গুলি করে চীনা স্পাই বেলুন নামানো সহজ মনে হলেও বাস্তবে বেশ কঠিন
সামরিক গবেষণা অনুসারে, সন্দেহজনক চীনা স্পাই বেলুনটিকে এর 'টিকে থাকার সক্ষমতা'র কারণে একে গুলি করে নিচে নামিয়ে আনা বেশ কঠিন হবে। বিশ্লেষকরাও মত দিয়েছেন, একে আঘাত করা সহজ হলেও এর ক্র্যাশ ল্যান্ডিং কোথায় হবে তা নিয়ন্ত্রণ করা সমস্যাজনক।
চীনের দাবি, তারা স্পাই বেলুন সম্পর্কিত প্রতিবেদনগুলো খতিয়ে দেখেছে এবং তারা কোনোভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের আকাশ সীমা লঙ্ঘন করতে চায়নি। অন্যদিকে চীনা বিশেষজ্ঞরা আমেরিকার দিকে আঙুল তুলেছেন।
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের তথ্যানুযায়ী, একজন জ্যেষ্ঠ মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেছেন যে, পেন্টাগন বিশ্বাস করে যে, এটি যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল জায়গাগুলো পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠানো একটি চীনা বেলুন।
বেশ কয়েকদিন ধরে বেলুনটির গতিবিধি নজরে রাখা মার্কিন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে, এই হাই-অলটিচিউড বেলুনটি বুধবার মন্টানার বিলিংস শহরের ওপর দেখা গিয়েছে এবং তার আগে এটি পশ্চিম কানাডা ও আলাস্কার ওপর দিয়ে এসেছে বলে মনে করা হচ্ছে। মানুষের নিরাপত্তার কারণে বেলুনটিকে গুলি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পেন্টাগন।
স্টেলথি বেলুন
মার্কিন বিমানবাহিনীর মেজর কেভিন ম্যাসির স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারিক এয়ারশিপগুলোর ওপর করা ২০০৯ সালের একটি গবেষণা অনুযায়ী, বেলুনগুলোর বড় আকার থাকা সত্ত্বেও এগুলোকে 'শনাক্ত করা কঠিন এবং আঘাত করলে সাথে সাথে নিচে নামবে না।'
তার গবেষণাপত্রে লেখা হয়েছে, "স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারিক এয়ারশিপগুলো সহজাতভাবে স্টেলথি। কারণ এগুলোর মধ্যে নিষ্ক্রিয় গ্যাস রয়েছে এবং এর ফলে বেলুনগুলো তেমন তাপ উৎপাদন করে না। এগুলো উঁচু উচ্চতায় সামান্য একটি ইনফ্রারেড চিহ্ন দেখায়।"
"তাছাড়া বেলুনের অ-ধাতব গঠন এবং তীক্ষ্ণ প্রান্ত না থাকায় রাডারে তেমন বড় কোনো সংকেত দেখায় না এগুলো। এমনকি এগুলো আকারে বিশাল হলেও অনেক উঁচুতে থাকায় একে চোখে দেখাও কঠিন," বলে যোগ করেন ম্যাসি।
তবে যা-ই হোক, এ ধরনের বস্তু শনাক্তের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা গত এক দশকে যথেষ্ট উন্নত হয়েছে। এবং ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল অনুসারে, বেলুনটিকে একটি বাণিজ্যিক বিমান থেকেই দেখা গিয়েছে।
আইআরআইএস ইন্ডিপেনডেন্ট রিসার্চের মহাকাশ বিশেষজ্ঞ এবং জাতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষক রেবেকা গ্রান্ট নিউজউইককে বলেছেন যে, বেলুনটি ট্র্যাক করা 'কোন সমস্যা ছিল না'। তিনি আরও যোগ করে বলেন, "আমি আশা করি তারা [মার্কিন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা] প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে যাওয়ার পথেই বেলুনটিকে দেখেছে এবং এটি অভ্যন্তরীণভাবেই এফ-২২ বা এফ-১৫-এর মতো ফাইটার রাডার দিয়েই ট্র্যাক করা সম্ভব। এটি আকারে বিশাল।"
মার্কিন তথ্যের বরাত দিয়ে চীনা গণমাধ্যম জানিয়েছে, এর আকার ছিল ৪০ কিউবিক মিটার।
টিকে থাকা বেলুন
