ভারতের যে গ্রামে জুতা পরা নিষিদ্ধ!
জুতা আমাদের কাছে খুবই পরিচিত একটি অনুষঙ্গ। নিত্যদিনের কাজে বাইরে বের হওয়ার সময় জুতাজোড়ায় পা গলিয়ে নেওয়ার কথা কেউই ভোলেন না। জুতা আমাদের পা'কে যেমন বাইরের ধুলাবালি-জীবাণু থেকে রক্ষা করে, তেমনই পোশাকের সঙ্গে মানানসই জুতা পরলে ব্যক্তির বাহ্যিক সৌন্দর্যও বেড়ে যায়। অনেকে তো আবার পোশাকের চাইতে দামী-টেকসই জুতা ব্যবহারকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। আবার কারও কারও ক্ষেত্রে, সুন্দর একজোড়া জুতা পরলে তাদের আত্মবিশ্বাসও বেড়ে যায় বহুগুণ!
ভারতীয় উপমহাদেশে অনেককাল আগে থেকেই বাহারি জুতা পরার চল রয়েছে; কাঠের খড়ম-চামড়ার জুতো থেকে শুরু করে কৃত্রিম লেদারের জুতা, ঋতুভেদে ব্যবহারের উপযোগী জুতার অভাব নেই। তবে ভারতীয়দের আবার ক্ষেত্রবিশেষে জুতা ছাড়া থাকতেও কোনো অসুবিধা হয় না। এই যেমন- ঘরে ঢোকার আগে জুতা খুলে ঢোকা; মসজিদ-মন্দিরসহ নানা উপাসনালয়ে জুতা খুলে প্রবেশ করার প্রচলন তো বহু আগে থেকেই।
কিন্তু কখনো কখনো খালি পায়ে থাকার অভ্যাস থাকলেও, দক্ষিণ ভারতের রাজ্য তামিলনাড়ুর একটি ছোট্ট গ্রামের এক অদ্ভুত নিয়ম আপনাকে 'জুতা'র ব্যবহার সম্পর্কে নতুন করে ভাবাবে! তামিলনাড়ুর রাজধানী চেন্নাই থেকে ৪৫০ কিলোমিটার দূরে (চেন্নাই থেকে গাড়িতে সাড়ে সাত ঘণ্টার দূরত্বে), আন্দামান নামের এই গ্রামে কেউই জুতা পায়ে দেন না!
আন্দামান গ্রামে মাত্র ১৩০টি পরিবারের বাস। গ্রামের বাসিন্দাদের বেশিরভাগই কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। জানুয়ারির এক দুপুরে আন্দামান গ্রামে প্রবেশের মুখে দেখা হয় বৃদ্ধ মুখন আরুমুগামের সাথে। গ্রামে ঢোকার মুখেই এক বিরাট নিমগাছের তলায় দৈনন্দিন প্রার্থনার কাজ সারছিলেন তিনি; পরনে ধবধবে সাদা শার্ট ও চেক লুঙ্গি। জানুয়ারির শেষ দিকেও মাথার ওপরে ছিল দুপুরের প্রখর রোদ।
মুখন আরুমুগাম জানান, আন্দামান গ্রামে প্রবেশের আগে সবাই এই নিমগাছের তলায় নিজেদের জুতা খুলে হাতে করে নিয়ে যায়। অত্যন্ত বৃদ্ধ বা অসুস্থরা ছাড়া গ্রামের আর কেউই জুতা পরেন না। আরুমুগাম নিজেও খালি পায়েই ছিলেন; গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমের সময় তার জুতা পরার ইচ্ছা থাকলেও তা সম্ভব হয়না বলে জানান এই বৃদ্ধ। আমি নিজেই ভারি-কালো মোজা পরে গ্রামের পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম, শিশু-কিশোররা স্কুলে যাচ্ছে, নারী-পুরুষ জুটি বেঁধে কাজে যাচ্ছে… সবাই খালি পায়ে, নিজেদের জুতোজোড়া হাতে নিয়ে। তাদের কাছে এটা অনেকটা ব্যাগ বা পার্স বহন করার মতোই সোজা!
রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ১০ বছর বয়সী আনবু নিথিকে দাঁড় করালাম আমি; খালি পায়ে থাকা এই কিশোরকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, এখান থেকে ৫ কিলোমিটার দূরের এক শহরে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে সে। জুতো না পরার নিয়ম কেন মেনে চলে- জিজ্ঞেস করলে আনবু হেসে বলে, "আমার মা বলেছেন আমাদের গ্রামে মুথিয়ালাম্মা নামে এক শক্তিশালী দেবী বাস করেন, যিনি আমাদের গ্রামকে রক্ষা করেন। তাই তাকে সম্মান দেখিয়ে আমরা গ্রামের ভেতরে জুতা পরি না। আমি আসলে চাই জুতা পরতে, কিন্তু তাহলে সবাই যাকে শ্রদ্ধা করে তাকে অশ্রদ্ধা করার মতো হয়ে যাবে ব্যাপারটা।"
আমি সাথেসাথেই বুঝতে পারলাম যে ঠিক এই চেতনার কারণেই আন্দামান অন্যান্য গ্রামের চাইতে আলাদা। কারণ এখানে জোর করে এই নিয়ম বহাল রাখতে হচ্ছে না। এটা কোনো কঠোর ধর্মীয় অনুশাসন নয়, বরং সময়ের সাথে সাথে চলে আসা একটা রীতি, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
"আমরা এই গ্রামে বাস করা চতুর্থ প্রজন্ম, যারা এখনও খালি পায়ে থাকি", বলেন ৫৩ বছর বয়সী কারুপ্পিয়াহ পান্ডে। তিনি তার জুতাজোড়া হাতে নিয়ে হাঁটছিলেন; কিন্তু তার স্ত্রী পেচিয়াম্মা, যিনি ধানক্ষেতে কাজ করেন, তিনি জানান, গ্রামের বাইরে না গেলে তিনি জুতা পায়ে দেওয়া নিয়ে মাথা ঘামান না। আর বাইরের কেউ যখন জুতা পায়ে দিয়ে গ্রামে ঢুকে পড়ে, তখন তারা এই নিয়মটা ব্যাখ্যা করে বুঝানোর চেষ্টা করেন। এরপরেও যদি কেউ না মানতে চায়, তাতে কোনো সমস্যা নেই; তারা কখনো কাউকে জোর করেন না।
পেচিয়াম্মার ভাষ্যে, "এটা একটা মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার যে সে এই নিয়ম মানবে কি মানবে না।" এমনকি তিনি নিজেও তার চার সন্তানকে এই নিয়ম মানতে বাধ্য করেননি। তার সন্তানরা এখন বড় হয়েছে এবং পাশের শহরে বাস করে; কিন্তু তবুও গ্রামে এলে তারা এখানকার নিয়মগুলো মেনে চলে।
কিন্তু একটা সময় ছিল যখন সাধারণ মানুষ শুধুমাত্র ভয় থেকে এই রীতি মেনে চলতো।
আন্দামান গ্রামের বাসিন্দা, রঙমিস্ত্রি সুব্রাহ্মনিয়াম পিরাম্বান বলেন, "জনশ্রুতি আছে যে এই নিয়ম না মানলে রহস্যময়-অদ্ভুত এক জ্বরে আক্রান্ত হবেন। কিন্তু আমরা এই ভয় থেকে এটা মানি না, বরং ছোটবেলা থেকে আমাদের গ্রামকে পবিত্র ভূমি হিসেবে ভেবে এসেছি বলেই মানি- আমার কাছে আমার গ্রাম একটা মন্দিরেরই বর্ধিত অংশ মনে হয়।"
কিন্তু কীভাবে এই জনশ্রুতির উৎপত্তি হলো তা খুঁজতে গিয়ে কথা বলতে হলো গ্রামের অঘোষিত ইতিহাসবিদ লক্ষণন ভিরাবাদ্রার (৬২) সাথে। চার দশক আগে দিনমজুরের চাকরি নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমানো লক্ষণন বর্তমানে দুবাইয়ে একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানি পরিচালনা করেন। মাঝেমধ্যে তিনি গ্রামে আসেন কর্মীর খোঁজে, কিন্তু মূলত নাড়ির টানেই তার ফিরে আসা।
