বিশ্বকাপের ইতিহাসে আলোচিত যত পেনাল্টি শ্যুটআউট
চলমান কাতার বিশ্বকাপে ঘটছে একের পর এক অঘটন। গ্রুপ পর্বের অঘটনে জার্মানি ও বেলজিয়ামের মত শক্তিশালী দলগুলো আসর থেকে বিদায়ের পর অনেক দর্শকই ভেবেছিলেন শেষ ষোলোর ম্যাচগুলোর ফলাফল সম্ভবত নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই পাওয়া যাবে। কিন্তু না, শেষ ষোলোর ম্যাচগুলোতেও ঘটেছে অঘটন। ম্যাচের নির্ধারিত সময়ের পর পেনাল্টি শুটআউটে খুব বাজেভাবে তীরে এসে তরী ডুবিয়েছে দারুণ ফর্মে থাকা দুই দল স্পেন ও জাপান।
শেষ ষোলোয় ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে জাপান প্রথম চারটির মধ্যে তিনটি পেনাল্টি শুটআউট মিস করে আসর থেকে বিদায় নিয়েছে। অন্যদিকে এক হাজার পেনাল্টি অনুশীলন করে আসা, টুর্নামেন্টের অন্যতম ফেভারিট দল স্পেন মরক্কোর বিপক্ষে প্রথম তিনটি পেনাল্টি শুটআউটের তিনটিই মিস করে আসর থেকে বিদায় নিয়েছে। তবে বিশ্বকাপ ইতিহাসে পেনাল্টি শুটআউটে হতাশাজনক পারফরম্যান্সের আরও বেশ কয়েকটি উদাহরণ আছে।
১৯৯০ ইতালি ফুটবল বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হয় আর্জেন্টিনা ও চেকোস্লোভাকিয়া। ঐ খেলার নির্ধারিত সময়ে দুই দলই গোল করতে ব্যর্থ হলে খেলা গড়ায় পেনাল্টি শুটআউটে। ধারণা করা হচ্ছিলো, ম্যারাডোনার নেতৃত্বে খুব সহজভাবেই পেনাল্টি শুটআউটে ম্যাচ জিতে যাবে আর্জেন্টিনা। কিন্তু না, চেকোস্লোভাকিয়ার বিপক্ষে এ ম্যাচে খুব বাজেভাবে পেনাল্টি মিস করেন ফুটবল কিংবদন্তি ম্যারাডোনা। শেষে আর্জেন্টাইন গোলকিপার সার্জিও টানা দুই সেভ করলে ৩-২ এ শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচটি জিতে যায় আর্জেন্টিনা। শেষে চেকোস্লোভাকিয়া দুইটি পেনাল্টি মিস না করতো আর্জেন্টিনা নয়, বরং সেমিতে পৌঁছে যেত চেকোস্লোভাকিয়া।
১৯৯৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত ফুটবল বিশ্বকাপের শেষ ষোলোর ম্যাচে মুখোমুখি হয় বুলগেরিয়া ও মেক্সিকো। নির্ধারিত সময়ে ম্যাচটি ১-১ গোলে ড্র হলে পেনাল্টি শুটআউটে রীতিমতো গোল মিসের মহড়া করে মেক্সিকো। বুলগেরিয়া প্রথম চারটি পেনাল্টির মাত্র একটি মিস করলেও মেক্সিকো ভক্তদের হতাশ করে প্রথম চারটি পেনাল্টির তিনটিই মিস করে বসে। যার ফলে ৩-১ ব্যবধানে ম্যাচটি জিতে নেয় বুলগেরিয়া।
২০০২ ফুটবল বিশ্বকাপে শেষ ষোলোর ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল ইউরোপের দুই দল স্পেন ও আয়ারল্যান্ড। এ ম্যাচটিতে দুই দল যেন পাল্লা দিয়ে পেনাল্টি মিস করেছিল। প্রথমে আয়ারল্যান্ড নির্ধারিত সময়ে একটি পেনাল্টি মিস করলেও ১-১ গোলের সমতায় খেলা গড়ায় পেনাল্টি শুটআউটে। আর এই পেনাল্টি শুটআউটে টানা তিনটি পেনাল্টি মিস করে আয়ারল্যান্ড। অন্যদিকে আয়ারল্যান্ডের থেকে একটি কম পেনাল্টি মিস করে ৩-২ এ ম্যাচটি জিতে নেয় স্পেন।
