ডলারের বিপরীতে টাকার মান ধরে রাখা যেভাবে মুদ্রাস্ফীতিতে ভূমিকা রাখলো
অক্টোবর-নভেম্বর মাসের বেশিরভাগ দিনই ডলারের ইনডেক্স রেট বছরের সর্বোচ্চ অবস্থানে ছিল। বিশ্বের অন্য প্রধান কারেন্সিগুলোর এক্সচেঞ্জ রেটও ডলার শক্তিশালী হওয়ার কাছাকাছি সময়েই বেড়েছে। ইয়েন, পাউন্ড বা ইউরোর মতো কারেন্সিগুলো মান হারিয়েছে তখন।
বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ২৭ সেপ্টেম্বর ডলার চলতি বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে ছিল। প্রায় একই দিনে বছরের দুর্বলতম দিন কাটিয়েছে পাউন্ড ও ইউরো।
চীন, জাপান বা ভারতের মতো দেশও অক্টোবরে তাদের স্থানীয় মুদ্রার দুর্বলতম দিন দেখেছে। এমনকি দুর্বল অর্থনীতির দেশ পাকিস্তানও ডলারের সঙ্গে সমন্বয় করার চেষ্টা করে ধারাবাহিকভাবে রুপির অবমূল্যায়ন করেছে। সেপ্টেম্বরেই তারা তাদের মুদ্রার সর্বনিম্ন মান দেখেছে।
নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ডলারের তেজ কমতে থাকে। এখন পর্যন্ত ডলারের বাজার এই ধারাতেই আছে। এর বিপরীতে পাউন্ড, ইউরো, ইয়েনের মতো মুদ্রাগুলো হারানো মান ফিরে পেতে শুরু করেছে।
এখানেই ব্যতিক্রম অবস্থানে বাংলাদেশ। ডলার বাদে অন্য মুদ্রাগুলো যেখানে শক্তিশালী হচ্ছে, সেখানে টাকা দূর্বল হচ্ছে।
২০২২ সালের মধ্যে গত ২৩ ডিসেম্বর টাকা দুর্বলতম দিন কাটিয়েছে। জানুয়ারি থেকে বছর শেষে টাকা মান হারিয়েছে ২১.৮৮%। অন্যদিকে, পাউন্ড ১১.৮৫%, ইউরো ৬.০৪%, ইয়েন ১৫.৪৯%, ইউয়ান ৯.২৩%, ভারতীয় রুপি ১১.৩৭%, পাকিস্তানি রুপি ২৮.১৫%, ভিয়েতনামী ডং ৩.৫৩% মান হারিয়েছে।
অথচ বছরের শুরুর তুলনায় ডিসেম্বর শেষে ডলার ৭.৫% শক্তিশালী হয়েছে। অর্থাৎ ডলার যে পরিমাণ শক্তিশালী হয়েছে, টাকা মান হারিয়েছে তার প্রায় তিনগুণ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এমন হওয়ার অন্যতম কারণ দীর্ঘদিন কৃত্রিমভাবে টাকার মান বাড়িয়ে রাখা। দীর্ঘদিন দেশে মুদ্রাস্ফীতি হলেও ডলারের দাম সে অনুযায়ী বাড়ানো হয়নি। এছাড়া ডলার যখন শক্তিশালী হওয়া শুরু করে টাকার মান সেভাবে না কমার কারণে বাজারে ডিমান্ড-সাপ্লাইয়ে একটা ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়। সেটিই এখন ভোগাচ্ছে বাংলাদেশকে।
এছাড়া হুট করে টাকার মান কমিয়ে দেওয়ায় আগে ব্যবসায়ীদের মধ্যে যারা দেশি-বিদেশি ব্যাংক থেকে ডলারে ঋণ নিয়েছিলেন, তাদেরকে এখন অনেক বেশি দামে ডলার কিনে ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। ফলে তাদের অনেকে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা হারিয়ে খেলাপী হচ্ছেন।
আবার, অনেক আমদানিকারকেরা কোভিডের সময়ে করা আমদানির ডলার পেমেন্ট ডেফার করে রেখেছিলেন। কেনা দামের সঙ্গে লাভ যুক্ত করে আমদানি করা পণ্য বিক্রিও করে দিয়েছেন। এখন ওইসব আমদানির ব্যয় মেটাতে তাদের ডলারপ্রতি অন্তত ২০-২২ টাকা বেশি খরচ করতে হচ্ছে। দিনশেষে যা গ্রাহককেই পরিশোধ করতে হচ্ছে এবং মূল্যস্ফিতি বাড়ছে।
