ব্যর্থ হওয়ার পরও মানসিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তিরা এই ৭ কৌশলে ঘুরে দাঁড়ায়
ব্যর্থতা, থেমে যাওয়া, হারানো জীবনেরই অংশ।
উদাহরণ হিসেবে সাম্প্রতিক সময়েরই একটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। হারিকেন ইয়ানের ফলে ফ্লোরিডার দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। মানচিত্র থেকে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডমার্ক হারিয়ে যায়। মানুষ তাদের বাড়ি-ঘর হারায়, ব্যবসা হারায়, হারায় তাদের প্রিয়জনকে। এই ক্ষতির পরিমাণ ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। বাংলাদেশেও ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত হয় উপকূলের জনপদ। তবু সংগ্রামী মানুষ হাল ছাড়েনি। জীবন সংগ্রাম মানব ইতিহাসের নিত্যঘটনা। সামষ্টিকভাবে, মানব জাতির আকস্মিক বিপর্যয় বা ক্রমাগত ব্যর্থতাকে জয় করার এক অদম্যতা আছে। তবে সবাই আবার এদিক দিয়ে সমান নন। অর্থাৎ, কেউ মানসিক দৃঢ়তায় বলীয়ান, কেউবা দুর্বল। সাইকোলজি টুডে অবলম্বনে
তবে এটাও ঠিক যে, দুর্যোগের ভয়াবহতা ও আঘাতের পর ঘুরে দাঁড়ানো খুব কঠিন হয়ে পড়ে, বিশেষ করে ঠিক তার পরমুহূর্তেই। এরকম পরিস্থিতিতে একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ যা করতে পারে তা হলো- প্রতিদিনের ধাক্কা প্রতিদিন সামলে নেওয়ার চেষ্টা করা এবং সাহায্যের জন্য প্রতিবেশী ও সমাজের অন্যান্যদের দিকে নির্ভর করা।
সময়ের সাথে সাথে 'হারানো' বা 'ব্যর্থতার' আকারের ওপরও নির্ভর করে এই বিপদ থেকে উত্তরণের সময়সীমা; কিংবা আদৌ ঘুরে দাঁড়ানো আর সম্ভব কিনা। তবে মানসিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তিরা বিভিন্ন কৌশলে এমন বিপদ থেকে ঘুরে দাঁড়ান। এমন অদম্য মনোভাব তাদের কারো কারো ক্ষেত্রে প্রকৃতিপ্রদত্ত, কেউবা জীবনে ঠেকে ঠেকেই শিখেছেন এ কৌশল।
যেভাবে মানসিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তিরা ঘুরে দাঁড়ায়
গবেষণায় দেখা যায়, মানসিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তিদের মধ্যে স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলো তাদের ব্যর্থতা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করে। যেমন ধরা যাক, তাদের মানসিক বা আবেগীয়ভাবে পরিপক্বতা। এটা মানসিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার এমন এক গুণ, যা তাকে বাস্তবতা যেমন ঠিক সেভাবেই উপলদ্ধি করতে শেখায়।
অন্যদিকে, মানসিকভাবে অপরিপক্বরা প্রকৃত বাস্তবতাকে মেনে নিতে চায় না। বরং তারা তাদের পূর্ব ধারণার সাথে বাস্তবতার মিল খুঁজতে থাকে এবং যখন মিল খুঁজে পায় না তখন হতাশ হয়ে উদ্যম হারিয়ে ফেলে। মানসিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তিরা এর বিপরীতে, তাদের বাস্তব পরিণতিকে মেনে নেয় এবং সেখান থেকে উত্তরণের চেষ্টা শুরু করে।
অনেকের মধ্যেই এই দৃঢ়তা জন্মগতভাবেই থাকে। কিন্তু, কিছু কৌশল অবলম্বন করলে সবাই তাদের কঠিন সময়কে পাড়িও দিতে পারে। এগুলো তাই মাথায় রাখা জরুরি। আসুন জেনে নেই অদম্য ব্যক্তিদের এসব কৌশল ও বৈশিষ্ট্য;
১. মানসিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তিরা স্বীকার করে নেন। তারা বোঝেন যে সবার মধ্যেই কমতি আছে। সবার জীবনেই 'ব্যর্থতা' আসবে। চাকরি হারানো কিংবা ডিভোর্সের মতো নানান বাধাবিপত্তি জীবনেরই অংশ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ব্যর্থতার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো- যখন নিজের 'কমফোর্ট জোন' থেকে বেরিয়ে এসে কোনো লক্ষ্য পূরণের জন্য ঝুঁকি নেওয়া হয়। এর মাধ্যমে, নিজদের দোষারোপ না করে বদলে যাওয়া বাস্তবতার স্বরূপকে মেনে নেন তারা।