বেলুনটিকে নিচে নামিয়ে আনার মূল সমস্যা হলো এ ধরনের হাই-অলটিচিউড বেলুনগুলোর নকশা এমনভাবে করা হয় যে, এটি ফুটো হলেও দীর্ঘ সময়ের জন্য এটি বাতাসে ভেসে থাকতে পারে। ম্যাসির গবেষণা অনুযায়ী, এয়ারশিপগুলোতে হিলিয়াম থাকায় এগুলোতে সহজে আগুনও ধরে না।
ম্যাসির মতে, এ ধরনের বেলুনে প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে এক পাউন্ডেরও কম অভ্যন্তরীণ চাপ থাকে। "ফলে একে আঘাত করলেও এর ফুটো থেকে ধীরগতিতে বাতাস বের হয় এবং ধীর গতিতে নেমে আসে।"
ম্যাসি ১৯৯৮ সালের একটি উদাহরণ টেনে বলেন, কানাডিয়ান এফ-১৮গুলো এরকমই একটি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের বেলুনে গুলি করেছিল, যেটিকে ১০০০ রাউন্ড গুলি দিয়ে আঘাত করার পরও এটি আরও ছয় দিন বাতাসে ভেসে ছিল।
গ্রান্ট ব্যাখ্যা করে বলেন, "একে গুলি করা সত্যিই কোন সমস্যা নয়। একটি ফাইটারই এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল ব্যবহার করে এতে নিখুঁতভাবে ফুটো করে দিতে পারে। আর যদি বেলুনটি যথেষ্ট নিচে থাকে তাহলে একটি বন্দুকও ব্যবহার করা যায়। কিন্তু সমস্যা হলো যখন আপনি একে ফুটো করবেন, তখন গ্যাস বের হতে কতক্ষণ লাগবে এবং বেলুনটি বিক্ষিপ্ত হয়ে কোথায় পড়বে, সে সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়া এবং নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন। এতে দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে। এবং এটিই মূল সমস্যা।"
প্রশাসনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন যে রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনকে এই বিষয়ে জানানো হয়। বেলুনটি মাটিতে পড়ে মানুষকে আঘাত করতে পারে এই আশঙ্কায় তিনি প্রতিরক্ষা প্রধানদের পরামর্শ গ্রহণ করেছিলেন।
গ্রান্ট জানান, "দেখে যা মনে হচ্ছে তা হলো, তারা এটিকে শ্যুট করার কথা বিবেচনা করেছে এবং সম্ভবত সেই বিকল্পগুলো এখনও পুরোপুরি বাতিল করা হয়নি। প্রযুক্তিগত দিক থেকে যা তাদেরকে আটকে রেখেছে তা হলো বেলুনটির ক্র্যাশের জায়গা নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের সমস্যা।"
বেলুনটিকে কি ধরা নিজেদের দখলে আনা সম্ভব?
কোনো অনিয়ন্ত্রিত দুর্ঘটনা এড়াতে মার্কিন সামরিক বাহিনী বেলুনটিকে দখল করতে পারে কিনা জানতে চাইলে গ্রান্ট মন্তব্য করেছিলেন: "ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় রিকনেইসান্স ড্রোন উড়িয়ে সেগুলো থেকে ফিল্ম উদ্ধারের জন্য হেলিকপ্টার এবং কার্গো প্লেন ব্যবহার করা হতো। তাই এটি অভাবনীয় কিছু নয়। কেবল আমরা এ ধরনের কাজ করিনি বেশ কিছুদিন হয়েছে। আমি নিশ্চিত যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট যদি তাদেরকে বলেন, তবে মার্কিন সামরিক বাহিনী এই বেলুনটিকে নিয়ন্ত্রিত ক্র্যাশ করাতে সক্ষম হবে।"
এদিকে, চীনা নেতারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বেলুনটি নামিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তারা বলেছেন যে এটি চীন থেকে বিশেষ উদ্দেশ্যে পাঠানো কোনো বেলুন নয়।
বিশেষজ্ঞ ঝাং জুয়েফেং চীনের রাষ্ট্রীয় মুখপত্র গ্লোবাল টাইমসকে বলেন, "আমার পরামর্শ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেলুনটি গুলি করে ফেলে এর থেকে পাওয়া প্রমাণ দেখে অন্যদেরকে অভিযুক্ত করুক।"
অ্যারোডাইনামিকস বিশেষজ্ঞ হুয়াং ঝিচেংও গ্লোবাল টাইমসকে বলেন যে, চীন থেকে আমেরিকায় পাঠানোর মতো এরকম বিশাল আকারের বেলুন তৈরি করার প্রযুক্তিগত ক্ষমতা কেবল এই দুইটি দেশেরই রয়েছে।
সূত্র: নিউজউইক