১৯৮২ বিশ্বকাপের ব্রাজিল: এই দলই কি ব্রাজিলের সর্বকালের সেরা দল?
যখন সক্রেটিস মাঠে নামতেন, তখন জনগণের কাছে 'ডক্টর' হিসেবে পরিচিতি পাওয়া তার দিকে সবার চোখ ঘুরে যেত। সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিকেল ডিগ্রি নেওয়া মেধাবী সক্রেটিসের খেলা দেখতে ভিড় জমাতো হাজার হাজার লোক; তার টেকনিক্যাল দক্ষতা, আর সাথে তার প্রচণ্ড গতির শট দেখে বিমোহিত হতো দর্শকরা।
সক্রেটিসের সাথে 'ডাক্তার' নামটা লেগে থাকলেও তিনি কিছুটা ভিন্ন ছিলেন, ধূমপান আর মদ খেতে পছন্দ করতেন, কিন্তু কখনোই খেলার মাঠে এগুলোর ছাপ ফেলতে দেননি।
১৯৮২ বিশ্বকাপে ব্রাজিল দলের অধিনায়কও ছিলেন সক্রেটিস। টেলিভিশন আর স্ট্রিমিং স্বাভাবিক হওয়ার আগের যুগে তখন প্রত্যেক দলের ফুটবল ম্যাচ দেখার সুযোগ ছিল না, এমনকি যারা খেলছেন তাদের চেহারা দেখতে কেমন, সেগুলোও সাধারণ মানুষের জানা বেশ কঠিন ছিল। ফলে ১৯৮২-এর ব্রাজিল দল সম্পর্কে কিছু ধোঁয়াশা ছিল জনগণের মনে। সূত্র সিএনএন-এর।
১৯৮২ সালের স্পেন বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে মাঠে নামে সেলেসাওরা। প্রথমেই এক গোলে পিছিয়ে গেলেও মাঠে ব্রাজিলের শৈল্পিক ফুটবল আর নিয়ন্ত্রণে মুগ্ধ হয়ে যায় উপস্থিত দর্শকরা। অন্যদিকে পুরো দলের কেন্দ্রে ছিলেন সক্রেটিস, দলের মধ্যমণি সক্রেটিসকে ঘিরেই পুরো খেলা সাজিয়েছিল হলুদ জার্সিধারীরা। প্রতি মুহূর্তে ব্রাজিলের আগের কিংবদন্তি দলগুলোর খেলার ধরন মনে করিয়ে দিচ্ছিলো ১৯৮২ ব্রাজিল দলটি। সক্রেটিস এবং এডারের দুই গোলে ২-১ গোলে শেষমেশ ম্যাচটি জিতে নেয় তারা।
ব্রাজিলের অন্যতম প্রভাবশালী ফুটবল কমেন্টেটর জুকা ফুরি সিএনএন স্পোর্টে ১৯৮২ ব্রাজিল ফুটবল দল সম্পর্কে বলেছিলেন, "আমরা ঐ বিশ্বকাপ নিয়ে খুবই আশাবাদী ছিলাম। প্রথমত, আমাদের হাতে খুবই অসাধারণ কিছু খেলোয়াড় ছিল, তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ছিল, ছিল প্রখর মনোমুগ্ধকর দৃঢ় ব্যক্তিত্ব। যেমন, সক্রেটিস। একজন ডেমোক্র্যাট, জনগণের ভালোর জন্য, জনগণকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করার মতো একজন ব্যক্তি। ব্রাজিলের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার ছিলেন সক্রেটিস, যে কারণে পরের বিশ্বকাপে মাথায় হেডব্যান্ড পরে মাঠে নেমেছিলেন তিনি। ফ্যালকাও, 'দ্য কিং অফ রোম'-এর ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। ৪১ বছর পর রোমাকে লীগ শিরোপা এনে দিয়েছিলেন তিনি।"