২. তারা ব্যর্থতাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেন। সমস্যা সমাধানের সময় মানসিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তিরা একইসাথে খোলা মনের অধিকারী এবং পরিস্থিতি অনুসারে কৌশল/ অবস্থান পরিবর্তনের পক্ষে। তারা ইতিবাচক মনোভাব রেখে আত্মচিন্তার মাধ্যমে ব্যর্থতা থেকে বেরিয়ে আসেন। যেমন: লেখক ওয়েইন ডায়ার বলেছিলেন, "যদি তুমি কোনো বিষয় সম্পর্কে চিন্তা ভিন্নভাবে করো, বিষয়টিই বদলে যাবে।" ব্যর্থতা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করলে ব্যর্থতাই নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হবে, মস্তিষ্কে বিষয়টি ইতিবাচকভাবে উপস্থাপিত হবে। যেমন টমাস আলভা এডিসন তার 'ব্যর্থ' পরীক্ষাগুলোকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন যে, "আমি ব্যর্থ হইনি। আমি কেবল এক হাজারটি উপায় বের করেছি, যেগুলো কাজ করে না।" কারণ, তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রতিটি ব্যর্থতা তাকে সফলতার দিকে এক ধাপ সামনে এগিয়ে নিয়েছে।
৩. তারা তাদের ব্যর্থতাকে ভবিষ্যতের বিকাশের জন্য কাজে লাগান। তারা নিজেকে জিজ্ঞাসা করেন, "আমি কীভাবে এই কাজটি ভিন্নভাবে করতে পারতাম? অতিতের অভিজ্ঞতা থেকে– আমি কি শিখেছি কোন জিনিসগুলো কাজ করে, আর কোনগুলো করে না?" যেমন: সম্প্রতি ঘটা কোনো সম্পর্ক-বিচ্ছেদের দিকে তাকিয়ে কেউ শিখতে পারে – আরেকটি সম্পর্ক শুরুর আগে কোন বিষয়গুলোতে আরও ভালোভাবে নজর দেওয়া উচিৎ।
৪. তারা তাদের অনুভূতি সম্পর্কে সৎ। তারা হতাশাকেও মেনে নেন। মানসিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তিরা তাদের অনুভূতিকে চেপে রাখেন না, অনুভূতির আতিশয্যে ডুবেও যান না। অবশ্য তারা অনুভূতিকে স্বীকার করেন এবং তা কাটিয়ে ওঠার জন্য সময় নেন। দুঃখ, হতাশা, প্রত্যাখ্যানকে তারা স্বাভাবিক হিসেবেই নেন, আর এতে ভয়ের কিছু নেই।
৫. তারা আশাবাদী মানসিকতার হন। মানসিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তিরা তাদের জীবন সম্পর্কে আশাবাদী থাকেন। গবেষণাতেও দেখা যায়, আশাবাদী মনোভাব এবং জীবন সম্পর্কে সন্তুষ্টির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, যা আত্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জয় করা যায়। তারা জানেন যে এমন কোনো ব্যর্থতা নেই, যেটি পেরোনো যায় না। যেমন, ধরা যাক স্টিভ জবসের কথাই, যিনি নিজের তৈরি কোম্পানি থেকেই ছাঁটাই হয়েছিলেন। তিনি পরে মন্তব্য করেছিলেন, এটি তার জীবনে হওয়া সেরা ঘটনা। তিনি একে কাজে লাগিয়ে নতুন এক সুযোগ তৈরি করেন, তার মনোযোগ ভিন্ন দিকে ঘোরান। তিনি তৈরি করেন 'নেক্সট' এবং 'পিক্সার'। ব্যক্তি কখনোই ঘটনা ঘটে যাওয়ার সাথে সাথে সবকিছু বুঝে উঠতে পারবে না; তবে যখন সে অতীতের ঘটনাগুলো একটির সাথে আরেকটি জোড়া লাগাতে শুরু করবে, তখন দেখা যাবে যে প্রতিটি 'ব্যর্থতা'র পেছনেই কোনো না কোনো 'ইতিবাচকতা' রয়েছে।
৬. তারা আত্মিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে তাদের অভিজ্ঞতা ও ব্যর্থতার অর্থ খুঁজে বের করেন। অনেক মানসিকভাবে শক্তিশালী ব্যক্তি তাদের আধ্যাত্মিক শক্তিকে তাদের মানসিক শক্তির উৎস হিসেবে রাখে। তারা বোঝে যে তাদের এই আধ্যাত্মিক শক্তি তাদের মধ্যে একধরনের মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ ঘটায়, ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসে। সহনশীলতার সাথে যুক্ত হওয়া আধ্যাত্মিক বিশ্বাস ব্যক্তিকে প্রতিটি কাজের অর্থ খুঁজে বের করতে সাহায্য করে। বিভিন্ন সংস্কৃতির উপকথা বা ধর্মীয় বিষয়গুলো সেই সমাজের ব্যক্তিকে বিভিন্ন সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করে, যার ফলাফল হয় ইতিবাচক। তাই ব্যক্তির মধ্যকার আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় বিষয়গুলো জীবনের অর্থপূর্ণতা ও ইতিবাচক আবেগের সাথে সাথে কৃতজ্ঞতার অনুভূতিও নিয়ে আসে।
৭. মানসিকভাবে দৃঢ় ব্যক্তিরা আত্ম-সহানুভূতিশীল। যখন কোনো কারণে তারা খারাপ অনুভব করলে,নিজেকেই জিজ্ঞাসা করেন, "আমার কোনো বন্ধু যদি আমার মতো পরিস্থিতে পড়তো তাহলে আমি তাকে কী বলতাম?" এর সাথে সাথে তারা মননশীলতার চর্চাও করেন। এর চর্চা ব্যক্তিকে তাদের আন্তরিক অনুভূতিকে চেপে রাখার বদলে- স্বীকার করে নেওয়ার শক্তি দেয়। যেমন: মননশীলতার কিছু চর্চা ব্যক্তিকে 'কষ্টের' মুহূর্তকে স্বীকার করে নিতে শেখায়। এটা তাদের আরো শেখায় যে, শুধু তারা একাই নয়, বরং পৃথিবীতে আরও অনেকেই এমন কষ্টে সময় পার করছে।