কারাগারে আটকে রাখার প্রতিবাদে অনশনে গেলেন ইরানি চলচ্চিত্র নির্মাতা জাফর পানাহি
প্রখ্যাত ইরানি চলচ্চিত্র নির্মাতা জাফর পানাহিকে দীর্ঘদিন যাবত দেশটির কুখ্যাত এভিন কারাগারে আটক করে রেখেছে ইরান সরকার। সম্প্রতি এর প্রতিবাদে পানাহি নিজেই কারাগারের ভেতরে অনশন শুরু করেছেন; যদিও কয়েকদিন আগে মাত্র ইরানের সুপ্রিম কোর্ট তার সাজা বাতিলের আদেশ দিয়েছেন।
সুপ্রিম কোর্টের আদেশের পর ধারণা করা হচ্ছিলো শীঘ্রই জামিনে মুক্তি পাবেন জাফর পানাহি; যদিও তার আইনজীবী সালেহ নিকবাখত সফলভাবে তার আটকের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করেছেন।
বুধবার সন্ধ্যায় পানাহির স্ত্রী তাহেরাহ পানাহি এবং ছেলে পানাহ পানাহি জাফর পানাহির পক্ষ থেকে ইনস্টাগ্রামে একটি বিবৃতি দিয়ে তার অনশনের খবর জানান।
বিবৃতিতে জাফর পানাহি বলেন- "আমি দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করছি যে, বিচার বিভাগীয় ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তাযন্ত্রের আইনবিরুদ্ধ ও অমানবিক আচরণের প্রতিবাদে আমি আজ ১লা ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন শুরু করেছি। আমাকে মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত আমি কোনো প্রকারের খাবার ও পানীয় গ্রহণ করবো না। আমার এই আপাতঃ প্রাণহীন দেহটা যতক্ষণ না পর্যন্ত কারাগার থেকে মুক্তি পাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি এ অবস্থায়ই থাকবো।"
উল্লেখ্য যে, ভিন্নমত প্রকাশের অভিযোগে ২০২২ সালের জুলাইয়ে ইরানের অন্য দুই চলচ্চিত্র নির্মাতা মোহাম্মদ রসুলফ ও মোস্তফা আল-আহমাদকে আটক করে দেশটির সরকার। এর কয়েকদিন পর তাদের খোঁজ নিতে এভিন জেলে যান জাফর পানাহি। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর তাকেও আটক করা হয়।
এর কয়েকদিন পর জানা যায়, ইরানের কর্তৃপক্ষ ২০১০ সালে পানাহির বিরুদ্ধে আনা ছয় বছরের সাজা পুনরায় সচল করার এবং তার ওপর ২০ বছরের ভ্রমণ ও সিনেমা নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আরও জানা গেছে, ২০০৯ সালে ইরানে 'সবুজ বিপ্লব'-এর সময় গুলিতে নিহত এক ছাত্রের শেষকৃত্যে উপস্থিত ছিলেন পানাহি এবং পরবর্তীতে এ ঘটনা অবলম্বনে তিনি একটি সিনেমা নির্মাণেরও চেষ্টা করেন। তার বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক অভিযোগ ও তাকে আটকে রাখার সাথে এ বিষয়গুলোরও সম্পর্ক রয়েছে।
এদিকে, সাজার বিধানের পর থেকে দীর্ঘদিন ইরান ছেড়ে কোথাও যাননি জাফর পানাহি এবং তখন থেকে প্রায়ই তাকে গৃহবন্দী অবস্থায় থাকতে হয়েছে।
পানাহির আইনজীবী আদালতে সফলভাবে প্রমাণ করেছেন যে তার বিরুদ্ধে আনা ছয় বছরের সাজার মেয়াদ শেষ হয়েছে। পানাহিকে পুনরায় বিচার প্রক্রিয়া শুরুর জন্য আবেদন করার অনুমতিও দেওয়া হয়েছিল, যার ফলে এমনিতেই তিনি জামিনে মুক্তি পেতেন। কিন্তু উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আজও সে প্রক্রিয়া আরম্ভ করেনি।
পানাহি লিখেছেন, "আমরা দেখি যে এই দেশে নির্দোষ তরুণদের আটক করার এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। এদিকে নিরাপত্তা বাহিনীর হস্তক্ষেপে আমার মামলাটি হস্তান্তর করতেই একশো দিনেরও বেশি সময় লেগে যাচ্ছে।"
'দ্য হোয়াইট বেলুন' নির্মাতা জানান, ইরানি কর্তৃপক্ষ বারবার নানা অজুহাত দিয়ে তার মুক্তির দিন পেছাচ্ছে।
পানাহির ভাষ্যে, "এটা নিপীড়ণের একটা অজুহাত মাত্র। আমি জানি যে এদেশের বিচারব্যবস্থা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলোর আইন বাস্তবায়নের কোনো ইচ্ছাই নেই। কিন্তু তবুও আমার আইনজীবী এবং বন্ধুদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে আমি সকল আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছি আমার অধিকার আদায়ের জন্য।"
"আজ ইরানের আরও অনেকে যারা এখনও আটকে আছেন, তাদের মতো আমারও এসব অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই", বলেন 'দ্য সার্কল' পরিচালক।
ইরানের আইন মেনে হিজাব না পরায় গত বছর দেশটির নীতি-পুলিশ মাহসা আমিনি নামের এক নারীকে আটক করে এবং পুলিশি হেফাজতে থাকাবস্থায় তার মৃত্যু হয়। মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর ইরানজুড়ে হিজাববিরোধী আন্দোলনের ঝড় ওঠে। দেশে নারী স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অসংখ্য নারী-পুরুষ রাজপথে নেমে আন্দোলন করেন।
ইরান সরকার এ আন্দোলন দমন করার জন্য বলপ্রয়োগ করে এবং হাজার হাজার আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করে। সম্প্রতি আন্দোলনকারীদের অনেককে ফাঁসি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার।
এখন পর্যন্ত আন্দোলনে অংশ নেওয়া চার জনকে ফাঁসি দিয়েছে ইরান সরকার এবং আরও ১০০ জনকে তালিকাভুক্ত করে রাখা হয়েছে।
সূত্র: ডেডলাইন