বিশ্বকাপের ১৮ মাস আগে উরুগুয়েতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল 'ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন্স গোল্ড কাপ,' যেখানে ৬টি বিশ্বকাপজয়ী দল মুখোমুখি হয়েছিল একে অপরের, কেবল ইংল্যান্ডের বদলে নেদারল্যান্ডস এসেছিল। এই টুর্নামেন্টের নাম দেওয়া হয়েছিল 'লিটল ওয়ার্ল্ড কাপ' বা 'মুন্দালিতো'। ফাইনালে উরুগুয়ের কাছে হেরে গেলেও সেবারের বিশ্বকাপের ফেবারিট পশ্চিম জার্মানিকে গ্রুপপর্বে ৪-১ গোলে হারিয়ে দেয় ব্রাজিল। সেই ফর্মই বিশ্বকাপে ধরে রাখে ব্রাজিল। স্পেন বিশ্বকাপের বাকি দুই ম্যাচে স্কটল্যান্ড আর নিউ জিল্যান্ডোকে হারায় যথাক্রমে ৪-১ ও ৪-০ ব্যবধানে।
"আমি ব্রাজিলের কাছে ধরাশায়ী হলে কিছু মনে করবো না"
জার্মানিতে অনুষ্ঠিত হওয়া ১৯৭৪ বিশ্বকাপের ব্রাজিলের দল সম্পর্কে স্কটিশ কমেন্টেটর আর্চি ম্যাকফারসন মন্তব্য করেছিলেন, "১৯৬৬ সালের পর ব্রাজিলীয়রা প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিল,বিশেষ করে ইউরোপীয়রা প্রচণ্ড মেরেধরে খেলতো। পেলের পায়ের নিচে দাগ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়তো না। তাদের কাছে মনে হয়েছিল এরপর তারা যদি ইউরোপে খেলতে যায়, তবে তারা ইউরোপীয়দের মতো মেরেধরে খেলবে। এজন্য তারা গায়েগতরে শক্তিশালী এরকম খেলোয়াড়দের বাছাই করে, যাকে 'ইউরোপীয়করণ' বলে অ্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে। তারা কেবল টিকে থাকার জন্য তাদের সেই দুর্দান্ত শৈল্পিক ফুটবল ঝেড়ে ফেলে।"
"তো আমরা ভেবেছিলাম, ১৯৮২ বিশ্বকাপেও ব্রাজিল সে ধরনের কোনো দল পাঠাবে কি না। কিন্তু গ্রুপ পর্বের প্রথম তিন ম্যাচ দেখার পর আমাদের ভুল ভেঙে যায়। তারা সেই শৈল্পিক ছন্দময় ফুটবলে ফিরে এসেছে। দর্শকরাও ব্রাজিলের সমর্থন শুরু করে।"
ম্যাকফারসনের স্কটল্যান্ড অবশ্য দুর্দমনীয় ব্রাজিলের চমৎকার পারফরম্যান্সের শিকার হয়। যে শৈল্পিক ছন্দময় ফুটবল ব্রাজিল সেদিন খেলেছিল, তা দেখে প্রতিপক্ষরাও হাততালি দেওয়া শুরু করে, ম্যাকফারসনও ম্যাচশেষে অবাক হয়ে বসে ছিলেন। ম্যাচে প্রথমেই গোল খেয়ে পিছিয়ে গেলেও ব্রাজিল তাদের ছন্দবদ্ধ খেলা বাদ দেয়নি। অবশ্য ম্যাকফারসনের মতে, এই ছন্দ নিয়ে খেলার একগুঁয়ে মনোভাবই ব্রাজিলকে শেষপর্যন্ত ডুবিয়েছিল।
