে হবে। ভর্তুকি ছাড়া চলতে হলে কমিউটার সার্ভিসের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। দূরপাল্লার সার্ভিস তো মৌসুমের। মৌসুম ছাড়া দূরপাল্লার ট্রেন আমজনতার জন্য তেমন কাজে আসে না। স্বল্প দূরত্বে রেলের দীর্ঘদিনের ভূমিকার কারণে সংস্থাটি জনগণের খাঁটি সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে।"
বাংলাদেশ রেলওয়ের সকল ট্রেনের সময়সূচির বিবরণ সম্বলিত প্রকাশনা টাইমটেবিল বইয়ের তথ্যমতে, সারাদেশে বর্তমানে মোট ৩৬৮টি ট্রেন চলাচল করছে। অথচ বাস্তবে এ সংখ্যা ২৬৩টি। বাকি ১০৫টি ট্রেন বন্ধ রয়েছে। বন্ধ হওয়া এসব ট্রেনে চড়ে স্থানীয়রা আশেপাশের জেলায় যাতায়াত করতেন। আবার হালকা মালামালও বহন করতেন কেউ কেউ।
রেলওয়ের তথ্যমতে, পূর্বাঞ্চলের ২০০ ট্রেনের মধ্যে ৫৪টি বন্ধ। এরমধ্যে ৩৪টি লোকাল, ৬টি মেইল ও ১৬টি কমিউটার ট্রেন। আর পশ্চিমাঞ্চলের ১৬৮টি ট্রেনের মধ্যে ৫১টি বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। এরমধ্যে ৩৯টি লোকাল, ৪টি মেইল ও ৮টি কমিউটার ট্রেন রয়েছে। যাত্রীদের চাহিদা থাকার পরও নানা সংকটের অজুহাতে এসব ট্রেন বন্ধ রয়েছে। এসব ট্রেনের মধ্যে ৫০ বছর ধরে চলা পুরাতন ট্রেনও রয়েছে।
১৯৭২ সাল থেকে চালু হওয়া ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটের ঈশা খাঁ এক্সপ্রেস পাঁচটি জেলার অন্তত ৩৪টি স্টেশনে থামতো। বিস্তীর্ণ হাওর অঞ্চলের মানুষের কর্মজীবী মানুষেরা এই লোকাল ট্রেনে স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াত করতেন। এছাড়া নিত্যপণ্যও পরিবহন করা হতো এই ট্রেনে। আর চট্টগ্রাম-সিলেট রুটের জালালাবাদ এক্সপ্রেস ৭টি জেলার হাজারো মানুষের যাতায়াতের অন্যতম মাধ্যম ছিল।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন নির্মাণাধীন ভবনের জন্য দুই যুগ ধরে পাথর সরবরাহ করেন ব্যবসায়ী আমিরুল হক। তিনি বলেন, "জালালাবাদ এক্সপ্রেস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাপ বেড়েছে। আর দফায় দফায় জ্বালানী মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাসের ভাড়া বেড়েছে। তাই এখন সবাই ট্রেনে যেতে চায়। কিন্তু ট্রেন বাড়ানো হচ্ছে না।"
রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ইঞ্জিন, কোচ ও জনবল সংকটের কারণে লোকাল ট্রেনগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। করোনা মহামারির আগে এসব সংকটে জোড়াতালি দিয়ে ট্রেনগুলো পরিচালিত হতো। মহামারির পর সবকিছু স্বাভাবিক হলে আন্তঃনগর, এক্সপ্রেসসহ দূরপাল্লার ট্রেনগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে চালু করা হয়। অনেকগুলো পুরাতন লোকোমোটিভ ও কোচ বিকল হওয়ায় লোকাল ট্রেনগুলো চালুর দিকে নজর দেয়নি রেলওয়ে। অর্থাৎ সংকটে জোড়াতালি দিয়ে ট্রেন চালাতে চাচ্ছে না রেল কর্তৃপক্ষ।