অবশ্য মূল্যস্ফিতির পেছনে ডলারের এক্সচেঞ্জ রেট বাড়ার চেয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ার ভূমিকাকেই বড় করে দেখছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক অর্থনীতিবিদ টিবিএসকে বলেন, "আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বাড়ার কারণে সারা পৃথিবীতেই ইনফ্লেশন হচ্ছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। আমাদের রপ্তানির তুলনায় আমদানি অনেক বেশি হওয়ার কারণে টাকাকে শক্তিশালী করে রাখলে আমদানি খাত সুবিধা পায়, সর্বোপরি যা ইনফ্লেশনকে নিয়ন্ত্রণে রাখে।"
"আবার এখন টাকার মান কমানোর কারণে আমদানি নিরুৎসাহিত হচ্ছে এবং রপ্তানিকারকেরা সুবিধা পাচ্ছে। সব দিক বিবেচনা করেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব সিদ্ধান্ত নেয়।"
টাকার মান হুট করে কমিয়ে দেওয়া ইনফ্লেশন বাড়াতে খুব বেশি প্রভাব রাখেনি বলে দাবি করেন তিনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই কর্মকর্তার বক্তব্য, "ডলারের বিপরীতে পৃথিবীর প্রায় সব প্রধান প্রধান মুদ্রার মানই কমেছে। সেভাবেই আমাদের কমেছে।"
ডলারের ভিন্ন ভিন্ন রেটও দেশের ফরেইন কারেন্সি ইনকামিংকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে না বলে দাবি করে তিনি আরো বলেন, এখন রেমিট্যান্সসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ডলারের জন্য যথেষ্ট ভালো রেট দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া রেমিট্যান্সে আলাদা ২.৫% প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকনোমিস্ট জাহিদ হোসেনের মতে, দেশের বাজারে ডলারের ভিন্ন ভিন্ন রেট থাকার কারণে সংকট আরো ঘণিভূত হচ্ছে।
তিনি বলেন, "ডলারের ভিন্ন ভিন্ন রেট কেন থাকবে? একই ডলারের জন্য বর্তমানে ৪টি আলাদা রেট আছে। এর কারণে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ডলার সংকটের কারণে অনেক ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।"
রেমিট্যান্সের ডলারের রেট বাজারমূল্যের চেয়ে কমিয়ে রাখায় প্রতি মাসে অন্তত ৫০০ মিলিয়ন কম রেমিট্যান্স আসছে উল্লেখ করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, "বছরে অন্তত ৬ বিলিয়ন ডলার কম রেমিট্যান্স আসবে শুধুমাত্র এই একটি রেটের কারণে। সেপ্টেম্বর মাসে রেমিট্যান্সের ডলারের রেট ফিক্স করার আগে রেমিট্যান্স ফ্লো অনেক বেশি ছিল। এখন সেটি কমে গেছে। অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে ডলারের রেট কমালে ফ্লো কমবে এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ রেমিট্যান্স কমার ঘটনাটি অর্থনীতিবিদদের জন্য একটি আদর্শ উদাহরণ। এটি আমাদের জন্য একটা শিক্ষাও।"
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ২ বিলিয়ন ডলার করে রেমিট্যান্স এসেছে। এর পরের তিন মাস রেমিট্যান্স এসেছে ১.৫ বিলিয়ন করে।
টাকার মানকে বাজারের চাহিদা ও যোগানের উপর ছেড়ে দেওয়া উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, "ডলারের রেট বাজারভিত্তিক করে দিলে চাহিদা ও যোগানে একটা সামঞ্জস্য আসবে। সেখানেও সমস্যা হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছুটা হস্তক্ষেপ করতে পারে। তবে বাজারভিত্তিক ডলারের রেটকে আপাতত সমাধান বলে মনে হচ্ছে।"