"আমরা ১৮ মিনিটের মাথায় গোল দিয়ে ব্রাজিলকে হয়তো কিছুটা অপমানই করেছিলাম। তারপর তারা আমাদের ওপর হামলে পড়লো। দলের কেন্দ্রে সক্রেটিস। গিটার বাজানো, সিগারেট খাওয়া সক্রেটিস, যে নিচে ডাক্তার হলেও ডাক্তারের প্রতিটি কথা অমান্য করার মতো জীবনধারা মেনে চলেন। ব্রাজিল দল তাদের পা আর গতির ওপর নির্ভর করে খেলা শুরু করলো। সক্রেটিস আসলেই সবকিছুর কেন্দ্রে ছিলেন, সম্ভবত তার বিশেষ স্টাইলের কারণেই। তার খেলার ধরনও ছিল এমন যে তাকে কেন্দ্র করেই পুরো দল ঘুরছে। এরপর ডেভিড নারে গোল দিলেন, ব্রাজিলের আক্রমণ শুরু হলো," ম্যাকফারসন যোগ করলেন।
"আমি ব্রাজিলের কাছে ধরাশায়ী হলেও কিছু মনে করবো না, কারণ ব্রাজিলের খেলা ছিল অপূর্ব। এটাকে পরাজয় বললে ভুল হবে, এটা ছিল ফুটবলের নিখুঁত প্রদর্শনের কাছে হার মানা। স্কিল আর তাদের খেলার গতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল, সাথে ছিল ফলাফল, ৪-১। তবে ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল, স্কটিশ সমর্থকরাও নিজেদের দলের পরাজয়ে হতাশ হয়নি, বরং ব্রাজিলের খেলা দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল।"
'ব্রাজিল হেরে গেল'
বিশ্বকাপের বর্তমান ফরম্যাটের আগে, প্রথম রাউন্ডের ছয়টি গ্রুপের সেরা দুটো দল নিয়ে আরও একবার তিনটি দলের চারটি গ্রুপ করা হতো, একে বলা হতো দ্বিতীয় গ্রুপ স্টেজ। এই দ্বিতীয় গ্রুপ স্টেজের চারটি গ্রুপের প্রথম দলগুলো যেত সেমিফাইনালে। ১৯৮২ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের সাথে দ্বিতীয় গ্রুপ স্টেজে একই গ্রুপে পড়ে পাওলো রসির ইতালি এবং গতবারের বিশ্বচ্যাপিয়ন আর্জেন্টিনা।
আর্জেন্টিনাকে প্রথম ম্যাচেই ২-১ গোলে হারিয়ে দেয় ইতালি। তারপর ব্রাজিলও জিকো, সার্জিনহো আর জুনিয়রের গোলে আলবিসেলেস্তেদের ধরাশায়ী করে ৩-১ গোলে, ডিয়েগো ম্যারাডোনা দেখে লাল কার্ড, সাথে ম্যাচের শেষদিকে র্যামন ডিয়াজ একটি সান্ত্বনাসূচক গোল করেন।
জুলাইয়ের ৫ তারিখে ব্রাজিল ও ইতালির ম্যাচ হয়ে ওঠে অঘোষিত কোয়ার্টার ফাইনাল, যে দল জিতবে সে দল জায়গা পাবে সেমিফাইনালে।
জুকা ফুরি জানান, "আমাকে বলতেই হবে ইতালি সেদিন ব্রাজিলের চেয়ে ভালো খেলেছিল এবং তদের জয় ছিল অবধারিত। এটা ফুটবলের স্বাভাবিক বিষয়। ব্রাজিল আর ইতালি যদি দশবার খেলে, তাহলে ব্রাজিল সাতবার জিতবে দুইবার ড্র করবে আর একবার হারবে। সেই একটি দিন ছিল ঐ জুলাইয়ের ৫ তারিখ। ওই দিনটি ছিল ইতালির দিন।"
"তবে ব্রাজিলের ঐ অসাধারণ দলের ছাপ বহুদিন জনগণের মনে লেগে ছিল। আন্দালুসিয়ার একটা সংবাদপত্রের একটি শিরোনাম আমার এখনো মনে আছে: 'কেউ এই পৃথিবীকে আর বুঝতে পারছে না, ব্রাজিল বাদ।'"