লক্ষণন বলেন, "আজ থেকে সত্তর বছর আগে এই নিমগাছের তলায় গ্রামবাসীরা প্রথম মুথিয়ালাম্মার মাটির প্রতিমা স্থাপন করেন। পুরোহিত যখন প্রতিমার গায়ে গয়না পরাচ্ছিলেন এবং সবাই প্রার্থনায় মগ্ন ছিল, তখন এক তরুণ জুতা পায়ে দিয়েই প্রতিমার পাশ দিয়ে হেঁটে যায়। ওই তরুণ এই পূজাকে অবজ্ঞা করেছিল কিনা তা স্পষ্ট নয়; তবে কথিত আছে যে জুতা পায়ে হেঁটে যাওয়ার সময় সে হঠাৎ পড়ে যায় এবং ওইদিন সন্ধ্যায়ই রহস্যময় এক জ্বরে আক্রান্ত হয়। সেই জ্বর থেকে সেরে উঠতে তার অনেক মাস লেগে গিয়েছিল।"
"এরপর থেকে গ্রামের ভেতরে কেউ কোনো ধরনের জুতা পরে না। এটা এখন আমাদের জীবনের একটা অংশ হয়ে গেছে", বলেন ভিরাবাদ্রা।
আরও জানা যায়, প্রতি ৫-৮ বছর পর পর মার্চ বা এপ্রিল মাসে আন্দামান গ্রামে একটি উৎসবের আয়োজন করা হয়, যেখানে মুথিয়ালাম্মার মাটির প্রতিমা স্থাপন করা হয় সেই নিম গাছতলায়। তিনদিন ধরে দেবী এখানে থাকেন এবং গ্রামবাসীকে আশীর্বাদ করেন। এরপর প্রতিমা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে ফেলার মাধ্যমে উৎসবের সমাপ্তি ঘটে। এ উৎসব চলাকালীন গ্রামে নাচ-গান, নাটক-পালা ও ভোজের আয়োজন করা হয় এবং গ্রামবাসীরা দিন-রাত প্রার্থনায় মগ্ন হয়ে থাকেন। কিন্তু এটি আয়োজন করতে মোটা অঙ্কের টাকা দরকার হয় বলে এটি প্রতিবছর করা হয় না। শেষবার এ উৎসব হয়েছিল ২০১১ সালে।
আন্দামান গ্রামের রমেশ সেভাগন জানান, অনেকেই তাদের এই জনশ্রুতি বিশ্বাস করতে চান না, এটিকে কুসংস্কার ভাবেন। কিন্তু তিনি মনে করেন, এই জনশ্রুতিই গ্রামবাসীদের মধ্যে একতা ও সম্প্রীতির একটা বাঁধন তৈরি করেছে। তার ভাষ্যে, "এটা আমাদের সবাইকে এক ছাদের তলায় নিয়ে আসে, গ্রামের সবাই মিলে একটা পরিবারের মতো মনে হয়ত।"
এই সম্প্রীতি থেকেই তারা আরও কিছু রীতিনীতি মেনে চলেন। যেমন, গ্রামে কেউ মারা গেলে- সে ধনী হোক বা গরিব; গ্রামের প্রত্যেকেই ২০ রূপি করে চাঁদা দিয়ে সাহায্য করেন মৃতের পরিবারকে।
এদিকে আমি ভাবছিলাম, সময়ের সাথে সাথে কি এইসব রীতিনীতি ফিকে হয়ে আসে? সবাই কি একই রকমভাবে অনুভব করে এগুলো? দুবাইয়ে থাকা ভিরাবাদ্রাকে জিজ্ঞেস করলাম, তরুণ বয়সে এই আচার-রীতি সম্পর্কে তার যে মনোভাব ও অনুভূতি ছিল; আজও কি সেরকমই আছে? তিনি উত্তর দিলেন, 'হ্যাঁ, আছে।' এমনকি এতগুলো বছর পরেও তিনি খালি পায়ে গ্রামে যান এবং গ্রামের জনশ্রুতি মানেন।
তিনি বলেন, "এই জিনিসটাই আমাদের মধ্যে সাম্য নিয়ে আসে। আমরা যে যেই অবস্থানেই থাকি না কেন, প্রতিদিন সকালে আমরা এই বিশ্বাস নিয়ে জেগে উঠি যে আমাদের দিনটা ভালোই যাবে। এর কোনো নিশ্চয়তা নেই, কিন্তু তবুও আমরা আমাদের পথে চলি। ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা করি, স্বপ্ন দেখি, সামনে এগিয়ে যাওয়ার চিন্তা করি।" সব জায়গায়ই কোনো না কোনো ছোটখাটো বিশ্বাসকে ঘিরে জীবন এগিয়ে চলে; আমাদের গ্রামে যেমনটা দেখেছেন, তারই আরেকটা রূপ হয়তো অন্য কোথাও আছে।"