রেলওয়ের তথ্যমতে, সবক'টি ট্রেন চালাতে প্রয়োজন তিন হাজারের বেশি কোচ এবং প্রায় ৫০০ ইঞ্জিন। কিন্তু রেলে বর্তমানে সচল ইঞ্জিন আছে ২৬৪টি এবং কোচের আছে দেড় হাজারের বেশি। আবার এসব ইঞ্জিনের মধ্যে ৬৭ শতাংশ এবং ৪৭ শতাংশ কোচের আয়ুষ্কাল শেষ হলেও চলছে। গত এক দশকে ইন্দোনেশিয়া থেকে কেনা ৩৫০টি কোচের একটির সঙ্গে অন্যটির জোড়া লাগানোর পদ্ধতি আলাদা হওয়ায় একটি বিকল হয়ে গেলে অন্যটি ব্যবহার করা যায় না। সংকটের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে কেনা ৩০টি ইঞ্জিনের সব রুটে চলাচলে উপযোগী নয়। এছাড়া ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে চীন থেকে আনা ২০ সেট ডেমুর বেশিরভাগ অকেজো হয়ে গেছে।
রেলের পূর্বাঞ্চলে মোট ৭৫৯টি কোচ এবং ১০০টি ইঞ্জিন সচল রয়েছে। এই অঞ্চলের সবকটি ট্রেন চালাতে প্রায় ৩০০টি ইঞ্জিন প্রয়োজন। পশ্চিমাঞ্চলের মোট ১১৭টি ইঞ্জিন রয়েছে। তবে চাহিদা রয়েছে প্রায় ২০০টি ইঞ্জিনের।
শুধু কোচ ও ইঞ্জিন নয়, সংকট রয়েছে জনবলের। এই কারণে সারাদেশের মোট ৪৮৪টি স্টেশনের মধ্যে ১১৫টি বন্ধ রয়েছে। রেলের মোট ৫৮৪১টি দাপ্তরিক পদের মধ্যে মাত্র ২৩৯৫টি পদে জনবল রয়েছে। বাকি ৩৪৪৯টি পদ শূন্য। মাঠ পর্যায়ের জনবলের মধ্যে ১৬৪০টি স্টেশন মাস্টার পদের বিপরীতে স্থায়ী ৫৯৪ জন এবং চুক্তিভিত্তিক ৭২ জন কর্মরত আছেন। বাকি ১০৪৬টি পদ শূন্য। একইভাবে ৫৩৪টি গার্ড পদের মধ্যে ২০১টি পদ শূন্য এবং পয়েন্টম্যানের ১৬৮৬টি পদের মধ্যে ৯০৮টি পদই শূন্য।
রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের চীফ অপারেটিং সুপারিনটেনডেন্ট (পশ্চিম) মোহাম্মদ আহসান উল্লাহ ভূঞা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "করোনা সংকটের শুরু থেকে এই আড়াই বছরে আমাদের নতুন কোন লোকবল নিয়োগ হয়নি। অথচ এই সময়ে লোকবল কমেছে। লোকোমোটিভ সংকট রয়েচে। এছাড়া কোচও মেরামতাধীন রয়েছে অনেক। এসব কারণে ট্রেনগুলো বন্ধ রয়েছে। এখন আমরা নতুন লোকবল পাচ্ছি। তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়োগ করা হলে সংকট দূর হবে।"
রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সংকটের কারণে লোকাল ট্রেনগুলো বন্ধ। জনবল সংকট প্রকট। স্টেশনমাস্টার, গার্ড, পয়েন্টম্যানের সংকট রয়েছে। নতুন লোকবল নিয়োগ হচ্ছিল না। আবার পুরনো লোকজন অবসরে যাচ্ছেন। আমরা এখন নতুন করে নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছি। জনবল সংকট কেটে যাবে আশা করি। প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আস্তে আস্তে বন্ধ হওয়া ট্রেনগুলো চালু করা হবে।"