ইতালি দুইবার রসির গোলে এগিয়ে যায়, তবে ব্রাজিলও সক্রেটিস আর আর ফ্যালকাওয়ের গোলে সমতা আনে। তবে খেলার শেষ বাঁশি বাজার ১৫ মিনিট আগে যখন রসি তার হ্যাটট্রিক সম্পন্ন করেন, ব্রাজিল আর ম্যাচে ফিরতে পারেনি।
ম্যাকফারসন নিরপেক্ষ দর্শকদের কাছে এই ফলাফলকে 'এক বিশাল অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স' হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়েছিলেন: "আমি খুবই ভেঙে পড়েছিলাম। আমার কাছে মনে হয়েছিল যে আমার নিজের দেশের দল হেরে গিয়েছে। সারা বিশ্বের অনেক মানুষের মতো আমিও প্রচণ্ড হতাশ হয়েছিলাম। তবে আমি বলবো এটা তাদের নিজেদের দোষেই হয়েছে। তারা খেলার পরিস্থিতি বুঝে নিজেদের খেলার ধরনে কোনো পরিবর্তন আনেনি।"
ম্যাকফারসন আরও যোগ করেন: "কেউ ইতালীয়দেরকে পছন্দ করে না। ইতালীয় ফুটবল প্রচণ্ড মাত্রায় রক্ষণাত্মক। ইতালি আর ইতালীয় সাংবাদিক ছাড়া এমন কেউ ছিল না যারা ইতালির জয় চেয়েছিল। তারা বোঝাতে চেষ্টা করছিল, প্রমাণ করতে চেষ্টা করছিল যে ব্রাজিলের চেয়ে তাদের খেলার ধরন টিকে থাকবে এবং সফল হবে।"
অতুলনীয় ১৯৮২ ব্রাজিল দল
ব্রাজিল পাঁচবার বিশ্বকাপ জিতেছে, অন্য যেকোন দেশের চেয়ে সর্বোচ্চ। তারপরও ব্রাজিলের সেরা দল হিসেবে ১৯৮২-এর বিশ্বকাপ না জেতা দলকেই ধরা হয়। ফুরির মতে, "১৯৯৪ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিতেছে, ২০০২ সালেও ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিতেছে, কিন্তু তারা নিজেরাও নিজেদের সাথে ১৯৮২-এর দলকে তুলনা করে না।"
ইতালির সাথে হারা সত্ত্বেও সেবারের ব্রাজিল দল নিয়ে ব্রাজিলীয়রা আক্ষেপ করে না, বরং তারা যে এরকম কোনো একটা দল তাদের ইতিহাসে পেয়েছে তা নিয়েই তারা খুশি। আর কোনো দলই ব্রাজিলের জনগণের কাছে এতটা জনপ্রিয়তা পায়নি।
"২০২২ সালের দলে মাত্র একজন অসাধারণ খেলোয়াড় আছে, নেইমার। কিন্তু তার পক্ষেও সক্রেটিস, জিকো, ফ্যালকাও আর সেরেজো মিলে যা করেছে তা করে দেখানো সম্ভব না। চারজন অসাধারণ খেলোয়াড়, চারজন জিনিয়াস। তো আমার কাছে মনে হয় না এখানে কোনো তুলনা হতে পারে। এমনকি ১৯৯৪ আর ২০০২ সালের বিশ্বকাপজয়ী দলের সাথেও তুলনা করা যায় না। দুটো দল থেকেই ১৯৮২—এর দল ভালো। তারা ১৯৭৪-এর নেদারল্যান্ডস কিংবা ১৯৫৪-এর হাঙ্গেরির মতো কিছু জিতেনি, এগুলো ফুটবলে হয়ে থাকে।"