সম্ভাবনার নন-লেদার ফুটওয়্যার খাত, বাড়ছে রপ্তানি
বাংলাদেশের চামড়া শিল্প নিয়ে বিস্তর আলোচনা এবং এ খাতের রপ্তানি যখন প্রত্যাশিত অগ্রগতি করতে ব্যর্থ হচ্ছে, তখন অনেকটা নীরবেই বাড়ছে নন-লেদার ফুটওয়্যারের রপ্তানি। গত পাঁচ বছরে এ খাতের রপ্তানি প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ছুঁইছুঁই। আগামী দিনগুলোতেও এই পণ্যের রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধির আভাস মিলছে। ২০২৩ সাল নাগাদ ২ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানিতে চোখ বাংলাদেশের।
ব্লুমবার্গের এক বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, সোর্সিং ব্যয় কমানোর অংশ হিসেবে চীন থেকে ব্যবসা কমিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তানের মত দেশগুলোতে ব্যবসা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে বড় নন-লেদার জুতার ব্র্যান্ডগুলো।
খাত সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, বৈশ্বিক ক্রেতারা এ পণ্যটির জন্য সম্ভাবনাময় সোর্সিং কান্ট্রি হিসেবে বাংলাদেশকে তাদের বিবেচনায় রাখছেন। বিশেষত বিশ্বের শীর্ষ নন-লেদার ফুটওয়্যার রপ্তানিকারক চীনের উপর থেকে পশ্চিমা ক্রেতারা নির্ভরতা কমানো শুরু করায় বাংলাদেশের সামনে ভালো সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
বেঙ্গল লেদার কমপ্লেক্স লিমিটেড প্রতি বছর প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলারের নন-লেদার স্যু রপ্তানি করে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান টিপু সুলতান বলেন, "কাস্টমারদের আগ্রহ প্রচুর। আগামী বছরগুলোতে এই পণ্যের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে।"
শীর্ষস্থানীয় লেদার এন্ড নন-লেদার ফুটওয়্যার রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডও মনে করে, সামনে ব্যবসার সুদিন আসছে। এপেক্স ফরাসি ক্রীড়াসামগ্রী বিক্রয়কারক প্রতিষ্ঠান ডেকাথলন এসএ'র সরবরাহকারীদের একজনও বটে।
এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, "ক্রেতারা চীন থেকে অর্ডার কমাচ্ছে। নন-লেদার ফুটওয়্যারের ক্ষেত্রে ভিয়েতনামের অবস্থানও বেশ ভালো। কিন্তু ভিয়েতনাম হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিতে যাচ্ছে, যার ফলে সেখান থেকেও ক্রেতারা সোর্সিং কমাবে। এর ফলে বাংলাদেশের সামনে দারুণ সুযোগ রয়েছে এই পণ্যটির রপ্তানি বাড়ানোর।"
এই পণ্যের তালিকায় রয়েছে স্যান্ডেল, ফ্লিপ-ফ্লপ, বুট, জুট বেসড এসপাড্রিলস, ক্যানভাস বা রাবারের জুতা, স্নিকার্স, মোল্ডেড পলিইউরেথেন এবং পিভিসি স্যুজ।
বাংলাদেশের মূল রপ্তানি বাজার হলো স্পেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, জার্মানি এবং ইতালি।
এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো (ইপিবি) অব বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে লেদার ছাড়াও অন্যান্য ফুটওয়্যার রপ্তানি করেছে ৪৪৯ মিলিয়ন ডলারের, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি।
পাঁচ বছর আগে, অর্থাৎ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই পণ্যটির রপ্তানির পরিমাণ ছিলো ২৪৪ মিলিয়ন ডলারের।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই–ডিসেম্বর) অন্যান্য ফুটওয়্যার রপ্তানির প্রবৃদ্ধিও আশাব্যাঞ্জক। আলোচ্য সময়ে এই পণ্যটি রপ্তানি হয়েছে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের, যাতে প্রবৃদ্ধি ১৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) আশা করছে, আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে নন-লেদার ফুটওয়্যারের রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলার আর ২০৩০ সাল নাগাদ তা ২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে পারে।
খাত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই পণ্যের বৈশ্বিক বাজারের আকার ৩০০ বিলিয়ন ডলারের উপরে।
চীন নির্ভরতা কমছে
ব্লুমবার্গের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০১১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বিশ্ববাজারে সু রপ্তানিতে চীনের অংশ কমেছে প্রায় সাড়ে ছয় শতাংশ। ২০১১ সালে বিশ্ববাজারে সু রপ্তানিতে চীনের অংশ ছিলো ৬১ শতাংশ, আর ১০ বছর পর এসে তা দাঁড়িয়েছে ৫৪ শতাংশে।
এতে বলা হয়, চীনের উৎপাদন সক্ষমতা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাইরে, অর্থাৎ ভারতের মতো দেশে স্থানান্তর করলে তা জুতার উৎপাদন খরচ কমাতে ভূমিকা রাখতে পারে। ২০২৫ সালে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির পরও ভারতে শ্রম খাতে খরচ চীনের তুলনায় অর্ধেক এবং ভিয়েতনামের তুলনায় ৭০ শতাংশ কম হবে বিধায় এ খরচ কমবে বলে উল্লেখ করা হয়।
অনুমান করা হয়েছে, আগামী দুই বছরে চীনা সক্ষমতার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ দক্ষিণ এশিয়ায় এবং আরও ৯% ভিয়েতনামে স্থানান্তরিত হতে পারে।
উদ্যোক্তাদের চ্যালেঞ্জ
চামড়াজাত পণ্যে যেমন কাঁচা চামড়াসহ কাঁচামালের প্রায় পুরো অংশ স্থানীয়ভাবে সরবরাহ সম্ভব, নন-লেদারের ক্ষেত্রে তা নয়। সিন্থেটিক, রাবার, প্লাস্টিক এবং কাপড় কিংবা কেমিক্যালের বেশিরভাগই আমদানি করতে হয়। এই আমদানি প্রক্রিয়া সবার জন্য সহজ নয়। আবার এইচ এন্ড এম, ডেকাথলন, ফিলা এন্ড কাপা-র মতো ব্র্যান্ডের অর্ডার পেলেও নাইকি, অ্যাডিডাসের মতো বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোর অর্ডার পায় না বাংলাদেশ।
উদ্যোক্তারা বলছেন, সাপ্লাই চেইন, লজিস্টিকস এর মতো জায়গায় চীন, ভিয়েতনামের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।
সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর টিবিএসকে বলেন, চীন, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ার তুলনায় এসব ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকায় বাংলাদেশের কস্ট বেড়ে যায়, যা প্রতিযোগিতায় আমাদের পিছিয়ে দেয়।
এ খাতকে সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে সরকার ২০২০ সাল থেকে এই পণ্যের রপ্তানির জন্য ৪% নগদ প্রণোদনা দিয়ে আসছে। তবে উদ্যোক্তারা বলছেন, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য তা ১৫% হওয়া উচিত।
এছাড়া বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ারের ইস্যুটি উঠে এসেছে ব্লুমবার্গের বিশ্লেষণে।
এতে বলা হয়, উন্নত অর্থনীতি থেকে বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে কার্বন নির্গমন রীতি এবং শ্রমের মানের (লেবার স্ট্যান্ডার্ড) মতো ইস্যুগুলো সমাধান করতে হতে পারে।