ডলারের প্রচলিত রেটগুলোকে ধীরে ধীরে বাজারের ইকুইলিব্রিয়াম রেটের সঙ্গে সমন্বয় করার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিন্তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন জাহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, "ডলারের যে ৪টি রেট করা হয়েছিল, তখন কি ধীরে ধীরে করা হয়েছিল? বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ পেয়েই এবিবি ও বাফেদা এই রেটগুলো করেছে। তাহলে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদেরকে ডেকে বলে দিলেই তো এটা কালকে থেকে কার্যকর হয়ে যাবে।"
"সমস্যাটি আসলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলেই সেটা দ্রুত কার্যকর করা সম্ভব। সেটি না করে রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করা হচ্ছে, যেটি আমাদের রিজার্ভকে কমিয়ে দিচ্ছে। লোন রিপেমেন্টের মতো ডলারের এক্সচেঞ্জ রেটও ব্যাংকগুলোর হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন এই অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ।
তবে বাজারের হাতে এক্সচেঞ্জ রেট ছেড়ে দিলেই যে সমাধান হয়ে যাবে, এমনটাও মনে করেন না তিনি। জাহিদ হোসেন বলেন, "যেখান থেকে আমাদের রেগুলার ফরেইন এক্সচেঞ্জ সাপ্লাই আসে, সেগুলো যাতে বাড়ানো যায় সেদিকেও আমাদের নজর দিতে হবে।"
ডলারের ভিন্ন ভিন্ন রেট থাকার কারণে ফরেইন কারেন্সি বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, "বাজারে ডলারের পরিমাণ বেড়ে গেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার কিনে, আবার সংকট দেখা দিলে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে টাকার মান নিয়ন্ত্রণ করেছে এতোদিন। এটাকে ফ্লি ফ্লোট না করার ভুলেই কিন্তু আমাদের টাকার মান খুব কম সময়ে অনেক বেশি নেমে গেছে। টাকার মানকে অল্প অল্প করে এডজাস্ট করলে আজকে এই অবস্থা হতো না।"
"ইমপোর্টকে সাপোর্ট করা, ইনফ্লেশনকে নিয়ন্ত্রণ করা ও 'বাংলাদেশের কারেন্সি স্ট্রং' এমন ভুল ইমেজ বিশ্বকে দেখানোর জন্য টাকার মান জোর করে ধরে রাখা হয়েছিল। শ্রীলঙ্কাও টাকা ছাপিয়ে ডলারের মান ধরে রাখার চেষ্টা করেছিল, ব্যর্থ হয়েছে। জোর করে তো কারেন্সির মানকে ধরে রাখা যায় না। কিছুটা ম্যানেজ করে রাখা যায়। এই ভুলটাই বাংলাদেশ ব্যাংক করেছে।"
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফরেন এক্সচেঞ্জ নিয়ে সামনে কী পলিসি নিতে পারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলেন, "রেমিট্যান্সের রেট কমিয়ে রাখা হয়েছে। এটা ঠিক হচ্ছে না। ভিন্ন ভিন্ন ডলারের রেট রাখা যাবে না। ডলারের রেটকে ফ্রি ফ্লোট করে দেওয়া উচিত। পরে যদি সমস্যা দেখা দেয়, প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপ করতে পারবে। তবে রেটকে এভাবে আটকে রাখা ঠিক হচ্ছে না।"
- লেখক: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের জুনিয়র স্টাফ করেসপন্ডেন্ট