কি নেই তার! বিশ্বের শীর্ষ ধনী বার্নার্ড আর্নো: সুপারইয়ট, প্রাসাদ থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত দ্বীপ...
টেসলার সিইও ও স্পেসএক্স এর প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ককে পেছনে ফেলে গত বছরের ডিসেম্বরেই বিশ্বের শীর্ষ ধনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন ফরাসি বিলিয়নিয়ার বার্নার্ড আর্নো। ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ার্স ইনডেক্স (১৫ ডিসেম্বর, ২০২২) অনুসারে, ফরাসি বিলাসপণ্য কনগ্লোমারেট লুই ভিঁতো মোয়েত এনেসি (এলভিএমএইচ)-এর চেয়ারম্যান ও সিইও আর্নোর মোট সম্পদের পরিমাণ ১৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, এই বিপুল পরিমাণ অর্থবিত্ত কিভাবে খরচ করেন ৭৩ বছর বয়সী আর্নো?
এই মুহূর্তে বিশ্বের শীর্ষ ধনী ব্যক্তি বার্নার্ড আর্নোর মালিকানায় রয়েছে চোখ কপালে তোলার মতো অত্যন্ত দামি কিছু জিনিস। ফরাসি ফ্যাশন মোগলের যে লাইফস্টাইল, তার প্রতি পদে পদে টের পাওয়া যায় ঐশ্বর্য ও বিলাসিতা।
১৯৪৯ সালে ফ্রান্সের উত্তরে রুবে শহরে জন্মগ্রহণ করেন আর্নো। প্যারিসের বিখ্যাত প্রকৌশল স্কুল ইকোল পলিটেকনিক থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি। এরপর পারিবারিক ব্যবসায়ে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু হয় তার। ব্যবসায়ে ধারাবাহিক পদোন্নতির মাধ্যমে ১৯৭৮ সালে পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ফেরেট-স্যাভিনেল (নির্মাণ সামগ্রীর কোম্পানি)-এর চেয়ারম্যান হন তিনি।
এর বছর ছয়েক পরে, আর্নো ফরাসি সরকারের কাছ থেকে দেউলিয়া ঘোষিত টেক্সটাইল কোম্পানি বুসাক সেন্ট-ফ্রেরেস কিনে নেন। দেউলিয়া ঘোষিত এই টেক্সটাইল গ্রুপ ছিল ফ্রান্সের বিখ্যাত ফ্যাশন হাউজ ক্রিশ্চিয়ান ডিয়রের তৎকালীন প্যারেন্ট কোম্পানি। ফলে এই প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণও চলে আসে আর্নোর হাতে।
দেনায় জর্জরিত গ্রুপটি আর্নোর নেতৃত্বে ধীরে ধীরে তীরে উঠতে শুরু করে এবং এক সময় বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিলাসবহুল পণ্যের কোম্পানি হিসেবে জায়গা করে নেয়। লুই ভিঁতো, ক্রিশ্চিয়ান ডিয়র, হাবলট, লে পার্সিয়ানের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো আর্নল্টের প্রতিষ্ঠান এলভিএমএইচের অন্তর্ভুক্ত। একের পর এক লাক্সারি ব্র্যান্ডের মালিকানা নিজের হাতে নিতে থাকায় ফরাসি গণমাধ্যমে তাকে 'উলফ অব দ্য ক্যাশমেয়ার কোট' ডাকনাম দেওয়া হয়।
১৯৮৭ সালে লুই ভিঁতো এবং মোয়েত এনেসি নিয়ে এলভিএমএইচ গ্রুপ গঠিত হওয়ার বছর দুয়েক পর, ১৯৮৯ সালে আর্নো এই কোম্পানির শেয়ারের উল্লেখযোগ্য অংশ কিনে নেন। তখন থেকেই তিনি এলভিএমএইচ-এর চেয়ারম্যান ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
তবে লাক্সারি ব্র্যান্ডের পাশাপাশি হোটেল, শিল্পকর্ম সংগ্রহ, ইয়ট ও শিল্প-সংস্কৃতির জগতেও প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন বার্নার্ড আর্নো।
সুপারইয়ট
২০০৮ সালে প্রথম ইয়টের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় বার্নার্ড আর্নোর। সেবছরই তিনি ৩০০ মিলিয়ন ইউরোতে লাক্সারি ডাচ ইয়ট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ফন লেন্ট এবং ২০০ মিলিয়ন ইউরোতে বিখ্যাত ব্রিটিশ ইয়ট নির্মাতা প্রতিষ্ঠান প্রিন্সেস ইয়টস ইন্টারন্যাশনাল কিনে নেন।
আর্নোর মালিকানায় থাকা 'সিম্ফোনি' নামের ইয়টটি বিশ্বের শীর্ষ একশোটি সুপারইয়টের মধ্যে একটি এবং সবচেয়ে বড় ফিডশিপ। সিম্ফোনির ভেতরে ৩৬ জন মানুষ থাকতে পারবে। এটিই প্রথম ফিডশিপ যেটির দৈর্ঘ্য ১০০ মিটারেরও বেশি। সিম্ফোনির দৈর্ঘ্য ১০১.৫ মিটার বা ৩৩৩ ফুট।