২০০৬ জার্মানি বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইউরোপের দুই দল পর্তুগাল ও ইংল্যান্ড পরস্পরের মুখোমুখি হয়। নির্ধারিত সময়ে দুই দলই গোল করতে ব্যর্থ হলে ম্যাচ গড়ায় পেনাল্টি শুটআউটে। একঝাঁক তারকা সমৃদ্ধ দল ইংল্যান্ড পেনাল্টিতে খুব ভালো ফলাফল করবে বলেই ভাবা হচ্ছিলো। কিন্তু ল্যাম্পার্ড ও জেরার্ডের মত তারকারা গোল করতে ব্যর্থ হওয়ার প্রথম চারটি পেনাল্টির তিনটিই মিস করে ইংল্যান্ড। অন্যদিকে তরুণ তারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর্তুগাল পাঁচটি পেনাল্টির দুইটি মিস করলেও ৩-১ এ ম্যাচটি জিতে নেয়।
২০০৬ জার্মানি বিশ্বকাপের শেষ ষোলোর ম্যাচে মুখোমুখি হয় ইউরোপের দুই দল ইউক্রেন ও সুইজারল্যান্ড। নির্ধারিত সময়ে ম্যাচটি যখন গোলশূন্য ড্র হয় তখন পেনাল্টি শুটআউটে এক লজ্জাজনক রেকর্ড করে ফেলেন সুইজারল্যান্ডের। প্রথম তিনটি পেনাল্টির তিনটিই মিস করে বিশ্বকাপের ইতিহাসে প্রথম দল হিসেবে পেনাল্টি শুটআউটে কোনো গোল না করার রেকর্ড গড়ে ম্যাচটি হেরে যায় সুইজারল্যান্ড। তবে সম্প্রতি কাতার বিশ্বকাপে টানা তিন পেনাল্টি মিস করে ম্যাচ হেরে সুইজারল্যান্ডের এ লজ্জাজনক রেকর্ডে নিজেদের ভাগ বসিয়েছে স্পেন।
২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপের শেষ ষোলোয় স্বাগতিক দল ব্রাজিল মুখোমুখি হয় চিলির। নির্ধারিত সময়ে খেলাটি ১-১ গোলে ড্র হলে ম্যাচ গড়ায় পেনাল্টি শুটআউটে। পেনাল্টিতে ব্রাজিলের নেইমার, লুইজ ও মার্সেলো গোল করতে পারলেও গোল করতে ব্যর্থ হন উইলিয়ান ও হাল্ক। অন্যদিকে চিলির পাঁচটি পেনাল্টির মধ্যে তিনটি পেনাল্টিই রুখে দেয় ব্রাজিলের গোলকিপার জুলিও সিজার। যার ফলে ম্যাচটি ৩-২ এ জিতে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করে স্বাগতিক ব্রাজিল।
২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে শেষ ষোলোর ম্যাচে ক্রোয়েশিয়া ও ডেনমার্ক পরস্পরের মুখোমুখি হয়। এ ম্যাচের নির্ধারিত সময় উভয় দল একটি করে গোল করায় ম্যাচটি গড়ায় পেনাল্টি শুটআউটে। ক্রোয়েশিয়া পাঁচটির শুটআউটের দুইটি মিস করে। অন্যদিকে ডেনমার্ক ক্রোয়েশিয়ার থেকে একটি বেশি পেনাল্টি মিস করে আসর থেকে ছিটকে যায়। ম্যাচটিতে ক্রোয়েশিয়ার পারফরম্যান্স খুব ভালো না হলেও পরবর্তীতে আসরে দলটির যাত্রা থামে রানার্স আপ হয়ে।
বিশ্বকাপ আসরে একটি দলের উপর এবং একটি খেলোয়াড়ের উপর পুরো দেশের প্রত্যাশার চাপ থাকে। আর তাই হয়তো অনেক সময় এই বাড়তি চাপে খেই হারিয়ে ফেলেন খেলোয়াড়েরা। মিস করে বসেন পেনাল্টি। অন্যদিকে বিশ্বের সেরা সব গোলকিপার নিজেদের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়েই বিশ্বকাপে আসেন। তাই ফুটবল বিশ্বকাপে পেনাল্টিতে গোল মিস করার ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। সর্বশেষ কাতার বিশ্বকাপে নির্ধারিত সময়ে মেসি ও লেভানদোফস্কির মত বিশ্বসেরা খেলোয়াড়দের পেনাল্টি মিস এবং শেষ ষোলোর শুট আউটে দল হিসেবে জাপান ও স্পেনের গোল বিশ্বকাপ ইতিহাসে পেনাল্টি মিসের লিস্টে নতুন সংযোজন।
সূত্র: এমএসএন