টিম হেইউড ডিজাইন এর নকশা করা এই সুপারইয়টটি একটি পরিবেশবান্ধব ইয়ট। এর মধ্যে আছে ছয়টি ডেক, একটি হেলিকপ্টার প্যাড এবং এর পরিবহন ক্ষমতা ৩০০০ টন। এটির ইন্টেরিয়রের নকশা করেছে জুরেত্তি ইন্টেরিয়র ডিজাইন। সিম্ফোনির মধ্যে বিলাসিতার কোনো কমতি রাখেননি ডিজাইনাররা। এর মধ্যে রয়েছে একটি জাকুজ্জি, সওনা, লাউঞ্জ এবং একটি ডাইনিং এরিয়া বা খাওয়ার জায়গা যেখানে একসাথে ২০ জন মানুষ বসতে পারবে। ইয়টের একটি ডেকে রয়েছে ব্যক্তিগত অফিস কক্ষ এবং আলাদা আলাদাভাবে স্টাডি রুম, বিচ ক্লাব, সিনেমা, গলফ খেলার জায়গা ও ওয়েলনেস সেন্টার তো আছেই।
বার্নার্ড আর্নোর মালিকানায় ১৯৬৮ সালে তৈরি 'আমাদিউস' নামের আরেকটি সুপারইয়ট ছিল। অনেক পুরনো হলেও পরে এটিকে আধুনিক ও বিলাসী রূপ দেওয়া হয়। এই ইয়টে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার এবং বিখ্যাত রকস্টার বোনোর মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সময় কাটিয়েছেন। যদিও ২০১৫ সালে এই ইয়টটি বিক্রি করে দেন আর্নো।
ওয়াইনের ব্যবসা
সারা বিশ্বে এলভিএমএইচ এর তেইশটি হাউজে খুবই উন্নতমানের কগন্যাক, ওয়াইন এবং শ্যাম্পেইন তৈরি করা হয়। প্রধান ব্র্যান্ডগুলো হলো মোয়েত অ্যান্ড শদোঁ, এনেসি, ক্রুগ এবং শাতো দিকেম।
ব্যক্তিগত দ্বীপ
বিলিয়নিয়ারদের সাথে সাধারণ মানুষের পার্থক্য তো এখানেই; সাধারণ মানুষেরা দ্বীপে বেড়াতে যান আর বিলিয়নিয়াররা গোটা একটা দ্বীপই কিনে নেন! বার্নার্ড আর্নোর মালিকানায় রয়েছে ইন্ডিগো আইল্যান্ড। বাহামা দ্বীপপুঞ্জে ১৩৫ একরের এই ব্যক্তিগত দ্বীপে সপ্তাহে ৩০০,০০০ ডলারের বিনিময়ে সময় কাটাতে পারবেন বিত্তশালীরা।
শিল্পকর্ম
বিশ্বের বিখ্যাত বিখ্যাত শিল্পকর্ম সংগ্রহের জন্য বিশেষ সুখ্যাতি রয়েছে বার্নার্ড আর্নোর। ফরাসি এই বিলিয়নিয়ারের সংগ্রহে রয়েছে পিকাসো, অ্যান্ডি ওয়ারহল, হেনরি মুরের মতো শিল্পীদের শিল্পকর্ম।
এলভিএমএইচ এযাবত শিল্প সাধনার পেছনে মোটা অংকের টাকা বিনিয়োগ করেছে। শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি আর্নোর যে ভীষণ আগ্রহ তা এখান থেকেই টের পাওয়া যায়; বিশেষ করে ২০০৬ সালে ফাউন্ডেশন লুই ভিঁতো প্রতিষ্ঠা করা- যেটি ২০১৪ সালে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
ব্লুমবার্গ সূত্র অনুযায়ী, প্যারিসে নিজের বাড়িতে আর্নো সবচেয়ে বিখ্যাত শিল্প সংগ্রহগুলো রাখেন।
বিলাসবহুল হোটেল
এলভিএমএইচ এর মালিকানায় রয়েছে শিভাল ব্লাংক ও বেলমুন্দ হোটেল, যেগুলোকে বিলাসিতার চূড়ান্ত বললেও ভুল বলা হবে না! শিভাল ব্লাংক একটি লাক্সারি হোটেল যেখানে রয়েছে ৭২টি রুম এবং অনেকগুলো স্যুইট। এই হোটেলের ভেতরেই লুই ভিঁতো ও ডিয়র বুটিকে শপিং করার ব্যবস্থা রয়েছে।
বিশ্বের ২৪টি দেশে এলভিএমএইচ ৪৬টিরও বেশি বেলমুন্দ হোটেল প্রপার্টি রয়েছে, আগামীতে সংখ্যাটা হয়তো আরও বাড়বে।
সেইন্ট-ট্রপেজ ম্যানসন
ফ্রান্সের সেইন্ট ট্রপেজে শাতো স্টাইলের একটি রাজকীয় প্রাসাদ রয়েছে বার্নার্ড আর্নোর। একাধিক বেডরুম, আউটডোর সুইমিং পুল, টেনিস কোর্ট, মুভি থিয়েটার এবং স্টাফদের থাকার জন্য আলাদা কোয়ার্টার রয়েছে এখানে।
ব্যক্তিগত জেট বিমান
ড্যাসল্ট ফ্যালকন সেভেনএক্স নামের ব্যক্তিগত জেট বিমানটি কেনার পেছনে বার্নার্ড আর্নো ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের দাবি। এর আগে তার কাছে একটি 'বম্বারডিয়ার গ্লোবাল এক্সপ্রেস ৬০০০' বিমান ছিল। এছাড়াও, আলট্রা-লং-রেঞ্জ বিজনেস জেট 'বম্বারডিয়ার গ্লোবাল ৭৫০০' রয়েছে এই ফরাসি ধনকুবেরের মালিকানায়। এই বিমানটি ১৯ জন যাত্রী বহন করতে সক্ষম।
সূত্র: অগাস্টম্যান